মো. সাইদুল আনাম, কুষ্টিয়া জেলা প্রতিনিধি : সমন্বয়হীনতা, দুর্নীতি, দলীয় কোন্দল ও দালাল শ্রেণীর নামধারী কথিত কতিপয় নেতাদের প্রাধান্য দেওয়ায় কুষ্টিয়া-১ দৌলতপুর আসনে নৌকার ভরাডুবি হয়েছে। ট্রাক প্রতীক নিয়ে দৌলতপুর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও সাবেক এমপি আলহাজ্ব রেজাউল হক চৌধুরী বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয় অর্জন করলেও নৌকার প্রার্থী দৌলতপুর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ্যাড. আ. কা. ম. সরওয়ার জাহান বাদশাহ্ হয়েছেন তৃতীয়। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন দৌলতপুর আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক এমপি আফাজ উদ্দিন আহমেদের বড় ছেলে নাজমুল হুদা পটল। বিগত ৫ বছরে আওয়ামী লীগ দলীয় মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের যথাযথ মুল্যায়ন না করা, নিজ প্রয়োজনে বা কাজের জন্য কেউ দেখা করতে গেলে তাদের সাথে অসাদাচারন, সাধারন মানুষ মোবাইল ফোন করলে তা রিসিভ না করা, সর্বদা ডিগবাজি মারা কতিপয় দালাল শ্রেণীর নামধারী নেতাদের প্রাধান্য দেওয়াসহ বিএনপি-জামাত সমর্থিত পরিবারের কিছু লোকদের সাথে চলাফেরা ও দাওয়াত নির্ভর কর্মকান্ড পরিচালনা করায় আওয়ামী লীগ মনোনিত নৌকার প্রার্থী এ্যাড. আ. কা. ম. সরওয়ার জাহান বাদশাহ্ এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হেরেছেন বলে মাঠ পর্যায়ের সাধারণ ভোটার ও নেতা-কর্মীদের অভিমত। এছাড়াও বিএনপি দলীয় চরাঞ্চলের এক সময়ের ত্রাস লালচাদ বাহিনীর সামরিক শাখার সেকেন্ড ইন কমান্ড মরিচা ইউনিয়নের হাটখোলাপাড়া গ্রামের চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও বিএনপি দলীয় ক্যাডার উজ্জল সর্দারকে প্রাধান্য দিয়ে তার নেতৃত্বে হাটখোলাপাড়া গ্রামে আওয়ামী দলীয় দুই কর্মীকে নির্মম ও নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা, শান্ত চিলমারীকে অশান্ত করে তিন জন গ্রামবাসীকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় দুই ইউনিয়নের নিরীহ ও নৌকা পাগল সাধারণ মানুষ সরওয়ার জাহান বাদশাহ্ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ফলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা পেয়েও বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজয় বরণ করতে হয় তাকে। দৌলতপুর আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা আরো জানান, দৌলতপুর ইউনিয়নের বার বার নির্বাচিত চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের ত্যাগী প্রবীণ নেতা রেজওয়ানুল হক রেজু, অড়িয়ার গণমানুষের নেতা ইউপি চেয়ারম্যান থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান ফিরোজ আল মামুন, বাংলাদেশ জন্মলগ্ন থেকে দৌলতপুর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি পদে থাকা মথুরাপুরের শামছদ্দিন আহমেদ পরিবার সহ দৌলতপুরের ত্যাগী ও বিএনপি-জামাত জোটের দুঃশাসনে নির্যাতিত আওয়ামী লীগ দলীয় নেতা-কর্মীদের যথাযথ মূল্যায়ন না করে বিএনপি-জামাত সমর্থিত পরিবারে লোকজন নিয়ে দৌলতপুর আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করে তাদের দ্বারা পরিচালিত হওয়া এবারের নির্বাচনে পরাজয়ের আরো একটি অন্যতম কারণ বলে মনে করেন তারা। এছাড়াও রয়েছে ভুঁয়া মুক্তিযোদ্ধা বানানোর কারিগর ও ফিলিপনগরের বিতর্কিত ব্যক্তি এমপি কপালে হায়দার আলীকে সর্বদা গুরুত্ব দেওয়া, জাপা থেকে আ’লীগ সর্বদা ডিগবাগী মারা দালাল নামে খ্যাত মথুরাপুরের এক নেতা যিনি এমপি’র প্রতিনিধি নামে নিজেকে সর্বদা জাহির করতে পছন্দ করতেন এবং তারাগুনিয়ার এক ফুরফুরে নেতা যিনি বিএনপি দলীয় সাবেক এমপি’র ব্যবসায়িক পার্টনার তাদেরকে উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন দপ্তরের দায়িত্ব দিয়ে সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডকে বাঁধাগ্রস্থ করা, ভাতার কার্ড করার নামে ছিন্নমুল মানুষের কাছ থেকে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়াও নৌকার ভরাডুবির কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। অভিযোগ রয়েছে দৌলতপুরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য ও বিতর্কিত ব্যক্তিদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির সভাপতি করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ারও। শুধু তাই নয়, নিজ এলাকা ও নিজ ইউনিয়নের জনগণের সাথেও ছিল বেশ দূরত্ব। এমনকি সদ্য বিগত হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের ৫বছরে দৌলতপুরে দৃশ্যমান কোন উন্নয়ন না হওয়ায় সুশীল সমাজের মানুষেরও আস্থা অর্জন করতে পারেননি তিনি। অথচ ২০১৮ সালের নির্বাচনে সময় এ্যাড. আ. কা. ম. সরওয়ার জাহান বাদশাহ্ দৌলতপুরকে আধুনিক ও মডেল দৌলতপুর গড়ার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ভেড়ামরা-ফিলিপনগর-প্রাগপুর হয়ে মেহেরপুরের মুজিবনগর পর্যন্ত রেল সড়ক নির্মাণের। ছিল ভেড়ামারা-প্রাগপুর ফোরলেন করার প্রতিশ্রম্নতি। প্রাগপুর সীমান্তে স্থলবন্দরের প্রতিশ্রম্নতিও দিয়েছিলেন। খলিসাকুন্ডিতে বিনোদন পার্ক, ফিলিপনগরে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ষ্টেডিয়াম নির্মাণের প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিলেন। যার একটিও আলোর মুখ দেখেনি। তিনি মাঠ পর্যায়ের আওয়ামী লীগ দলীয় সাধারণ নেতা-কর্মীদের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি করে গুটিকয়েক নামধারী নেতা ও চিহ্নিত দালালদের সাথে নিয়ে ভুরিভোজ করে ৫টি বছর কাটিয়েছেন এমন অভিযোগও করেছেন তৃলমুলের নেতা ও কর্মীরা। দৌলতপুরের ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতাদের বাদ দিয়ে নিজের শ্বশুরসহ ফিলিপনগরের প্রায় ১৩জন দলের অস্তিত্বহীন ব্যক্তিদের নিয়ে দৌলতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করেন যাদের দু’একজন বাদে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার পক্ষে তাদের কোন ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি। এমনকি তিন ভাগে বিভক্ত দৌলতপুর আওয়ামী লীগকে একত্রিত করাসহ সুসংগঠিত করারও কোন ভূমিকা নেননি তিনি। আর এমন অভিযোগও রয়েছে খোদ দলের অভ্যন্তরেই। আর এসব কারণেই এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার দূর্গে হানা দিয়েছে ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও তার কর্মী সমর্থকরা। ফলে তিনি তীরে ভিড়াতে পারেননি তরী।যদিও তিনি নির্বাচনে পরাজিত হয়ে গত ১০ জানুয়ারী বিঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পালন ও নির্বাচনোত্তর আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে অভিযোগ করে বলেছেন, ২০১৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরে আমরা প্রয়াত নেতা আফাজ উদ্দিন আহমেদের কনিষ্ঠপুত্র এজাজ আহমেদ মামুনকে উপজেলা নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন এনে দিতে সহযোগিতা করেছিলাম। তার পক্ষে নির্বাচন করে তাকে জয়লাভ করেছিলাম। কিন্তু তারা সব সময় উল্টো পথেই চলেছে। তারা ৫ বার নৌকায় ভোট নিয়েছেন কিন্তু নৌকায় ভোট দেননি বা নৌকাকে সমর্থন করেনি। ১৯৯১ এবং ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনেও তারা নৌকার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। এবারও তারা নৌকার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে নৌকার তলা ফুটো করলেন বলে অভিযোগ করেন।সর্বপরি জনসম্পৃক্ততা না থাকার পাশাপাশি অনিয়ম, দুর্নীতি ও নিজ গতিতে চলার কারণে নৌকার দূর্গে হানা দিয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থী। আর এমনটাই মনে করেন দৌলতপুরের সচেতন মহল।
উল্লেখ্য, গত ৭ জানুয়াীর নির্বাচনে কুষ্টিয়া-১ দৌলতপুর আসনে ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আলহাজ্ব রেজাউল হক চৌধুরী চৌধুরী ৮৯ হাজার ২৭৪ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি ঈগল প্রতীকের অপর স্বতন্ত্র প্রার্থী নাজমুল হুদা পটল ৫৩হাজার ১০৫ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন এবং ৪৮হাজার ৯৬১ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন নৌকার প্রার্থী আ. কা. ম. সরওয়ার জাহান বাদশাহ্।
কিউএনবি/অনিমা/১৫ জানুয়ারী ২০২৪,/দুপুর ২:৪৪