শহিদ আহমেদ খান সাবের,সিলেট প্রতিনিধি : জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ ২০২৩ শীর্ষক কার্যক্রমের আওতায় তিন কেটাগরিতে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার নির্বাচিত ৩ জন শ্রেষ্ঠ জয়িতাকে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা মহিলা বিষয়ক কার্যালয় ও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবসে উপজেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে গত ৯ ডিসেম্বর শনিবার শ্রেষ্ঠ ৩ জন জয়িতাকে উত্তরিয়, সম্মাননা সনদ ও ক্রেস্ট প্রদান করেন অনুষ্ঠানের সভাপতি ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফারজানা প্রিয়াংকা সহ অতিথিবৃন্দ।৩ কেটাগরীতে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতারা হলেন- অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী লিপি বেগম, সফল জননী নারী মোছাঃ রিনা বেগম ও সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী নুরজাহান বেগম । অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী লিপি বেগম, সিলেটে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার নিজ ঘিলাছড়া গ্রামের জামাল আহমদ কাজলের স্ত্রী। লিপি বেগমের পিতা ছিলেন একজন দরিদ্র কৃষক। তারা পাঁচ বোন-এক ভাই। ভাই ছিলো প্রতিবন্ধী। কৃষিকাজ করে তার বাবার সংসারের খরচ বহন খুবই কষ্টসাধ্য ছিলো। তারপরও তার পাঁচ বোন লেখাপড়া করেছে। এস এস সি পরীক্ষায় পাশ করার পরে ২০০১ সালে লিপি’র বিয়ে হয়। তার স্বামী পেশায় রাজমিস্ত্রী ছিলো। নিয়মিত কাজ পেতো না। পরিবারে সবসময় আর্থিক সংকট ছিলো, ফলে সংসারে প্রায়ই দ্বন্দ্ব লেগে থকতো। তার শাশুড়ী ছিলেন খুবই অত্যাচারী। প্রতিদিন তাকে শারীরিক ও মানষিক নির্যাতন করতো। এক পর্যায়ে স্বামীসহ তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। কিছুদিন বাবার বাড়িতে থাকার পর স্বামীকে সাথে নিয়ে ভাড়া বাসায় উঠেন। এসময় লিপি প্রথম সন্তানের মা হন। স্বামীর আয় দিয়ে পরিবারের খরচ মেটাতে পারতো না। ঠিক সেসময় তাদের গ্রামে যুব উন্নয়নের সেলাই প্রশিক্ষণ শুরু হয় এবং সেই সেলাই প্রশিক্ষণে তিনি এক মাস প্রশিক্ষণ নেন। এক মাস প্রশিক্ষণ শেষে কোর্স মূল্যায়ণ পরীক্ষায় লিপি এ গ্রেড পেয়ে পাশ করে। এরপর উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে পঁচিশ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে একটা সেলাই মেশিন ক্রয় করে সেলাই কাজ শুরু করেন।২০০৭ সালে তার জমজ দুটি মেয়ে সন্তান হওয়ায় সংসারে খরচ আরো বেড়ে যায়। ২০০৮ সালে সেলাইয়ের পাশাপাশি ব্র্যাক ওয়াশ কর্মসূচিতে পাঁচ বছরের জন্য লিপি বেগম চাকরিতে যোগদান করেন পাশাপাশি রাতে সেলাইয়ের কাজ করতে থাকে। এভাবে চাকরী ও পরিবার সামাল দিয়ে যাচ্ছিলেন। ছেলে-মেয়েদের স্কুলে ভর্তি করার কিছুদিন পর তিনি চাকরী ছেড়ে দেন। একটি দোকান নিয়ে সেলাইয়ের কাজ পুরোদমে শুরুর পাশাপাশি থান কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন। তার আয়ের টাকা দিয়ে পরিবারের খরচ বহন ও তাঁর বাবাকে আর্থিকভাবে সহযোগিতার পরও মাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা সঞ্চয় করতো।
এই সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে তিনি একটি বাড়ি করার জন্য জমি ক্রয় করে বাড়ি তৈরি করেন। বর্তমানে তার ছেলে এইচ এসসি পরীক্ষার্থী ও যমজ মেয়েরা এসএসসি পরিক্ষার্থী। মেয়েরা তাকে সেলাইয়ের কাজে সহযোগিতা করে। লিপি বেগম অসহায় মেয়েদের সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ শেষে তাদেরকে তার দোকানে সেলাইয়ের কাজ করার সুযোগ দেন। বর্তমানে তার দোকানে ৪টি সেলাই মেশিন আছে। এর পাশাপাশি তিনি হাঁস-মুরগী ও পশু পালন করছেন। এখন তিনি একজন আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল ব্যক্তি। তার ধৈর্য্য, শ্রম ও আত্ম-বিশ্বাস তাকে উন্নতির শিখরে নিয়ে গেছে। এসব কিছুর পাশাপাশি ২০১০ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এইচএসসি পাশ করছেন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী ক্যাটাগরিতে লিপি বেগম শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন।সফল জননী নারী মোছাঃ রিনা বেগম। সিলেটে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার ঘিলাছড়া গ্রামের শেখ আব্দুল জব্বারের স্ত্রী। মোছাঃ রিনা বেগম ১৯৭০ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। জন্মের পরপরই তার বাবা মারা যায়। তিনি ও তার ভাই বোনদের মা লালন পালন করেন। ফলে সে বেশি দূর লেখাপড়া করতে পারিনি। তার বিয়ে হয় ১৯৮৮ সলে। তার স্বামী পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি ছিলেন। তার এক ছেলে ও দুই মেয়ে। রিনা বেগমের আশা ছিলো, যতই কষ্ট হউক সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন। কিন্তু তাদের আর্থিক অবস্থ ভালো ছিলো না, তাদের কৃষি জমিও তেমন ছিলো না। ফলে তাদের সংসারে একটা টানাপোড়ন লেগেই থাকতো। তবুও তারা দুজনই আশাবাদী ছিলেন সন্তানদের শিক্ষিত করবে। ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ বহন করতে গিয়ে অনেক সময় তারা না খেয়েও থেকেছেন। তার স্বামী ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালানো জন্য রাতেও কাজ করতো। রিনাও সংসারের কাজ সেরে হাতের কাজ করতো যা দিয়ে সন্তানদের স্কুল-কলেজের বেতন দিতেন। তাদের মতো নি¤œ মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালানোটা ছিলা অনেক কষ্টসাধ্য। কিন্তু তাদের পরিশ্রম ও দৃঢ় প্রত্যয়ে তা সম্ভব হয়েছে। তারা সবসময় বিশ্বাস করতো সন্তানদের একটা সুন্দর জীবনের জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন তাদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা। অনেক সময় তাদের টানাপোড়ন দেখে প্রতিবেশীরা ছেলেকে কাজে লাগানো পরামর্শ দিতো। সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সব কষ্ট সহ্য করেছেন।রিনা বেগমে ১ম সন্তান (ছেলে), মোঃ সেবুল আহমদের শিক্ষা জীবন শুরু হয় বঙ্গবন্ধু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে, ২০০৯ সালে ঘিলাছড়া দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস এস সি এবং ২০১১ সালে ফেঞ্চুগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে এইচ এস সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। সিলেট এম সি কলেজ থেকে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে। ৪০ তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নন ক্যাডারে প্রথম শ্রেণি (ইন্সট্রাক্টর পদার্থ বিজ্ঞান) সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।২য় সন্তান (মেয়ে), সিলেট সরকারি এমসি কলেজে স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত ও ৩য় সন্তান (মেয়ে) সিলেট সরকারি এমসি কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে অধ্যয়নরত।তিনি তার সন্তানদের কষ্ট করে পড়ালেখা শিখিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার এই সফলতার জন্য সফল জননী নারী ক্যাটাগরিতে রিনা বেগম শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বচিত হয়েছেন।নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে শুরু করেছেন যে নারী নুরজাহান বেগম। সিলেটে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার কটালপুর গ্রামের আমীর আলী স্ত্রী। নুরজাহান বেগম এর পিতা ছিলো একজন দরিদ্র কৃষক। লেখাপড়া করার ইচ্ছা থাকা সত্বেও মায়ের আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকার কারণে লেখাপড়া করা হয়নি। ভাই বোনের জন্মের পর বাবা তার মাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। তার মা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করে তাদের পাঁচ ভাই ও বোনকে ভরণপোষণ করেন। নুরজাহানের বয়স যখন ১৫ বছর তখন তার মা ও মামারা মিলে তাকে ৪০ বছর বয়স্ক চার সন্তানের জনকের সাথে বিয়ে দেন। বিয়ের কিছুদিন পর থেকে তার স্বামী ও সতীন মিলে তার উপর পাশবিক নির্যাতন শুরু করে। তাকে ঠিকমতো খাবার দিতো না। সবসময় তাকে গালিগালাজ ও মারধর করতো। এর মধ্যে নুরজাহানের গর্ভে প্রথম সন্তান চলে আসে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মায়ের বাড়ি চলে আসে। মায়ের কাছে আসার পর তার প্রথম পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। সন্তান জন্মের পর তার স্বামী কোন খোজ খবর নেয়নি। এই অবস্থায় তিনি নানার বাড়িতে অগ্রাহায়ণ মাসে ধান শুকানোর কাজ শুরু করেন। কাজের টাকা দিয়ে তার বাচ্চার ভরন পোষণ ও কিছু টাকা সঞ্চয় করেন। এ সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে তিনি স্থানীয় বাজারে জ্বালানী কাঠের ব্যবসা শুরু করেন।
পাশাপাশি সীমান্তিকে মা ও শিশু প্রোগ্রামে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ শুরু করে। আর্থিক অবস্থা ভাল দেখে স্বামী আসা-যাওয়া করে। একদিন স্বামী তার কাছে টাকা চায়। টাকা না দেয়ায় তাকে শারীরিক ও মানুষিক নির্যাতন করে চলে যায়। এর মধ্যেই নুরজহান দ্বিতীয় সন্তান জন্ম দেন। কন্যা সন্তান জন্মের পর আবারও সীমান্তিকে কাজ শুরু করে। সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে কিছু হাঁস-মুরগী ক্রয় করে পালন করতে থাকে। এভাবে জ্বালানী কাঠের ব্যবসার মুনাফা ও হাঁস-মুরগী ও ডিম বিক্রি করে তিনি তার নামে কিছু জমি ক্রয় করে। মা ও শিশুর স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে তিনি তার এলাকায় ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। ২০১৮ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তিনি ৪নং উত্তর কুশিয়ারা ইউনিয়ন পরিষদের ৪, ৫ ও ৬ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা আসনে ইউপি সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ইউনিয়ন পরিষদে মহিলা সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তার নিজ এলাকায় কোন নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন, বাল্য বিবাহ হলে তা বন্ধের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি তার জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে সমাজের প্রতিটি নারীকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে উদ্ভোধ করে যাচ্ছেন। নারীরা শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী হলেই সমাজ থেকে নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন ও বাল্য বিবাহ বন্ধ হবে।
তিনি আজীবন অসহায় মহিলাদের পাশে থেকে সেবা করার ব্রত গ্রহণ করা সহ সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখায় নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে শুরু করেছেন যে নারী ক্যাটাগরিতে নুরজাহান বেগম শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন।ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা (অঃ দাঃ) খাদিজা খাতুন বলেন, প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ৩ জন জয়িতাকে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। আগামীতেও মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা প্রদান অব্যাহত থাকবে।
কিউএনবি/অনিমা/০৩ এপ্রিল ২০২৪/রাত ৯:০৩