আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ফিলিস্তিনের সমস্যা কখনো একটি দেশের দুর্ঘটনা নয়, এটি ইতিহাসের, বিশ্বাসের, মানবতার এমন এক গভীর উপাখ্যান যা মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ে প্রলিপ্ত রক্ত এবং অশ্রু ধরে রেখেছে। দিনের আলো যখন গাজার ধ্বংসস্তূপ, সন্নিহিত মৃতদেহ আর ধুলোয় ঢেকে যাওয়া আশ্রয় খুঁজে পাওয়া যায়, তখন স্মরণ হয় যে এই ক্ষত শুধু ফিলিস্তিনিদের নয়, সমগ্র মুসলিম জাতির। শান্তি, ন্যায় ও মর্যাদার প্রশ্ন হয়ে উঠেছে অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ, আন্তর্জাতিক বাণী ও রাজনৈতিক স্বার্থের মুখোমুখি।
ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে, ১৯৪৮-এর “নাকবা” ফিলিস্তিনিদের ঠেলে দিয়েছিল এক নতুন বাস্তবতায় স্বপ্নের অধিকার, ভূমি, ঘরবাড়ি, পরিবার, শান্তিপূর্ণ জীবনের অধিকার সবকিছু হারিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরাইলের দখলদারিত্ব পশ্চিম তীর, গাজা ও পূর্ব জেরুজালেমে গড়ে তোলে বিশাল শৃঙ্খল, যেখানে প্রতিদিন বাড়তে থাকে মানবিক সংকট।
শান্তি আলোচনার কয়েকটি চুক্তি হলেও বসতি বিস্তার, নিরাপত্তা অবরোধ ও সামরিক শক্তি প্রয়োগের কারণে সেগুলো ব্যর্থ হয়। ফলে বন্দী জীবন, আর্তনাদ ও ধ্বংসের শব্দ ফিলিস্তিনিদের প্রতিদিনের অংশে পরিণত হয়েছে। বিগত প্রায় দুই বছরের সংঘাতে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে নিহতের সংখ্যা ৬০,০০০+, আহত প্রায় ১,৪৫,৮৭০+, যেখানে অনেকের নাম প্রাথমিকভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়নি ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া মৃতদেহ বা ক্ষয়ক্ষতির কারণে।
উপরন্তু, ‘দ্য ল্যানসেট’-এর এক সমীক্ষা দেখিয়েছে যে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা সরকারের হিসাবের চেয়ে প্রায় ৪০–৪১ শতাংশ বেশি হতে পারে। কারণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হাসপাতাল, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা ও মৃতদেহ হাসপাতাল পর্যন্ত না পৌঁছানো—সবই হিসাবকে অসম্পূর্ণ রেখেছে।
মেয়েরা, শিশু ও বৃদ্ধরাই আঘাতপ্রাপ্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ‘দ্য ল্যানসেট’-এর বিশ্লেষণ দেখিয়েছে, মৃতদের মধ্যে নারীরা প্রায় ২০ শতাংশ এবং শিশু ও বৃদ্ধরা একটি বিশাল অংশ। গাজার হাসপাতালগুলো তখন প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত, চিকিৎসা সামগ্রী ও ওষুধের অভাব, রক্তের সংকট, বিদ্যুৎ ও পানির স্বল্পতা—সবকিছু মিলে জীবন হয়ে উঠেছে এক অবর্ণনীয় পারিপার্শ্বিক চাপে।
এই মৃত্যু ও ধ্বংস শুধু সংখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়। গাজার শিশুদের খেলনা-ছুটে যাওয়া মাঠ, অচল মাদ্রাসার ভাঙা দরজায় বসে থাকা বৃদ্ধের প্রার্থনা, আশ্রয়ভ্রষ্ট পরিবারের মায়ের ছটফট সব মিলে ফিলিস্তিনের প্রতিদিনের ছবিকে রূপ দিয়েছে যন্ত্রণার শিল্পকর্মে। অথচ এই যন্ত্রণার ছবি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ফুটে উঠলেও, তা অনেক সময় হঠাৎ এক সংবাদ, এক চুক্তি বা এক বিবৃতির সীমায় আটকে যায়।
এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক নৈতিক ও কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া এসেছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত ঘোষণায় দু’রাষ্ট্র সমাধানের আওতায় ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি ও পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করার আহ্বান জানানো হয় যা বিশ্বের বহু দেশের জনমতের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে শান্তি আলোচনার প্রতিশ্রুতি থাকলেও বাস্তবে এই ঘোষণা কতটা ন্যায় প্রতিষ্ঠায় কার্যকর হবে, তা সময়ই প্রমাণ করবে।
সমাধান যদি কেবল রাজনৈতিক ব্যঞ্জনায় সীমাবদ্ধ থাকে, তবে ফিলিস্তিনের ক্ষত কোনোদিন সইবে না। শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র গঠন সম্ভব হবে তখনই, যখন পুরনো বসতি ব্যবস্থা ও অবৈধ দখলদারিত্ব আন্তর্জাতিক আইন ও শান্তি চুক্তির আলোকে প্রত্যাহার করা হবে।
মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর উচিত বিভক্তির ফাঁক পেরিয়ে মানবিক ও কূটনৈতিক ঐক্য গঠন করা। আন্তর্জাতিক কূটনীতি, আদালত ও মানবাধিকার সংগঠনের কাছে ফিলিস্তিনিদের দাবিকে কেবল কথায় নয়, কার্যকরভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন।
মানবিক বিপর্যয়ের মঞ্চে—যেখানে শিশুদের কোল থেকে দুধ ফুরায়, যেখানে খাবার ও ওষুধের অভাব, যেখানে আশ্রয় কেবল ধুলো ও স্মৃতি—সেখানে সমাধানের পথ মানবতার নৈতিকতার ভেতর দিয়েই বেরিয়ে আসবে। সাংবাদিক, দাতা, সংগ্রামী জনতা এবং সাধারণ মানুষ সবাইকে মিলে একটি বিশ্বজনমত তৈরি করতে হবে, যা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সমবেত আওয়াজ তুলবে।
এই বিষয়টি কেবল একটি প্রবন্ধ নয়, এটি এক গভীর আহ্বান। ফিলিস্তিনের মাটিতে ন্যায়ের বিজয় হলেই আসবে শান্তি, পুরনো ধ্বংসস্তূপ হবে মুক্তির দ্বার। ফিলিস্তিন শুধু একটি রাষ্ট্র নয়, এটি বিশ্বাস, আশা ও ন্যায়ের প্রতীক। তার ক্ষত সারাতে যারা এগিয়ে আসবেন, তারা শুধু ফিলিস্তিনিদের নয়, সমগ্র মুসলিম উম্মাহর মর্যাদা উদ্ধার করবেন।
তথ্যসূত্র, এপি নিউজ, রয়টার্স
লেখক: শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর
কিউএনবি/আয়শা/২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, /বিকাল ৪:৫৫