শনিবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০৮ অপরাহ্ন

পাহাড়বাসীকে অর্থনৈতিক মুক্তির পথ দেখাচ্ছে কপি ও কাজুবাদাম

আলমগীর মানিক, রাঙামাটি প্রতিনিধি
  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই, ২০২৫
  • ৯৭ Time View

আলমগীর মানিক, রাঙামাটি প্রতিনিধি : পাহাড়ে পরিবেশ ধ্বংসকারি সেগুনের পরিবর্তে কপি ও কাজুবাদাম চাষকে লাভজনক বিবেচনা করে কপি ও কাজুবাদাম চাষকে প্রাধান্য দিচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ইতিমধ্যেই মন্ত্রণালয়ের অধিভূক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডসহ পার্বত্য তিন জেলা পরিষদ ও স্থানীয় কৃষি বিভাগকে পাহাড়ের কৃষকদেরকে কপি ও কাজুবাদাম চাষের আওতায় আনার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দিয়েছে মন্ত্রণালয়।

সম্প্রতি প্রতিবেদকের সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত সুপ্রদীপ চাকমা জানিয়েছেন, অনগ্রসর পাহাড়বাসীদের ভূপ্রকৃতি রক্ষাসহ তাদের আর্তসামাজিক উন্নয়নে পার্বত্যাঞ্চলে তিনি জানান, সম্প্রতি পাহাড়ে কপি-কাজু বাদাম গাছ লাগানোর ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এই লক্ষ্যে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের অধীন উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা পরিষদগুলোসহ স্থানীয় কৃষি অফিসগুলোর মাধ্যমে পাহাড়ের কৃষকদের কপি-কাজুবাদামের চারা বিতরণসহ এই কপি-কাজুবাদাম বিষয়ে স্থানীয় কৃষক-কৃষানীদের ব্যাপকভিত্তিতে প্রশিক্ষণ ও মতবিনিময় করার নির্দেশনা দিয়েছি।

পার্বত্য উপদেষ্টা বলেন, কপি-কাজুবাদাম শুধুমাত্র এক বছরের জন্য নয়; এটি একবার শুরু করলে আগামী অন্তত ৪০/৫০ বছর লাগাতার অর্থনৈতিক সাপোর্ট দিবে। এতে করে আমাদের প্রার্ন্তিক জনগোষ্ঠি খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যেই তাদের অর্থনৈতিক সম্মৃদ্ধশীলতায় পৌছাবে। তিনি বলেন, সিলেটকে যেমনিভাবে চা-পাতার দেশ হিসেবে সারাবিশ^ চিনে; তেমনিভাবে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামকে কপি-কাজু বাদামের এলাকা হিসেবে সারাবিশ্বে পরিচিত করে তুলতে চাই।

জানাগেছে, দেশের ১৮০০ হেক্টর জমিতে ২০২১-এর জুন মাসে কপি-কাজু বাদাম চাষ প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রকল্পের শুরুতে কাজুবাদাম চাষ হতো। প্রকল্প কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে বর্তমানে প্রায় ৪২০০ হেক্টর জমিতে কাজুবাদাম চাষ হচ্ছে। সেইসঙ্গে কফি চাষ ৬৫ হেক্টর থেকে বেড়ে ১৮০০ হেক্টরে উন্নীত হয়েছে। পাহাড়ে বর্তমানে উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলার ১২ উপজেলায় প্রায় ২ হাজার কপি ও কাজুবাদামের বাগান সৃজন করা হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের কপি ও কাজু বাদাম চাষের মাধ্যমে দারিদ্র হ্রাসকরণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা কৃষিবিদ মোঃ জসিম উদ্দিন জানিয়েছেন, পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রামের অনাবাদি জমিতে কাজুবাদাম ও কফি চাষ সম্প্রসারিত প্রকল্প কার্যক্রম পরিচালনা করছে উন্নয়ন বোর্ড। পার্বত্য অঞ্চলে কাজুবাদাম ও কফি চাষ সম্প্রসারণের ফলে আগে যেখানে জুম চাষ হতো সেখানে এখন কাজুবাদাম ও কফি চাষ হচ্ছে। উৎপাদিত পণ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে পার্বত্য এলাকার মানুষ কাজুবাদাম ও কফি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছে।

কৃষিবিদ মোঃ জসিম উদ্দিন জানান, বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে কৃষি অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে সেখানে কফি চাষ নতুন একটি সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে। কফি চাষ শুধু অর্থনৈতিক সুযোগই সৃষ্টি করে না এটি মাটির উর্বরতা বজায় রাখতে সাহায্য করে, পরিবেশবান্ধব এবং স্থানীয় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, বেকার সমস্যা সমাধান ও উদ্যোক্তা তৈরীতে অত্যন্ত সহায়ক। পার্বত্য এলাকায় যেখানে পরিকল্পিত ও ফাঁকা স্থানযুক্ত ফলবাগান রয়েছে সেখানে অনায়াসে কফি বাগান করা যায়। বাগানে সেচ সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে আম, মাল্টা, কাঁঠাল, কমলা, কলা, আনারসের পাশাপাশি একই বাগানে কফি চাষেও সাফল্য মিলছে। আর এটাই কফিতে কৃষকের আগ্রহের মূল কারণ।

সবচেয়ে আশার কথা হলো “বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলায় প্রায় পাঁচ লাখ হেক্টর অব্যবহৃত জমি রয়েছে। এর মধ্যে এক লাখ হেক্টরে কফি চাষ করলে দুই লাখ টন কফি উৎপাদন সম্ভব”। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৯২ শতাংশ উঁচু ভূমি, তাই এখানে পানি জমে না যা কফি চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এ কফি গাছ চাষ করতে বাড়তি জমিরও প্রয়োজন হয় না। কারণ আমবাগান, লিচু বাগান কিংবা অন্যান্য বাগানের গাছের ছায়ায় এ কফি গাছ চাষ করা সম্ভব। পাহাড়ি অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া কফি চাষের জন্য উপযোগী হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড পাহাড়ে বর্তমানে প্রায় ২ হাজার কপি-কাজুবাদামের বাগান সৃজিত করেছে স্থানীয়দের মাধ্যমে।

এ প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো দেশে উৎপাদিত কাজুবাদাম ও কফির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন। পাহাড়ে এই প্রকল্পের শুরু থেকেই এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য কাজ চলমান রয়েছে। তিনি জানান, দেশের পার্বত্য অঞ্চলের ২ লাখ হেক্টর অনাবাদি জমিকে কাজুবাদাম ও কফি চাষের আওতায় আনার কাজ চলমান রয়েছে। এ কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে উৎপাদিত কাজুবাদাম ও কফির মাধ্যমে দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ১ বিলিয়ন ডলার এর রপ্তানি করা সম্ভব।

কাজুবাদাম ও কফির আবাদ সম্প্রসারণের ফলে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হচ্ছে। সম্পূর্ণ বেসরকারিভাবে এসব কারখানা স্থাপিত হয়েছে। প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপনের ফলে দেশে উৎপাদিত কাজুবাদামের বাজারজাতকরণ সহজ হচ্ছে। দেশে কাজুবাদামের ভোক্তা পর্যায়ে চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ইতোমধ্যে কাজুবাদামের ২২টি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে উঠেছে। দেশে বর্তমানে কাজুবাদামের বাজার প্রায় ৭০০ কোটি টাকার।

প্রতি বছর গড়ে ২৫০০-৩০০০ টন প্রক্রিয়াজাতকৃত কাজুবাদাম আমদানি হয়। দেশে কফির চাহিদা প্রায় ২০০০ টন। গত এক দশকে গড়ে কফির চাহিদার প্রবৃদ্ধি প্রায় ৫৬ শতাংশ। বছরে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার কফি দেশের অভ্যন্তরে বিক্রি হয়। ভোক্তা পর্যায়ে গত ৫ বছরে এ দুটি পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। দেশের উৎপাদিত কফিও দেশের বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় ব্যবহার হচ্ছে। প্রকল্পের প্রভাবে নতুন নতুন চাষি উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে।

কাজুবাদাম ও কফি চাষ সম্প্রসারণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপনের ফলে দেশে কর্মসংস্থানের সংযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে বড় শিল্পগোষ্ঠীর প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন করছে। বিএসআরএম ও কাজী গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠান রপ্তানির উদ্দেশ্যে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন করছে। এসব কারখানায় প্রায় ১২০০ জনের মতো লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এছাড়া বিদ্যমান প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাগুলোতে প্রায় ২০০০ জন শ্রমিক কাজ করছে। এসব শ্রমিকের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হলো নারী শ্রমিক।

খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত কপি-কাজুবাদাম চাষ প্রকল্পটি ব্যাপক অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার উম্মোচনের হওয়ার কথা থাকলেও সেটি প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাব ও স্থানীয় পাহাড়ি কৃষকদের অসচেতনতার কারনে সঠিক সময়ে সময়োগযোগি হয়ে উঠছেনা বাগানগুলো। সংশ্লিষ্ট্যরা জানিয়েছেন, দূর্গম পাহাড়ে প্রায় ২ হাজার বাগান রক্ষণাবেক্ষণে রয়েছে মাত্র ৬জন মাঠ সংগঠক। এসব মাঠ সংগঠকের নেই কোনো ডিপ্লোমা ডিগ্রি। যারফলে চারা রোপন, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যা সময়মতো সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়াও দক্ষ প্রশিক্ষকের অভাবে স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠিদেরকে সময়োপযোগি প্রশিক্ষণও দেওয়া যাচ্ছে না। যার ফলে অর্থনৈতিক ব্যাপক সম্ভাবনাময় কপি-কাজুবাদাম চাষ এখনো পর্যন্ত পাহাড়ে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ছেনা।

এদিকে, রাঙামাটির কৃষি বিভাগ বলছে “সঠিক পরিকল্পনায় পাহাড়ি এলাকায় কপি ও কাজুবাদাম চাষ শুরু করা গেলে তা একদিকে অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দেবে, অন্যদিকে পাহাড় রক্ষা পাবে।”

 

কিউএনবি/আয়শা/২৪ জুলাই ২০২৫,/সন্ধ্যা ৭:৫০

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

October 2025
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit