রবিবার, ০৩ অগাস্ট ২০২৫, ০৮:১০ অপরাহ্ন

রাখাইন করিডোর: মানবিকতার আড়ালে ক্ষমতার লড়াই

Reporter Name
  • Update Time : রবিবার, ৩ আগস্ট, ২০২৫
  • ১০ Time View

ডেস্ক নিউজ : গত কয়েক বছর টালমাটাল সময় পার করছে বিশ্বরাজনীতি। এমন টলোমলো ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দ্রুত বদলে গিয়েছে রাজনৈতিক সমীকরণ। রাখাইন করিডোর বিশ্বরাজনীতির আঞ্চলিক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। উত্তর রাখাইনে ত্রাণ পৌঁছাবে এই করিডোর চালুর কথা বলা হলেও এর পেছনে রয়েছে অনেক গভীর কৌশল। রাখাইন রাজ্যের অধিকাংশ ভ‚মির নিয়ন্ত্রণ আরাকান আর্মির হাতে তারা মিয়ানমারের একটি বড় অংশে প্রভাব বিস্তার করছে। এতে এই করিডোর ঘিরে চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা বেড়েছে। ফলে বাংলাদেশের অবস্থান জটিল হয়ে উঠেছে।

করিডোর ও প্রভাব বিস্তার:নামে মানবিক করিডোর যেখানে জনসমক্ষে ত্রাণ সহায়তার রুট হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। অথচ এর মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের পথে নেমেছে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। মানবিকবিশ্বে স্পষ্ট হয়েছে, উত্তর রাখাইনে বিশ লাখের অধিক মানুষ দুর্ভিক্ষ, সংঘাত ও বাস্তুচ্যুতির ঝুঁকিতে আছে। দুর্বল জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস কক্সবাজার সফরে যুক্তরাষ্ট্রের ত্রাণ কমানোকে ‘অপরাধ’ বলেও অভিহিত করেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, নামকায়স্ত মানবিক এই করিডোর শুধু মানবিক সহায়তা নয়, বরং বঙ্গোপসাগরের গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক রুটে পশ্চিমা প্রভাব বিস্তারের একটি কৌশলগত ষড়যন্ত্র।

অকস্মাৎ জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের প্রস্তাবিত এই করিডোর জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। জটিল সময় পার করছে প্রিয় মাতৃভ‚মি বাংলাদেশ। দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে ফ্যাস্টিট সরকারের বিদায় করেছে ছাত্রসমাজ আর জাতীয়তাবাদী আদর্শসহ ইসলামী ঘরানার রাজনৈতিক নেতৃবিন্দ। দেশ মাতৃকার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এখনও চলমান। সাবধানতার সাথে প্রতিটি ক্ষণ পার করতে হচ্ছে। ভ‚রাজনীতির এমন জটিল সময়ে দেশের সামরিক শক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকার অংশীদার। তাই দেশের সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। দেশের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এটিকে ‘রক্তাক্ত করিডোর’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি এও বলেন, এটি দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে। এই করিডোর পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য চীনের আশেপাশের অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের একটি সুযোগ হয়ে উঠতে পারে।

অভ্যন্তরীণ দ্বিধাদ্বন্ধে বাংলাদেশ : কিছুটা মনে হয়েছে যে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক চাপের মুখে এই করিডোরে আগ্রহ দেখাচ্ছেÑ যে করিডোরকে ঘিরে নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। কেননা সর্বসাকুল্যে ড. খলিলুর রহমানের কথাবার্তা স্পষ্ট হয় উঠেনিÑ যিনি দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও রোহিঙ্গা সমস্যা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ। তাছাড়া এমন কোনো নজির নেই, যেখানে তিনি আরাকান (রাখাইন) কিংবা রোহিঙ্গা সম্পর্কিত বিষয়ে দেশের সত্যিকারের গবেষকদের সাথে আলোচনা করেছেন। তবে দেশের সেনাবাহিনী এটিকে ‘কৌশলগত ফাঁদ’ হিসেবে দেখছে। 

অবশ্য ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সেনাপ্রধানের বক্তব্য ড. ইউনূসের অবস্থান দুর্বল করছে। যদিও নোবেলজয়ী ড. ইউনূস ২০২৬ সালে দেশের জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য মাস সম্পর্কিত সময়ের কথা বলেছেন। সেনা ও বেসামরিক প্রশাসনের মধ্যে এই মতবিরোধ হঠাৎ তৈরি হয়নি। বিশেষ বিবেচনায় দেখা যাচ্ছে যে, এটি ১৯৮০ দশকের পাকিস্তানের অবস্থার সাথে তুলনাযোগ্যÑ সেসময় মার্কিন মদতে আফগান মুজাহিদিনদের সমর্থন করতে গিয়ে পাকিস্তান দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। প্রিয় ভ‚মি বাংলাদেশও একই পথে না হাঁটে, এখানেই গর্বিত সেনাবাহিনীর উদ্বেগ।  

চীন, ভারত উদ্বেগ, কৌশল ও নিরবতা : বাংলাদেশ হয়ে রাখাইন করিডোরের প্রতি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র চীনের মনোভাব স্পষ্টতই নেতিবাচক। কেননা, কিছুদিন আগে দক্ষিণ রাখাইনে কিয়াকফিউ বন্দরের মাধ্যমে চীন একটি স্থল-সমুদ্র করিডোর গড়ে তুলছেÑ যা মালাক্কা প্রণালীকে বাইপাস করে। মানবিক নামদারি বাংলাদেশের টেকনাফ হয়ে রাখাইনে প্রবেশ করা এই করিডোরে পশ্চিমা হস্তক্ষেপ চীনের কৌশলকে বাধাগ্রস্ত করবে। দীর্ঘদিন থেকে চীনা সরকার মিয়ানমারের সরকার বিশেষ করে সেনা সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এমনকি আরাকান আর্মির মতো গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গেও চীনের পরোক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। ফলে, মানবিক করিডোরের নামে আরাকান আর্মির ক্ষমতা বাড়ানো চীন সহ্য করতে পারবে না।

অপরদিকে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ। কিন্তু রাখাইন বিষয়ে তার অবস্থান চীনের দিকে। ভারত মিয়ানমারের ‘কালাদান প্রকল্পে’ বিপুল বিনিয়োগ করেছেÑ উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধিতে রাখাইনের স্থিতিশীলতায়। এজন্যেই পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অতিরঞ্জিত সক্রিয়তা এতদঅঞ্চলে ভারত মানতে পারবে না। ফলে, ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা জেনারেল ওয়াকারের দৃষ্টিভঙ্গিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন। আরাকান আর্মির সাথে ভারতের অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ রয়েছেÑ বিশেষত মিজোরামে। যদিও প্রকাশ্যে তারা কোনো পক্ষ নেয়নি, বরং নরম সহায়তা ও ক‚টনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান নির্ধারণ করছে।

আরাকান আর্মি কতটা ঝুঁকি : সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি রাখাইনের প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছেÑ যেখানে অনেক সীমান্তবর্তী শহর রয়েছে। এমন বিজয়ের প্রভাব তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ফলে আসতে পারে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিÑ যা মিয়ানমারের আঞ্চলিক অখÐতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। এমন পরিস্থিতির উদ্ভব দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য বড় ক‚টনৈতিক ঝুঁকি। কারণ, নামকায়স্ত মানবিক করিডোরের ভেতর দিয়ে তারা সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে জড়িয়ে পড়তে পারে। অতঃপর  চীন ও মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন বাড়তে পারে।

ভারসাম্য ও ঝুঁকি : নি:সন্দেহে বলা যায়, রাখাইন করিডোরকে ঘিরে উদ্ভত নাজুক পরিস্থিতি আগামীর ভ‚রাজনীতিকে ঘোলাটে করবেÑ যা ভবিষ্যতের বড় সংঘাতের ইঙ্গিত। জাতিসংঘ ও মানবিক কিংবা জঙ্গি ও মিথ বিশ্বরাজনীতির ভারসাম্য ধ্বংস করেছে। এহেন অস্থির সময়ে মানবিক সহায়তা একটি বড় কৌশলগত ইস্যুতে রূপ নিয়েছে। দেশের সেনাবাহিনী এই করিডোরকে ‘ফাঁদ’ হিসেবে দেখে এবং চীন এতে হস্তক্ষেপের বার্তা দিচ্ছে। ধর্মান্ধ ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী সরকার এই অবস্থাকে নিজের শর্তে সামলাতে চাইছে, আর আরাকান আর্মি নিজ স্বার্থে এই করিডোরকে বিশ্ব রাজনীতিতে প্রবেশ করাচ্ছে। দুরন্ধর যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে কোনো তৎপরতাা দেখাচ্ছে না। এরা ২০২২ সালের বার্মা আইন এবং সা¤প্রতিক নীতিগত সহায়তা করিডোর পরিকল্পনার আড়ালের পরিকল্পিত স্থির কৌশলকে স্পষ্ট করে তুলছে।

আগামী কয়েক মাস বাংলাদেশের রাজনীতি নানাভাবে বাঁক নিতে পারে। অগ্নিরূপ নিতে পারে জনজীবন। যদিও আমরা বিশ্বাস করি, দেশের আকাশে অন্ধকারের মেঘ আর ঝেঁকে বসবে না। তবুও ঘটনাপ্রবাহ দীর্ঘ মেয়াদে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের ভ‚-রাজনৈতিক চিত্র নির্ধারণ করবে। কোন কারণে বাংলাদেশ করিডোর বাস্তবায়নে এগোয়, তাহলে গর্বিত সেনাবাহিনী ও সাধারণ জনগণ এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখাবেইÑ যা দেশের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে যথেষ্ট। এমন পরিস্থিতি ভোটের রাজনীতি বিলম্ব ঘটাবে। আবার চ‚ড়ান্তভাবে করিডোর প্রত্যাখ্যান করা হলে, ভারত ও চীনের সঙ্গে একটি অনানুষ্ঠানিক জোট তৈরি হতে পারেÑ যারা করিডোর প্রতিহত করতে সক্রিয় ভূমিকা নেবে। যদিও ভারতের সঙ্গে আমাদের বেড়েছে দূরত্বÑ কেননা, তারা ফ্যাস্টিট পক্ষকে নিয়ে বাঁচতে এদেশের রাজনীতি ঘোলাটে করেছে এবং আগামীতেও করতে চায়।

ভারতীয় সরকার জেনারেল ওয়াকারকে সমর্থন মানে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বাড়িয়ে মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ আলোচনায় অংশ নেওয়া। করিডোরের ব্যর্থতা দাঁড়িয়ে যাওয়া মানে চীনের কৌশলগত করিডোর সুরক্ষিত হওয়া এবং আমেরিকান বলয়ের ইউরোপীয় সা¤্রাজ্যের প্রভাব হ্রাস। রাখাইন করিডোর কোনভাবেই একটি ত্রাণপথ নয়। এটি রক্তাক্ত জীবনের ওপর দাঁড়িয়ে মাজলুম জনগণকে নিয়ে খেলা করার ঘৃণ্য কর্মকৌশল। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার একটি প্রতিফলন হলো মানবিক করিডোর। এই প্রতিযোগিতা অস্ত্রের নিশানায় নিয়েছে ৫০ লাখ জনগোষ্ঠীকে ১৮ কোটি জনতার কাঁধে বসে। যেখানে অস্ত্র নয়, বরং রসদ ও অবকাঠামোর মাধ্যমে পরিচালিত হবে যুদ্ধের রণকৌশল। এমন রণকৌশলে গাজার ২৪ লাখ নিরীহ মানুষ অনাহারে মারা যাচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি সংকটপূর্ণ সিদ্ধান্তের সময়। করিডোর নিয়ে ভাবতে হবে। এমন রণকৌশলে রোহিঙ্গা বিষয়ক পারদর্শীদের কথা শুনতে হবে। এইদেশের জনগণই নির্ধারণ করবে স্বাধীনভাবে পথ চলবে, না-কি অন্যদের কৌশলগত রাজত্বে নিজেকে মঞ্চ বানাবে। সময় নির্ধারণ করবে কে নিয়ন্ত্রণ করবে ভারত মহাসাগরে প্রবেশাধিকার? রক্তাত্ব পথ মাড়িয়ে না-কি বুদ্ধির কৌশলী চালে পতাকা উড়বে রাখাইনের বন্দরগুলোয়? 

লেখক : আসাদ পারভেজ

 

 

কিউএনবি/আয়শা/৩ আগস্ট ২০২৫/সন্ধ্যা ৬:০০

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

August 2025
M T W T F S S
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
262728293031  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit