বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৪৪ অপরাহ্ন

প্রিয় নবীর শুভাগমনের সময় অলৌকিক ঘটনা

Reporter Name
  • Update Time : সোমবার, ৩ অক্টোবর, ২০২২
  • ১৯১ Time View

ডেস্ক নিউজ : গোটা বিশ্ব যখন অন্যায়-অবিচার, জুলুম ও নানা কুসংস্কারে নিমজ্জিত হয়েছিল ঠিক তখনই আল্লাহ তাআলা হিদায়াতের আলোকবর্তিকা হিসেবে পৃথিবীর বুকে পাঠিয়েছেন প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে। তিনিই সর্বপ্রথম পৃথিবীর বুকে এমন এক সভ্যতা স্থাপন করেছেন, যা চির সুন্দর, চিরসবুজ ও সমুজ্জ্বল আলোকধারায় উদ্ভাসিত। আল্লাহ তাআলা এর আগে হিদায়াতের জন্য প্রত্যেক জাতি-গোষ্ঠীর কাছে নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসুল পাঠিয়েছি এই মর্মে যে তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাগুত থেকে বেঁচে থাকো।

’ (সুরা নাহল, আয়াত : ৩৬)

মানবজাতির জন্য প্রিয় রাসুল (সা.)-এর শুভাগমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ। আল্লাহ তাআলা তাঁকে ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ বা বিশ্বজগতের রহমত হিসেবে এবং নবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম মর্যাদা দিয়েই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তাঁর মাধ্যমে সমাপ্ত হয়েছে রাসুল প্রেরণের ধারাবাহিকতা। নবীজি (সা.)-এর সৃষ্টি হয়েছে সবার আগে আর পিতা আবদুল্লাহর ঔরসে মা আমিনার গর্ভ হয়ে পৃথিবীতে শুভাগমন করেছেন নবীদের শেষে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, লোকেরা প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসুল, আপনার নবুয়ত কখন অবধারিত হয়েছে? জবাবে তিনি বলেন, যখন আদম (আ.) শরীর ও রুহের মধ্যে ছিলেন। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩৬০৯)

আল্লাহ তাআলা আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করে যখন (হে আবু মুহাম্মদ) বলে ইলহাম করলেন তখন তিনি বলেছেন, হে আল্লাহ, আপনি আমার কুনিয়াত ‘আবু মুহাম্মদ’ কেন রেখেছেন? এর জবাবে আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমার মাথা উত্তোলন করো। তিনি মাথা উত্তোলন করে আরশ এবং এর  চারপাশে রাসুল (সা.)-এর নুর মুবারক দেখতে পান। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এই নুর কার? জবাবে আল্লাহ তাআলা বলেন, এটি ওই নবীর নুর, যিনি তোমার সন্তানদের মধ্যে হবেন। তাঁর নাম আসমানে ‘আহমদ’ এবং জমিনে ‘মুহাম্মদ’ (সা.)। তিনি যদি না হতেন তবে আপনাকে সৃষ্টি করতাম না, আসমান আর জমিনও সৃষ্টি করতাম না। (ইমাম শিহাব উদ্দিন কাস্তালানি, আল মাওয়াহিবু লাদুনিয়া, ১/৫৭)

পবিত্র কোরআন মজিদে প্রায় ১০টি সুরার মধ্যে রাসুল (সা.)-এর শুভাগমন সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মানবজাতি, তোমাদের কাছে তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে (বোরহান) অকাট্য প্রমাণ এসেছে, আর আমি সমুজ্জ্বল আলোকময় নুর পাঠালাম। ’ (সুরা আন নিসা, আয়াত : ৪১)

তাফসিরে কবির, তাফসিরে রুহুল বয়ান প্রভৃতি তাফসির গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, বোরহান বা অকাট্য প্রমাণ বলে নবীজি (সা.)-কে বোঝানো হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘(হে হাবিব) আমি আপনাকে জগৎসমূহের প্রতি একমাত্র রহমতস্বরূপই প্রেরণ করেছি। ’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ১০৭)

আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, ‘আল্লাহ ঈমানদারদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন যে তাদের মাধ্য, তাদের নিজেদের মধ্য থেকে একজন রাসুল পাঠিয়েছেন। ’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৬৪)

প্রিয় রাসুল (সা.) ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সুবহে সাদিকের সময় পবিত্র মক্কা নগরীর কুরাইশ বংশের হাশেমি গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। ঐতিহাসিকরা তাঁর জন্ম ‘হাতির বছর’ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন।

রাসুল (সা.) এর শুভাগমনের আগে বিভিন্ন ঘটনা প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলোকে বলা হয় ‘ইরহাস’। ইরহাস অর্থ হলো বুনিয়াদ বা ভিত্তি। রাসুলে পাক (সা.)-এর নবুয়ত প্রকাশের আগে সাধারণ বিবেকবহির্ভূত ঘটনাগুলোকেই ইরহাস বলা হয়ে থাকে।

রাসুল (সা.)-এর শুভাগমনের ৫০ অথবা ৫৫ দিন আগের একটি ঘটনা হলো আসহাবে ফিল বা হাতির ঘটনা। পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থিত কাবাঘর আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অত্যন্ত বরকতমণ্ডিত ও মর্যাদাপূর্ণ একটি নিদর্শন।

আবিসিনিয়ার বাদশা নাজ্জাশির পক্ষ থেকে আবরাহা নামক এক ব্যক্তি ইয়ামেনের শাসক ছিল। সে দেখল প্রিয় নবী (সা.)-এর আম্মাজান যখন তাঁকে গর্ভে ধারণ করলেন তখন অগণিত আশ্চর্য ঘটনা প্রকাশ পেয়েছিল। এমনকি ৯ মাস পূর্ণ গর্ভকালীন তিনি কোনো কষ্ট অনুভব করেননি। মাতৃগর্ভে থাকাকালে মা আমিনা অনেক শুভ স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নযোগে তাঁকে নবীপাক (সা.)-এর পবিত্র নাম মুবারক বলে দেওয়া হয়। এমনকি এও বলা হয় যে হে আমিনা, তোমার গর্ভে আমানত আছেন দুই জাহানের সরদার ও সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

বহুদিন ধরে দুর্ভিক্ষ, অনাবৃষ্টি ও খাদ্যাভাবে আরবের সর্বত্রই হাহাকার চলছিল। নবীজি (সা.)-এর বরকতময় জন্মের বছর আরবের গাছপালা ফলে-ফুলে, পত্র-পল্লবে ভরপুর হয়ে ওঠে। দুর্ভিক্ষ কাটিয়ে আরবে এক শুভ দিগন্তের সূচনা হয়। আরবের ঘরে ঘরে আনন্দের ফল্গুধারা বইতে থাকে। যেহেতু এ বছর কুরাইশরা আবরাহার বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছিল এবং দুর্ভিক্ষ থেকে পরিত্রাণ পেয়েছিল, তাই নবীজি (সা.)-এর শুভজন্মের এ বছরকে তারা ‘সানাতুল ফাতহ ওয়াল ইবতিহাজ’ (বিজয় ও আনন্দের বছর) হিসেবে নামকরণ করেছিল।

ফাতিমা বিনতে আবদিল্লাহ (রা.) বলেন, যখন প্রিয় নবীজি (সা.)-এর শুভ আগমন ঘটল, তখন আমি আমিনার কাছে উপস্থিত ছিলাম। আমি দেখলাম সব গৃহ উজ্জ্বল আলোতে ভরে গেছে এবং এও দেখলাম, আসমানের তারকারাজি এত কাছে এসেছে যে আমার মনে হলো এই তারকা আমার ওপর পতিত হবে। (ফাতহুল বারি, ৬/৪২৬)

আমিনা আরো বলেন, আল্লাহ তাআলা ওই সময়ে আমার চোখের পর্দা উঠিয়ে নেন আমি পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিম প্রান্ত দেখতে পেলাম।

ইরবাস ইবনে সারিয়্যা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্ম গ্রহণকালীন তাঁর সময়ে তাঁর মাতা এক নুর দেখেন, যাতে সিরিয়ার প্রাসাদসমূহ আলোকিত হয়ে যায়। (ইমাম হাকেম, আল মুসতাদরাক, মেশকাত-৫৭৫৯)

আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমি তোমাদের আমার প্রাথমিক বিষয় সম্পর্কে বলছি। আমি হলাম ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়া ও ঈসা (আ.)-এর সুসংবাদ। আর আমার মায়ের স্বপ্ন, যা তিনি আমাকে প্রসব করার সময় দেখেছিলেন যে এমন এক নুর উদ্ভাসিত হয়েছে, যার দ্বারা আমার আম্মাজানের জন্য সিরিয়ার প্রাসাদও উজ্জ্বল হয়েছিল। (ইমাম বায়হাকি, দালায়েলুন নবুয়ত, পৃষ্ঠা ৩৫)

রাসুল (সা.)-এর শুভাগমনের সময় আশ্চর্য ঘটনার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে হাসসান বিন সাবেত (রা.) বলেন, আমি সাত বা আট বছরের শিশু ছিলাম, আমি যা দেখতাম এবং শুনতাম তা অনুধাবন করতে পারতাম। একদিন সকালে এক ইহুদি চিৎকার করে বলতে লাগল, হে ইহুদি সম্প্রদায়, তোমাদের জন্য ধ্বংসের কথা হলো যে আহমদ এর তারকা উদিত হয়েছে, আজ রাতেই তার শুভাগমন ঘটেছে।

আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, মক্কা শরিফে এক ইহুদি বাস করত। যে রাতে প্রিয় রাসুল (সা.) তাশরিফ এনেছিলেন তখন সে বলল, হে কুরাইশ দল, আজ রাতে কি তোমাদের কোনো শিশু জন্মগ্রহণ করেছে? তারা বলল, আমাদের জানা নেই। তখন সে বলল, দেখো, আজ এই উম্মতের নবী তাশরিফ এনেছেন। যাঁর দুই স্কন্দের মাঝে নবুয়তের চিহ্ন রয়েছে। তিনি দুই রাত পর্যন্ত দুধ পান করবেন না। লোকজন দ্রুত ওই সভা থেকে উঠে অনুসন্ধান শুরু করল। জানা গেল যে আবদুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের ঘরে একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। ইহুদি বলল, তোমরা আমাকে নিয়ে গিয়ে দেখাও। ইহুদি তার দুই বাহুর মাঝখানে ওই মোহরে নবুয়ত চিহ্ন দেখে  জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। জ্ঞান ফিরে আসার পর সে বলল, নবুয়ত বনি ইসরাঈল থেকে চলে গেছে। হে কুরাইশ সম্প্রদায়, শোনো, এই নবীর অসিলায় তোমাদের প্রভাব প্রতিপত্তি এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে তাঁর শুভাগমনের সংবাদ পৃথিবীর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে ছড়িয়ে পড়েছে। (ইমাম হাকেম, আল মুস্তাদরাক, হাদিস : ৪১৭৭)

প্রিয় নবী (সা.)-এর পূর্বপুরুষরা আপন সময়ের অত্যন্ত সৌভাগ্যবান, বিজ্ঞ ও সম্ভ্রান্ত ছিলেন। প্রিয় নবীজি (সা.)-এর দাদা, আব্দুল মুত্তালিবের অসিলা নিয়ে আরবের লোকেরা আল্লাহর কাছে দোয়াও করত। ইমাম শিহাব উদ্দিন কাস্তালানি (রহ.) বলেন, কুরাইশ গোত্রে যখন দুর্ভিক্ষ নেমে আসত তারা আবদুল মুত্তালিবের হাত ধরে ছবির পাহাড়ে নিয়ে যেত। তার উসিলা নিয়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করত এবং বৃষ্টির জন্য দোয়া করত। (আল মাওয়াহিবুল লাদুনিয়্যাহ, পৃষ্ঠা ১/৮৮)

লেখক : সিনিয়র শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা)

চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজ

 

 

কিউএনবি/আয়শা/০৩ অক্টোবর ২০২২,খ্রিস্টাব্দ/দুপুর ১২:২০

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

October 2025
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit