মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫, ০৭:৩৪ পূর্বাহ্ন

শেখ হাসিনার দেশে ভোট, নজিরবিহীন লড়াইয়ে বাইডেন-পুতিন-শি-মোদি

Reporter Name
  • Update Time : শনিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২৩
  • ১৮৬ Time View

ডেস্ক নিউজ : বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অন্যান্য ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ও ভারতের কূটনৈতিক ভূমিকা নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়ালে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ‘হাসিনার দেশে ভোট, নজিরবিহীন লড়াইয়ে বাইডেন-পুতিন-শি-মোদি’ শিরোনামে এই নিবন্ধ লিখেছেন ভারতীয় সাংবাদিক অমল সরকার। দ্য ওয়ালে প্রকাশিত নিবন্ধটি হুবহু নিচে তুলে ধরা হলো:-

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যখন দেশের শাসক ও বিরোধী শিবিরের মধ্যে চূড়ান্ত রেষারেষি চলছে তখন শেখ হাসিনার দেশকে ঘিরে কূটনৈতিক অঙ্গনে নজিরবিহীন লড়াইয়ে মেতেছে আমেরিকা ও রাশিয়া। বালাদেশে সংসদ নির্বাচনের জন্য ভোট নেওয়া হবে ৭ জানুয়ারি। দেশটিতে ক্রমে ভোটের উত্তাপ বাড়ছে। রুশ-মার্কিন কূটনৈতিক লড়াই ঘিরে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে বেশি। বাংলাদেশকে নিয়ে দুই মহাশক্তিধর দেশের এমন লড়াইয়ের নজির নেই। দু’দিন আগে মস্কোতে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা ঢাকায় আমেরিকার রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ তোলেন। পাল্টা জবাব দিয়েছে ওয়াশিংটনও।

এর আগে গত সেপ্টেম্বরে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরবের একটি মন্তব্য ঘিরে তুঙ্গে ওঠে রুশ-মার্কিন বিবাদ। ঢাকায় তিনি খোলাখুলি বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা চাপ প্রয়োগ করা সত্ত্বেও বাংলাদেশে আমাদের বন্ধুরা তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে অবিচল, যা জাতীয় স্বার্থে পরিচালিত হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা তথাকথিত ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল ব্যবহার করে এই অঞ্চলে তাদের স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করছে। তাদের লক্ষ্য স্পষ্টতই চীনকে নিরস্ত্র এবং এই অঞ্চলে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা।’ আমেরিকা সেবারও রুশ সমালোচনার জবাব দিয়েছিল। যদিও এবারের মতোই তাতে ঝাঁজ ছিল না।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে নিয়ে গত দেড়-দু বছর যাবৎ বাংলাদেশের রাজনীতি উত্তপ্ত। একেবারে সেদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের মতোই হাস বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। বারে বারে অবাধ ভোটের কথা বলে বিশ্বাসযোগ্য করার চেষ্টা করেছেন, বাংলাদেশে নির্বাচন পুরোটাই প্রশ্নবিদ্ধ। হাসের এই আচরণে শাসক দল আওয়ামী লীগ যেমন বিরক্ত, তেমনই খুশি বিরোধী দল বিএনপি। প্রধান বিরোধী দলের এক প্রথমসারির নেতা পিটার হাসকে অবতার, ঈশ্বর বলেও বর্ণনা করেছেন।

কিন্তু রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে নিয়ে এক নতুন তথ্য হাজির করেছে, যা বাংলাদেশ সরকারও এখনও পর্যন্ত প্রকাশ্যে বলেনি। রুশ পররাষ্ট্র মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা অভিযোগ করেছেন, ঢাকায় একটি ঘরোয়া আলোচনায় পিটার হাসকে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে জোরালো রাজনৈতিক কর্মসূচি, সভা-সমিতি করার পরামর্শ দিতে শোনা গেছে। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাবি, এমন প্রমাণ তাদের কাছে আছে। এটা একটি দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।

রুশ দূতাবাসের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘কিছু দেশ নিজেদের উন্নত গণতন্ত্র বলে দাবি করে। অথচ তারা অন্য সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে শুধু হস্তক্ষেপই করে না, ব্ল্যাকমেইলও করে।’ বলা হয় রাশিয়া কোনও দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না। আশ্চর্যের হল, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জবাবে জানিয়েছে, তারা অন্য দেশের নির্বাচনে কোনও দলকে সমর্থন করে না। কিন্তু পিটার হাসের বিরুদ্ধে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভিযোগ নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি। 

তাৎপর্যপূর্ণ হলো, গত দিন পনেরো হলো পিটার হাসও নীরব। তিনি ঢাকা ছেড়েছেন বলে খবর। বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে, কূটনৈতিক নিয়ম মেনে পিটার হাস তাদের জানিয়ে দেশ ছেড়েছেন। কিন্তু তিনি কোথায় গিয়েছেন সে ব্যাপারে সরকার কিছু জানাবে না। লক্ষণীয়, ঢাকার মার্কিন দূতাবাসও মুখে কুলুপ এঁটেছে। তারাও হাস কোথায় আছেন সে নিয়ে মুখ খুলছে না।

ভারতের বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পাশে থাকার সিদ্ধান্ত নতুন নয়। সম্প্রতি এই ব্যাপারে নয়াদিল্লির অবস্থান আরও স্পষ্ট করতে পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রা বুঝিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশের ভোট নিয়ে আমেরিকার নাক গলানো ভারতের পছন্দ নয়। দিল্লির বৈঠকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বুঝিয়েছেন, হাসিনাকে দুর্বল করার পরিণতি আমেরিকার জন্যও ভালো হবে না। কারণ, সেই সুযোগে চীন বাংলাদেশের ওপর তাদের প্রভাব আরও বাড়িয়ে নেবে। ভারত তা চায় না।

রাশিয়ার পাশাপাশি চীনও বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে আমেরিকার বিরোধিতায় নেমেছে। বেইজিং সরাসরি বিরোধিতা করেছে বিরোধী দল বিএনপির রাজনীতিরও। বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভোটের দাবিতে অবিচল। বাংলাদেশের সংবিধানে এমন সরকারের বিধান নেই।

ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন সম্প্রতি বলেন, বাংলাদেশে ভোট হওয়া উচিত দেশের বর্তমান সংবিধান মেনে। এর অর্থ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, হাসিনা সরকারের অধীনেই নির্বাচন হোক। বস্তুত নিকট বন্ধু ভারতের থেকেও জোরগলায় হাসিনা সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছে মস্কো ও বেইজিং। অন্যদিকে, আমেরিকা নানাভাবেই বর্তমান সরকারকে চাপে ফেলতে তৎপর। তাদের সঙ্গে গলা মিলিয়েছে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান।

উপমহাদেশে একটা সময় পাকিস্তানকে সামনে রেখে যেভাবে বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলো অঙ্গুলিহেলনের চেষ্টা করত, বিগত কয়েক বছর যাবৎ সেই দড়ি টানাটানির খেলাই শুরু হয়েছে বাংলাদেশকে নিয়ে।

কূটনৈতিক মহলের একাংশ মনে করে মার্কিন চাপের মুখে বাংলাদেশ পুরোপুরি চীনের দিকে ঝুঁকে পড়লে তা দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের জন্যই ক্ষতিকর। সবচেয়ে বিপদে পড়বে ভারত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে আঞ্চলিক নিরাপত্তার এই দিকটি বুঝিয়ে বলেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

নয়াদিল্লির বক্তব্য, আওয়ামী লীগ সরকার না থাকলে ভারতীয় উপমহাদেশ ফের অশান্ত হয়ে উঠতে পারে জঙ্গি তৎপরতা এবং ভারতবিরোধী শক্তি আস্ফালনে। হাসিনা সরকারের গত ১৫ বছরে এই শক্তিকে মাথা তুলতে দেয়নি বাংলাদেশ। তাতে ভারতও উপকৃত হয়েছে।

যদিও তারপরও আমেরিকা নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে তাদের অবস্থান রক্ষা করে চলেছে। হালে শর্তহীন আলোচনার প্রস্তাব দেন দক্ষিণ এশিয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্র সচিব পিটার লু। এরই মধ্যে কঠোর শ্রমনীতি প্রকাশ করেছে আমেরিকা, যেটির নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পের ওপর।

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সে দেশের ওপর আগেই বেশকিছু বিধিনিষেধ চাপিয়েছে আমেরিকা। চালু করেছে পৃথক ভিসা নীতি। সে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তার আমেরিকা সফরের ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে মানবাধিকার হরণের অভিযোগে।

এছাড়া মার্কিন কূটনীতিক বিগত এক বছর যাবৎ বাংলাদেশে অবাধ ভোট করা নিয়ে সরব। অনেকেই মনে করছেন, বাংলাদেশকে চীন-রাশিয়ার প্রভাব থেকে বের করে আনতে চাপ সৃষ্টির খেলায় আমেরিকা গণতন্ত্র, মানবাধিকারকে হাতিয়ার করেছে। কারণ, এই আমেরিকাই মিয়ানমারে সেনা শাসকদের সম্পর্কে নীরব। 

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে চীন যে খোলাখুলি বাংলাদেশের পাশে আছে নানা অবকাশে তারা সে বার্তা দিয়ে চলেছে। সেপ্টেম্বরে জোহানেসবার্গে ব্রিকস সম্মেলনের ফাঁকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিংপিনের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠকে শি বাংলাদেশ প্রশ্নে চীন হাসিনার পাশে আছে বলে কথা দেন, এমনটাই দাবি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের।

ইউক্রেনকে সামনে রেখে রাশিয়ার বিরুদ্ধে একজোট হয়েছে আমেরিকাসহ পশ্চিমের শক্তিধর দেশগুলো। রাশিয়ার বিরুদ্ধে গুচ্ছ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বাইডেন প্রশাসন। তার ফলে ভারত, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশ বিপদে পড়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে মার্কিন ডলারের বিনিময়ে বাণিজ্য করা যাচ্ছে না। অথচ বেশিরভাগ দেশের কাছে বৈদেশিক মুদ্রা বলতে মার্কিন ডলারই আছে।

অন্যদিকে, ইউক্রেন যুদ্ধকে সামনে রেখে আরও কাছাকাছি এসেছে চীন ও রাশিয়া। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক এখন অন্য উচ্চতায় বিরাজ করছে। বাংলাদেশে দুই এই দেশেরই বিপুল বিনিয়োগ আছে। চীন সে দেশে সেতু, হাইওয়ে ইত্যাদি পরিকাঠামোর উন্নয়নে বিনিয়োগ করেছে। 

অন্যদিকে, বাংলাদেশের রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হয়েছে রাশিয়ার অর্থ সাহায্যে। বিনিয়োগ আছে ভারতেরও। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নজিরবিহীন কূটনৈতিক লড়াই শুরু করেছে তিন দেশ। একদিকে চীন-রাশিয়া, অন্যদিকে, আমেরিকা। ভারতও হাসিনা সরকারের পাশে আছে। তবে নয়াদিল্লি বেইজিংয়ের সঙ্গে নেই।

 

 

কিউএনবি/আয়শা/০৯ ডিসেম্বর ২০২৩,/বিকাল ৫:১৪

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

July 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit