আলমগীর মানিক,রাঙামাটি : স্থানীয় পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের ব্যাপক চাঁদাবাজি ও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালিপনার কারনে প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ২৫ বছরেও পূর্নাঙ্গতা পায়নি পার্বত্য রাঙামাটির বিসিক শিল্প নগরী। বর্তমানে পাহাড়িদের আঞ্চলিকদলগুলোর ব্যাপকহারে চাঁদাবাজি, সশস্ত্র মহড়া, অনুন্নত রাস্তাঘাট ও পানির তীব্র সংকট, কাঁচামাল সংকটসহ নানান সমস্যার কারণে বিনিয়োগকারীরা বিসিক শিল্প নগরীতে কারখানা স্থাপনে আগ্রহী হচ্ছেন না। খোদ বিসিক কর্তৃপক্ষই জানিয়েছে, চাঁদাবাজি ও নিরাপত্তার অভাবে রাঙামাটির বিসিক শিল্পনগরীতে মিল-কারখানা স্থাপিত হচ্ছেনা।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের ব্যবস্থাপনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশে বিসিক শিল্পনগরী স্থাপনকল্পে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৭-৯৮ সালে রাঙামাটির সদর উপজেলাধীন সাপছড়ি ইউনিয়নের মানিকছড়িতে সাড়ে ১২ একর জায়গায় বিসিক শিল্পনগরী স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। ২০০৭ সালে সম্পূর্ন কাজ সম্পাদন হওয়ার পর সর্বমোট ৮৬টি প্লটের মধ্যে ৮৪টি প্লট বরাদ্ধ প্রদান সম্পন্ন হলেও কর্তৃপক্ষের বাস্তবসম্মত উদ্যোগ না থাকায় রাঙামাটি বিসিক শিল্পনগরী আর পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি। অথচ বিসিকের নীতিমালা অনুযায়ী, প্লট বরাদ্দ বুঝে পাওয়ার ১৮ মাসের মধ্যে সেখানে কারখানা তৈরি করতে হবে। ইতিমধ্যেই দীর্ঘ ২৫ বছরে মাত্র ১২টি কারখানা স্থাপন হলেও বাকি প্লটগুলো গো-চারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে।
এদিকে ব্যবসায়ি, জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় সুশীর সমাজের ব্যক্তিবর্গ জানিয়েছেন, উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের ব্যাপকহারে চাঁদাবাজি বন্ধ করা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণসহ মাটি ভরাট করে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে নাপারলে মিল-কারখানা স্থাপনে আগ্রহী হবেন না শিল্প উদ্বোক্তাগণ। “ব্যবহার অনুপযোগি জিনিসকে ব্যবহার উপযোগি করে গড়ে তোলা হলে সেটার ডিমান্ড বাড়ে এমন মন্তব্য করে রাঙামাটির চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, রাঙামাটিতে চাঁদাবাজিটা খুবই প্রবল’, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ শিল্প স্থাপনের উপযোগী করে রাঙামাটির বিসিককে গড়ে তুলতে হবে, তাহলেই শিল্প উদ্ধোক্তাগণ শিল্প স্থাপনে এগিয়ে আসবে।
তিনি বলেন, শিল্পাঞ্চলের জন্য ঢাকার মিল-কারখানায় সরকার শিল্প পুলিশিং ব্যবস্থা চালু করেছে। রাঙামাটির বিসিক শিল্পনগরীতেও মিল-কারখানাগুলোর নিরাপত্তায় শিল্প পুলিশের একটি ইউনিট স্থাপন করাসহ বিসিক শিল্পনগরী এলাকাটিতে মাটি ভরাটের মাধ্যমে এলাকাটিতে আরো উচু করে গড়ে তোলা হোক। রাঙামাটি সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শহিদুজ্জামান মহসিন রোমান বলেছেন, উপজেলাধীন সাপছড়ি ইউনিয়নের মানিকছড়িতে যে স্থানে বিসিক শিল্পনগরী স্থাপন করা হচ্ছে সেটি পাহাড়ি আঞ্চলিকদলীয় সন্ত্রাসীদের অভয়ারন্য বললেই চলে।
তিনি বলেন, রাঙামাটিতে উন্নয়ন কার্যক্রমসহ ট্যুরিজম সেক্টর, বিসিক শিল্পনগরীতে কলকারখানা স্থাপনে অন্যতম প্রধান বাধা হলো অবৈধ অস্ত্রধারীদের অপতৎপরতা। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধিসহ অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারলে অত্রাঞ্চলের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। রাঙামাটির প্রবীন ব্যক্তিত্ব ও স্থানীয় পত্রিকা গিনিদর্পনের সম্পাদক একেএম মকছুদ আহাম্মেদ বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও রাঙামাটির বিসিক কর্তৃপক্ষ বিগত ২৫ বছরেও শিল্প নগরীতে ২৫টি মিল-কারখানা চালু করতে পারেনি।
অপরদিকে রাঙামাটির অপর ব্যবসায়ি নেতা মঈনুদ্দিন সেলিম বলেন, রাঙামাটির বিসিক শিল্প নগরীতে প্লট বরাদ্দ সঠিকভাবে দেওয়া হয়নি, নতুন করে প্রকৃত ব্যবসায়িদেরকে প্লট বরাদ্দ প্রদান করতে পারলে রাঙামাটিতে প্রকৃত বিসিক শিল্পনগরী গড়ে উঠবে। এদিকে, চাঁদাবাজির বিষয়টি অকপটে স্বীকার করে রাঙামাটি বিসিকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মোঃ ইসমাইল হোসেন বলেছেন, চাঁদাবাজি ও নিরাপত্তাজনিত সমস্যার কারনে রাঙামাটির বিসিক শিল্প নগরীতে মিল-কারখানা হচ্ছে না, নিরাপত্তা ও প্রয়োজনীয় পরিবেশ পেলে তাশের ঘরের মতোই একজনে শুরু করলে বাকিরাও এখানে কাজ শুরু করবে। এছাড়াও বর্তমানে কাপ্তাই লেক ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে ভারী বৃষ্টিপাত হলেই শিল্পনগরী পানির নীচে ডুবে যায়।
এখানে মিল-কারখানা করার জন্য যে পরিমান কাঁচামাল দরকার সেটিও রাঙামাটিতে অপ্রতুল এমন মন্তব্য রাঙামাটি বিসিকের এই কর্মকর্তা বলেন, এখানে এগ্রিকালচার বলতে কিছুই নাই শুধুমাত্র হর্টিকালচারের উপর নির্ভরশীল হওয়াতে এগ্রোবেইজড কারখানা করা সম্ভবপর হচ্ছেনা। সরকারী বা বেসরকারী উদ্যোগে যদি এখানে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় কোনো প্রকল্পগ্রহণ করা হয় তাহলে মিল-কারখানা করা সম্ভব। ১৯৬০ সালে এসএমইদের শিল্পায়নের প্রক্রিয়ায় সহায়তা করার জন্য ইউটিলিটি সেবা ও উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থাসহ বাণিজ্যিক প্লটের উন্নয়ন ও বরাদ্দ দেওয়ার জন্য বিসিকের যাত্রা শুরু হয়।
অনুকরণযোগ্য শিল্প উদ্যোক্তা সৃষ্টি, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ক্ষুদ্র ও বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সাব-কন্ট্রাক্টিং স্থাপন, উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য বিপণনে মেলার আয়োজন, বিসিকের নিজস্ব তহবিলের মাধ্যমে ঋণ কার্যক্রম পরিচালনাসহ স্থানীয় অর্থনীতির গতিসঞ্চারে দেশের সমতল এলাকার জেলাগুলোর থেকে পিছিয়ে থাকা পার্বত্য রাঙামাটি জেলার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার মানসে অত্রাঞ্চলের অর্থনীতির গতি সঞ্চারনে অন্যতম সহায়ক হিসেবে বিবেচিত হওয়া বিসিক শিল্পনগরী ২৫ বছরেও আলোর মুখ না দেখায় স্থানীয়ভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ যেমনিভাবে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে, তেমনিভাবে কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন চাকরিপ্রার্থীরা।
কিউএনবি/আয়শা/২৭ অক্টোবর ২০২৩,/সন্ধ্যা ৬:০০