আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ঋতুর মতো চক্রাকারে চলে ভূ-রাজনীতি। রূপকঅর্থে ঋতু যেমন প্রকৃতির পরিবর্তনকে চিত্রিত করে, তেমনি ভূ-রাজনীতিও ভবিষ্যতের অনুমান এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে আসন্ন পরিবর্তনের প্রতিনিধিত্ব করে। গত কয়েক মাসে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ছয়টি দেশে বোমা হামলা করা হয়েছে। লঙ্ঘিত হয়েছে দেশগুলোর সার্বভৌমত্ব। এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জ্ঞাতসারেই ঘটেছে এই সব হামলার ঘটনা।
কাতারে ইসরায়েলের বোমা হামলার পর সৌদি আরব ইসরায়েলের দ্বারা হুমকি অনুভব করতে পারে, কিন্তু ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ তৈরির মহাপরিকল্পনার দিকে যদি কেউ তাকায় তাহলে দেখা যাবে, দেশটির দুর্বল প্রতিবেশী দেশগুলো হয়ে উঠবে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান এবং মিশর এই ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।
যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তার জন্য একটি বিকল্প পরিকল্পনা নিয়ে আসে, তখন সৌদি আরব মাথা নাড়িয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে আরও ভালো সম্পর্ক স্থাপনের কথা বিবেচনা করে। ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্যের যে বিকল্প পরিকল্পনায় আঞ্চলিক নিরাপত্তার ধারণা তৈরি করা হয়েছিল তা ছিল ইরানকে বিচ্ছিন্ন করার পক্ষে। এই পরিকল্পনায় যুদ্ধের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়নি। অবশেষে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে ১২ দিনের যুদ্ধ (১৩-২৪ জুন ২০২৫) প্রত্যক্ষ করে বিশ্ব। এই যুদ্ধের আগে ট্রাম্প প্রশাসন আব্রাহাম চুক্তির মধ্যস্থতায় সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব এবং ইসরায়েলের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সামরিক ও গোয়েন্দা সমন্বয় সাধন করে, যা পরে মরক্কো এবং সুদানেও প্রসারিত হয়।
স্যার আলফ্রেড ম্যাকিন্ডারের হার্টল্যান্ড তত্ত্ব অথবা নিকোলাস স্পাইকম্যানের রিমল্যান্ড তত্ত্বের বিবরণ তুলে ধরতে চাই না, তবে অনেক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক স্কলারের মতামত টেনে এটা বলা সঙ্গত হবে যে, ইরানই প্রকৃতঅর্থে হার্টল্যান্ড ও রিমল্যান্ডের মিলনস্থল। ১২ দিনের যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রকে হুমকি দিয়েছিল ইরান, এমনকি দোহায় বোমাও ফেলেছিল। যদি ইরানে আবার আক্রমণ করা হয় এবং ইরান আমেরিকান ঘাঁটি স্থাপনের জন্য কাতার, বাহরাইন বা সৌদি আরবকে আক্রমণ করে প্রতিশোধ নেয়, তাহলে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া কী হবে? ন্যাটো চুক্তির অনুচ্ছেদ ৫-এর শর্ত ন্যাটো চুক্তির ৫ নম্বর ধারায় উল্লেখিত শর্তের কথা বিবেচনা করলে কি সৌদি আরবের সাহায্য পাওয়া যাবে? যেখানে বলা হয়েছে, ‘একজনের ওপর আক্রমণ অন্যজনের ওপর আক্রমণ হিসাবে বিবেচিত হবে’।
২০২৩ সালে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে বেইজিং একটি শান্তি চুক্তির মধ্যস্থতা করে ওয়াশিংটনের মধ্যপ্রাচ্য পরিকল্পনায় ঠান্ডা জল ঢেলে দেয়। এই চুক্তি নিশ্চিত করে, ইরান আর ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের সামরিক সহায়তা প্রদান করবে না। সেকারণে সৌদি আরব ও ইরান উভয়ই ইয়েমেনে যুদ্ধবিরতি বজায় রেখেছে যা আজ পর্যন্ত বহাল রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের হতাশাজনক কর্মকাণ্ডে একটি নতুন আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামো এখন রূপ নিচ্ছে।
সৌদি আরবের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা চুক্তি এই নতুন নিরাপত্তা কাঠামোর শৃঙ্খলের একটি সংযোগ। কৌশলগত ও নিরাপত্তা অগ্রাধিকারগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এবং মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমহ্রাসমান প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষেত্রে বেইজিং নেতৃত্ব দেয়। ইরান চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ককে ঝুঁকিতে ফেলতে চাইবে না। পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনীতির মৌসুমে উদীয়মান শক্তি হিসেবে চীন মধ্যপ্রাচ্যে নতুন নিরাপত্তা কাঠামো নির্মাণে ইরানের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে।
মধ্যপ্রাচ্যে চীন-বিরোধী এবং ইরান-বিরোধী নিয়ন্ত্রণমূলক জোট গঠনের চেষ্টা আমেরিকার বিপরীতমুখী কৌশল। এর কারণ হল গাজায় চলমান ইসরায়েলি গণহত্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পেয়েছে। ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো মনে করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের মধ্যপ্রাচ্য নীতি আঞ্চলিক ভাঙনে বড় প্রভাবকের ভূমিকা রাখবে। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের সম্ভাবনাই উজ্জ্বল হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে পাক-সৌদি প্রতিরক্ষা চুক্তি সেই শৃঙ্খলের যোগসূত্র, যা মার্কিন এই নীতিকে ভেঙে ফেলতে এবং শেকল পড়াতে পারে।
কিউএনবি/আয়শা/২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, /রাত ১১:৫০