বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫, ০৮:২১ পূর্বাহ্ন

হিমোফিলিয়া নিয়ে কিছু কথা

Reporter Name
  • Update Time : সোমবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৩
  • ১০৮ Time View

স্বাস্থ্য ডেস্ক : হিমোফিলিয়া কী : হিমোফিলিয়া রক্তের একটি বিশেষ জন্মগত বা জিনগত রোগ, যেখানে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়। আমাদের শরীরে কোথাও কেটে গেলে সাধারণত কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিকভাবে রক্ত জমাট বেঁধে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু হিমোফিলিয়া রোগীর এই রক্তক্ষরণ দীর্ঘ সময়ের জন্য চলতে থাকে। কারণ রক্ত জমাট বাঁধার জন্য যে বিশেষ প্রোটিন F-VIII ও F-IX প্রয়োজন হয় তার ঘাটতি থাকে। এ দুটি ফ্যাক্টরের জিন মানুষের এক্স ক্রোমোজমে থাকে। হিমোফিলিয়া দুই ধরনের হয়। ফ্যাক্টর এইট-এর ঘাটতিজনিত রোগকে হিমোফিলিয়া ‘এ’ এবং ফ্যাক্টর নাইনের ঘাটতিজনিত রোগকে হিমোফিলিয়া ‘বি’ বলে।

ইতিহাস : জানা যায়, উনিশ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ রাজপরিবারের রানি ভিক্টোরিয়া ছিলেন হিমোফিলিয়া জিনের বাহক। তার পুত্রসন্তান লিওপোল্ডের ছিল হিমোফিলিয়া রোগ আর রাজকন্যা অ্যালিস ও বেয়াত্রিস এরা ছিলেন এই রোগের বাহক। এটি রক্তক্ষরণ রোগ যা পরবর্তীতে বংশ পরম্পরায় চলতে থাকে। লিওপোল্ডের মা তাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় থাকতেন এবং তাকে খুব সুরক্ষিত রাখতেন। তারপরও খেলতে গিয়ে মাথায় সামান্য আঘাতে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে ছেলেটি মারা গিয়েছিল। এরপর রানির উত্তরসূরিদের বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে ইউরোপ ও রাশিয়ার রাজপরিবারেও এই জিন ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৫২ সালে ওই একই ব্রিটিশ রাজপরিবারের স্টিফেন ক্রিসমাস একই ধরনের হিমোফিলিয়া ‘বি’ রোগে আক্রান্ত হন। তার নাম অনুযায়ী হিমোফিলিয়া ‘বি’কে ক্রিসমাস ডিজিজ বলা হয়। মোদ্দা কথা, ওই সময় হিমোফিলিয়াকে রয়েল ডিজিজ বলা হতো। এখন বিশ্বের সব দেশেই এই রোগ দেখা যায়।

কাদের হয়? কেন হয়? এ রোগে সাধারণত ছেলেরা আক্রান্ত হয়, আর মেয়েরা এই হিমোফিলিয়া জিনের বাহক হয়। কারণ বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় X-linked disease, যা শুধু এক্স ক্রোমোজমের মাধ্যমে বংশ পরম্পরায় চলতে থাকে। ছেলেদের একটি মাত্র এক্স ক্রোমোজম থাকে যা মায়ের কাছ থেকে আসে। তাই মা যদি তার এক্স ক্রোমোজমে এই ত্রুটিপূর্ণ জিন বহন করেন, তবে তার পুত্রসন্তানরা হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। মেয়ে সন্তানরা বাহক হতে পারে। এ ক্ষেত্রে জিনেটিক ত্রুটির কারণে রক্ত জমাট বাঁধার প্রোটিন বা ফ্যাক্টর (F-VIII or F-IX) স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম থাকে। তাই রোগীর বেশি ও দীর্ঘ রক্তক্ষরণ হয়। পারিবারিক ইতিহাস খুব গুরুত্বপূর্ণ, আক্রান্তের নিজের ভাই, খালাতো ভাই, মামা, নানা এদের ইতিহাস জানা জরুরি। তবে ২৫% ক্ষেত্রে কোনো পারিবারিক ইতিহাস নাও থাকতে পারে, অর্থাৎ নতুন মিউটেশন থেকেও হতে পারে।

হিমোফিলিয়ার ধরন ও লক্ষণ : সাধারণত দুই ধরনের হয়। যেমন- হিমোফিলিয়া A:F-VIII এর ঘাটতি, হিমোফিলিয়া B:F-IX এর ঘাটতি। রোগের তীব্রতা ও ফ্যাক্টরের মাত্রা অনুযায়ী এদের তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন : মৃদু/ Mild : ফ্যাক্টর মাত্রা >৫-৪০%। এদের তেমন কোনো উপসর্গ থাকে না। তবে কোথাও কেটে গেলে বা আঘাত পেলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়। মাঝারি/ Moderate : ফ্যাক্টর মাত্রা ১-৫%। মাঝে মাঝে মাংসপেশি, হাড়ের জয়েন্ট ও অন্যান্য টিস্যুতে রক্তক্ষরণ হয়।

মারাত্মক/ Severe : ফ্যাক্টর মাত্রা <১%। এখানে কোনোরকম আঘাত ছাড়াই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ শুরু হতে পারে। জন্মের পর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণও হতে পারে। এ ছাড়াও মাংসপেশি, হাড়ের জয়েন্ট বিশেষত হাঁটু, কুনুই, পায়ের গোড়ালি- এসব স্থানে ফুলে যেতে পারে ও ব্যথা হয়। জয়েন্ট ফুলে গিয়ে গরম হয়ে তীব্র ব্যথা হতে পারে। ত্বকের নিচে আঘাত বা bruise, মাড়ি দিয়ে রক্তক্ষরণ এসবও হতে পারে। মারাত্মক ক্ষেত্রে শিশু অবস্থায়ই লক্ষণ প্রকাশ পায়। এ ছাড়াও দাঁত পড়া, সুন্নাত-ই-খাৎনা, যে কোনো সার্জারি বা আঘাতের কারণে অতিরিক্ত রক্ত ঝরতে পারে। হিমোফিলিয়ায় মূল সমস্যা হলো হাড় জোড়া বা জয়েন্ট ফুলে যাওয়া যাকে বলা হয় hemarthrosis/arthropathy. একই জয়েন্ট বারবার ফুলে গিয়ে টার্গেট জয়েন্টে পরিণত হয়। ফলে তার কার্যকারিতা কমে যায়। এতে রোগীর হাঁটা ও চলাফেরা বিঘ্নিত হয়। একসময় জয়েন্টের কাজ সম্পূর্ণরূপে ব্যাহত হতে পারে।

শনাক্তকরণ : ইতিহাস ও লক্ষণ জানার পর রক্তের স্ক্রিনিং পরীক্ষার মাধ্যমে ধারণা করা যায় যে, APTT নামক পরীক্ষার ফল বেশি। এরপর নির্দিষ্ট ফ্যাক্টর পরীক্ষা (Factor VIII or IX Assay) করে হিমোফিলিয়া রোগ নির্ধারণ হয়। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এই পরীক্ষাগুলো করা হয়। যদিও এই শনাক্তকরণ সুবিধা দেশের মাত্র কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে আছে যা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।

চিকিৎসা : ফ্যাক্টর ইনজেকশন (F-VIII or F-IX concentrate replacement). প্লাজমা পরিসঞ্চালন (Fresh frozen Plasma or cryoprecipitate), রক্ত পরিসঞ্চালন ক্ষেত্রবিশেষে। ইনহিবিটর বা এন্টিবডি শনাক্তকরণ ও জটিলতার চিকিৎসা।

রক্তক্ষরণ প্রতিরোধে প্রাথমিক চিকিৎসা : আক্রান্ত স্থানকে বিশ্রাম দেওয়া ও সম্ভব হলে উঁচু করে রাখা, রক্তক্ষরণের স্থানকে চেপে ধরে রাখা, দ্রুত বরফ বা ঠান্ডা পানি দেওয়া, ব্যথা হলে প্যারাসিটামল খাওয়া, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।

কিছু সাবধানতা যা রোগীকে মেনে চলতে হবে : যে কোনো ধরনের আঘাত থেকে রক্ষা করা, শিশুকে সবসময় সুরক্ষিত রাখা, মাংসপেশিতে ইনজেকশন না দেওয়া, ছেলে শিশুদের সার্জারির আগে পারিবারিক ইতিহাস অবশ্যই জেনে নেওয়া, চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ব্যথার ওষুধ না খাওয়া। এ ছাড়া বাড়িতে সব সময় বরফ রাখা।

বাংলাদেশে আনুমানিক ২০ হাজারের বেশি হিমোফিলিয়া রোগী থাকার কথা। কিন্তু মাত্র আনুমানিক ২ হাজার ৯০০ রোগী নিবন্ধিত হয়েছে। বাংলাদেশ হিমোফিলিয়া সোসাইটি রোগী শনাক্তকরণসহ সচেতনতামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা এ বিষয়ে আমাদের সচেতনতা আরও বাড়াতে হবে। কারণ কথায় আছে প্রতিকার নয়, প্রতিরোধ সর্বদা উত্তম।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, হেমাটোলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।

কিউএনবি/অনিমা/১৮ ডিসেম্বর ২০২৩,/দুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুপুর ১:২২

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

June 2025
M T W T F S S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit