জীবন খাতার প্রতি পাতা- ৩
———————————
মোহনা’দি তাড়া দিলেন। দুপুর গড়িয়ে গেছে। খেয়ে নাও। আমি ফ্রেশ হয়ে খেতে বসলাম। বাসমতি চালের চিকেন বিরিয়ানি, সালাদ ইত্যাদি। লাঞ্চ শেষ করলে তিনি বললেন, তোমার জন্যে চুঁচড়ার একটা মিষ্টি আনিয়েছি। তুমি এরকম মিষ্টি জীবনেও খাওনি। মিষ্টির বাটিটা তিনি হাতে দিলেন। চামচ দিয়ে কেঁটে মুখে দিয়ে মনে হল, কেক ও ছানার সমন্বয়ে এই মিষ্টি। খেতে ভালোই লাগছে।
বিরিয়ানি,ডেজার্টের পর কফি দিয়ে শুরু হল আমাদের আলাপচারিতা। দিদিকে বললাম, আমি মান্নাদের কথা শুনতে চাই। তাঁর সঙ্গে আপনি অনেকদিন কাজ করেছেন। দিদি ড্রইংরুমে নিয়ে গিয়ে শুরু করলেন মান্নাদের কথা।
মান্নাদে খুব ভাবুক ও চুপচাপ একজন মানুষ ছিলেন। ব্যাক্তিত্বটাকে গুরুত্ব দিতেন। অযাচিত কারও সহযোগিতা বা অতিরঞ্জিত স্তুতিবাক্য পছন্দ করতেন না। কাজকে গুরুত্ব দিতেন বেশি। গান তাঁর কর্ম, তাঁর সাধনা ছিল।
মোহনাদি বললেন, মান্নাদেজি যেদিন কোন স্টেজ পারফর্ম করতেন অথবা গান রেকর্ডিং করতেন সেদিন তিনি অনুষ্ঠান বা রেকর্ডিং এর আগে কিছুই খেতেন না। সময়টা লম্বা হলে বড়জোর এক পেয়ালা ভেজিটেবল স্যুপ অথবা একটা ব্ল্যাক কফি খেতেন। অনুষ্ঠান শেষ হলে প্রচুর খেতেন। গল্প করতে করতে আর খেতে খেতেই রাত বারোটা বাজিয়ে ফেলতেন। খাওয়া শেষ হলে মান্নাদেজি একটা লম্বা ঘুম দিতেন। শান্তির ঘুম।
একজন স্পর্শকাতর মানুষ ছিলেন মান্নাদেজি। ৮৫ বছরের বৃদ্ধ তিনি, স্টেজে সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠছেন। কেউ একজন হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাঁর হাতটি ধরার জন্যে। তিনি ধমক লাগাতেন, আমি কি ফুরিয়ে গেছি ? আমি কি অচল হয়েছি ? আসলে তিনি কারও সাহায্য নিতে পছন্দ করতেন না।
আমি মোহনা’দিকে জিজ্ঞাসা করলাম কফি হাউজের ঘটনাটি কি ? গত ১০০ বৎসরের মধ্যে বিবিসি জনপ্রিয় ২০টি বাংলা গানের তালিকা করতে যেয়ে একটা জরিপ চালায় দুনিয়া ব্যাপী। জরিপে মান্নাদে’র ”কফি হাউজের সেই আড্ডাটি আজ আর নেই ” গানটি শীর্ষ অবস্থান লাভ করে। আমি শুনেছি, কোলকাতার বাসিন্দা হয়েও কোলকাতার এই প্রসিদ্ধ কফি হাউজে তিনি নাকি কোনোদিনই যাননি। কারণ কি ?
মোহনা গঙ্গোপাধ্যায় হেসে জবাব দিলেন, এ বিষয়টি আমি নিজেও একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি যা বলেছেন সেটা তাঁর ভিন্নতর চরিত্রেরই প্রকাশ। আগেই বলেছিলাম মান্নাদেজি একজন স্পর্শ কাতর মানুষ ছিলেন। তিনি কফি হাউজে কোনোদিনই যাননি তার কারণ বলার আগে একটু এই গানটির ইতিহাস বলছি। মন দিয়ে শোন।
‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত বাংলা সঙ্গীত। স্মৃতিচারণী এই সঙ্গীত বা গানটি ১৯৮৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত। গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের লেখা ও সুপর্ণকান্ত ঘোষের সুরে এই গানে কন্ঠ দেন মান্না দে।
১৯৮৩ সালের দিকে, গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার অনেক জনপ্রিয় প্রেমের গান লিখে ফেলেছেন, কিন্তু তখনো তিনি মান্না দের জন্য গান লিখেনি। কারন, ঔ সময় মান্না দের জন্য কেবল পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় গান লিখতেন। গীতিকার গৌরী প্রসন্নের মনে মান্না দের জন্য পূজার গান লেখার ইচ্ছা ছিল। সেই সময় নচিকেতা ঘোষ ও গৌরী প্রসন্ন মজুমদার বাংলা সংগীতের সেরা সুরকার-গীতিকার জুটি হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন।
কিছুদিন পর গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার, শক্তি ঠাকুরকে দিয়ে একটি গানে কন্ঠদানের জন্য একদিন নচিকেতা ঘোষের নিউ আলিপুরের বাড়িতে গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যকার সম্পর্কও ছিল বেশ মুধুর, সেই সূত্রে নচিকেতার ছেলে সুপর্ণকান্তির সঙ্গেও গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের বেশ ভাল সম্পর্ক ছিল। গৌরী প্রসন্ন, নচিকেতার বাড়িতে আসার বেশ অনেকক্ষণ পরে নচিকেতার ছেলে সুপর্ণকান্তির সাথে সাক্ষাত হওয়াতে গৌরী প্রসন্ন মজুমদার অনেকটা মজা করেই সুপর্ণকান্তিকে বলেন, কী বাইরে আড্ডা মেরেই সময় কাটাচ্ছ বুঝি? উত্তরে সুপর্ণকান্তি তার গৌরী কাকাকে বলেন, কী সব গদগদে প্রেমের গান লিখছো একটা অন্যরকম গান লিখে দেখাও না, এই আড্ডা নিয়েও তো গান লিখতে পারো।
জবাবে গৌরী প্রসন্ন বলেন, তুমি (সুপর্ণকান্তি) তো বিশ্ববিখ্যাত অক্সফোর্ড থেকে এমএ লাভ করেছো। তুমি আড্ডা নিয়ে কি আর বাংলা গান গাইবে? সুপর্ণ এবার বলে, কেন নয়। কফি হাউসের আড্ডা নিয়েও তো একটা গান লিখতে পারো। গৌরী প্রসন্ন বলেন, লিখলে তোমার বাবা (নচিকেতা ঘোষ) কি সে গান গাইবেন? তাদের দুজনের কথারবার্তার ফাঁকেই গৌরী প্রসন্ন মনে মনে তৈরি করে ফেলেন গানের দুটি লাইন।
এরপর সুপর্ণকান্তিকে বলেন, আচ্ছা তাহলে লিখে নাও – কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই / কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই। সুপর্ণও সঙ্গে সঙ্গে সেই গানের দুটো লাইনেই সুর দিয়ে শুনিয়ে দেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত শক্তি ঠাকুর গানটি সুপর্ণকে সেবার পূজায় গানটা গাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন কিন্তু সুপর্ণ তাতে রাজি হননি। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক করে নিয়েছিলেন যে গানটি মান্নাদে কে দিয়ে গাইবার কথা।
কিন্তু গানের বাকি লাইনগুলো তখনো অসম্পূর্ণ ছিল, পরের দিন সকালেই গৌরী প্রসন্নের স্ত্রী সুপর্ণকান্তিকে ফোন দিয়ে জানান যে, বহুদিন পরে সারা রাত জেগে অসুস্থ গৌরী প্রসন্ন গান লিখেছেন। ঐ সময় তখন গৌরী প্রসন্ন ক্যান্সারেও আক্রান্ত ছিলেন। দু’দিন পরে গৌরী প্রসন্ন গানটা প্রস্তুত করে নিয়ে হাজির হয়। কিন্তু গৌরী প্রসন্ন শেষ স্তবক যোগ করার পক্ষপাতী ছিলেন না। কিন্তু সুপর্ণকান্তির ইচ্ছাতেই শেষ পর্যন্ত গৌরী প্রসন্ন আরও একটি স্তবক যোগ করতে রাজি হন। এরপর দুর্দান্ত সেই লাইন লেখেন- সেই সাতজন নেই, তবুও টেবিলটা আজও আছে। কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে তিনি(গৌরী প্রসন্ন) শেষ তিনটি লাইন তিনি লিখেছিলেন চেন্নাইয়ে চিকিৎসা করাতে যাওয়ার পথে হাওড়া স্টেশনে বসে একটি সিগারেটের প্যাকেটের উল্টো পিঠের খালি সাদা অংশে করে। যা একজন পরিচিত লোকের মাধ্যমে তা সুপর্ণকান্তির কাছে পাঠিয়ে দেন। তারপর সুপর্ণকান্তির গানটিতে সুরকরে মুম্বইয়ে মান্না দে কে দিয়ে গানটি রেকর্ড করান। যে গান তৈরি হয়ে যায় বাংলা গানের একটি ইতিহাস।
একটা গানের পিছনে কত ইতিহাস থাকে। মোহনা’দি আমাকে একটানে নিয়ে গিয়েছেন ৮৩ সালে। আমি যখন এস এস সি পরীক্ষা দেই। এবারে দিদি বললেন, মান্নাদের কফি হাউজে না যাওয়ার সেই কাহিনী।
এই গানটি গাওয়ার আগে মান্নাদে নিজের মস্তিষ্কে কফি হাউজের একটি চিত্র তৈরী করেছিলেন। টেবিলের কোথায় কিভাবে কে বসে আড্ডা দিয়েছেন তার একটি আবহ সৃষ্টি করেছিলেন মগজের ভিতরে। গানের চরিত্র নিখিলেশ, গীটারিস্ট গোয়ানীস ডিসুজা, রমা রায়, অমল, সুজাতা, মঈদুলের অবয়ব তিনি সৃষ্টি করেছিলেন অন্তরে। এই আবহ, এই অবয়ব, এই চরিত্রগুলোকে মান্নাদের মানসপট থেকে মুছে দিতে অথবা বিভ্রান্তিতে ফেলে দিতে যাতে না হয় এই জন্যে তিনি বাস্তবের কফি হাউজে কোনোদিনই যাননি। তিনি কফি হাউজে যাবেন আর তাঁর ভাবনার পরিবেশের মিল পাবেন না, তা কি করে হয় ?
ছবিঃ ১. মোহনা গঙ্গোপাধ্যায় ও আমি ২. মান্নাদে ৩. কলকাতার কফি হাউজ। ৪. মোহনা দি, ও মান্নাদে’র সংগীত সন্ধ্যা । কলকাতার কফি হাউজ। ৪. মোহনা দি, ও মান্নাদে’র সংগীত সন্ধ্যা ।
লেখকঃ লুৎফর রহমান। রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট।
কিউএনবি/বিপুল/২৫.০৭.২০২২/রাত ১১.২৯