গোমতী কন্যা মীরা দেববর্মন : বৃদ্ধাশ্রম যার শেষ ঠিকানা
——————————————————————-
ত্রিপুরার রাজবংশ নিয়ে অনেক গল্প-কাহিনী প্রচলিত আছে। রাজা-মহারাজাদের জীবনাচরণ নিয়েও আছে অনেক আখ্যান-উপাখ্যান। এসব কাহিনী নিয়ে রাজবংশের ইতিহাসকে আশ্রয় করে পঞ্চদশ শতাব্দীতে রাজা ধর্মমাণিক্যের আদেশে একটি গ্রন্থ প্রণীত হয়। পদ্যে রচিত গ্রন্থটির নাম দেওয়া হয় ‘রাজমালা’। পরবর্তীতে গ্রন্থটির তথ্য হালনাগাদ করা হতে থাকে। সেই সময় ত্রিপুরা সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, সিলেট এবং কুমিল্লা। তার এই বইতে এসব অঞ্চলের ইতিহাসও উঠে এসেছে।
‘রাজমালা’ ছয়টি লহর বা খণ্ডে বিভক্ত। এই খন্ডগুলোর যুগে যুগে আধুনিকীকরণ হয়েছে। রাজবংশেরই একজন কর্মচারী ১৮৯৬ সালে ত্রিপুরার ইতিহাস নিয়ে আরেকটি গ্রন্থ রচনা করেন। এটির নামও দেওয়া হয় ‘রাজমালা’। গ্রন্থটির রচয়িতা ছিলেন শ্রী কৈলাসচন্দ্র সিংহ। বইটি রচনা করা হয় মহারাজ বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুরের আমলে। কৈলাসচন্দ্রের বাবা ও ঠাকুরদা ছিলেন মানিক্য পরিবারের সেরেস্তাদার ও মোক্তার। তাই তার ‘রাজমালা’য় ত্রিপুরার ব্যাপারে অনেক অজানা ও মূল্যবান তথ্য উঠে এসেছে।
বীরচন্দ্র মানিক্য রাজা হওয়ার আগে সিংহাসনের আরেকজন শক্ত-পোক্ত উত্তরাধিকারী ছিলেন। তিনি শচীন দেববর্মণের বাবা নবদ্বীপচন্দ্র দেববাহাদুর; বীরচন্দ্রের সৎভাই। সিংহাসনের অধিকার পাওয়ার লোভ বীরচন্দ্রকে হিংস্র ও নির্দয় করে তোলে। তিনি কয়েকবার নবদ্বীপচন্দ্রকে হত্যার চেষ্টা করেন। এ পর্যায়ে নবদ্বীপচন্দ্র রাজপরিবারের জ্যেষ্ঠ কর্মচারী কৈলাসচন্দ্র সিংহের পরামর্শে কুমিল্লায় চলে আসেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেন। রাজসিংহাসনের দাবি ত্যাগ করার পর কুমিল্লা শহরের দক্ষিণে চর্থা এলাকায় নবদ্বীপচন্দ্রকে বীরচন্দ্র ৬০ একর জমি দান করেন। এখানে নবদ্বীপচন্দ্র একটি দালান নির্মাণ করেন। এই দালানেই শচীন দেববর্মণের জন্ম হয়। এসডি বর্মন খ্যাত শচীন দেব বর্মন এর স্ত্রী মীরা দেব বর্মনও কুমিল্লার সন্তান ছিলেন। আমি যাকে শ্রদ্ধাভরে নাম দিয়েছি ”গোমতী কন্যা”।
গোমতী কন্যা মীরাদেব বর্মনকে নিয়ে কি ঘটল নিকট অতিত ২০০৬ সালে ? একটু উল্লেখ করি সে ঘটনা। ২০০৬ সালে ত্রিপুরা সরকার মীরা দেব বর্মণকে কোন একটা সাম্মানিক পুরস্কার দিতে গেলে মীরা দেবের পুত্র রাহুল দেব বর্মনের সান্তাক্রুজের বাড়িতে তাঁর খোঁজ পাওয়া যায় না । বহুকষ্টে অনেক খুঁজে এক বৃদ্ধাশ্রমে পাওয়া যায় অশীতিপর মীরাকে। এমনকি বৃদ্ধাশ্রমের মালিকও সেদিনই প্রথম জানতে পারেন যে তার বাড়িতে ধুঁকে ধুঁকে এতগুলো বছর কাটিয়ে দিয়েছেন অসংখ্য কালজয়ী গীতি কবিতার স্রষ্টা মীরা দেব বর্মন । যার বর্ণাঢ্য জীবনে জড়িয়ে আছেন স্বামী শচীনদেব বর্মন ও পুত্র রাহুল দেব বর্মন আর পুত্রবধূ আশা ভোঁসলে।
স্বামী সন্তানকে খুব ভালবাসতেন মীরা দেব বর্মন। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে প্যারালিটিক স্ট্রোক হয়ে কোমায় ছিলেন পাঁচ মাস শচীন দেব বর্মন । ৩১ অক্টোবর, ১৯৭৫ সালে ইহলোক ত্যাগ করেন শচীন দেব। স্বামী শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন মীরা দেব। শোকের মাত্রাটা শুরু হয়েছিল আরও অনেক আগে। ১৯৬৬ সালে পুত্র রাহুল দেব বর্মন বিয়ে করেন রিতা প্যাটেলকে। ১৯৭১ সালে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। এরপরে ১৯৮০ সালে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা সংগীত শিল্পী আশা ভোঁশলের সঙ্গে আবারও বিয়ে হয় পুত্র রাহুল দেব বর্মনের। কিন্তু ১৯৮৮ সালে রাহুল দেব হার্ট এটাকের কারণে বাইপাস সার্জারি করান লন্ডনে। এরপর থেকেই শুরু হয় আরডি বর্মন খ্যাত রাহুল দেব বর্মনের পড়ন্তবেলা। অভাব অনটন আর আর্থিক দৈন্যদশার মধ্যে রাহুল দেব বর্মন ১৯৯৪ সালের ৪ জানুয়ারী মাত্র ৫৪ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন।
প্রিয়তম স্বামী ও প্রানপ্রিয় পুত্রের অকাল প্রয়ানে ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন মীরা দেব বর্মন। খ্যাতির শীর্ষে অবস্থানরত পুত্রবধূ আশা ভোঁশলের ব্যস্তময় জীবনে একটা বোঝা স্বরূপ জীবন শুরু হল মীরা দেব বর্মনের। আশা ভোঁসলে সন্তর্পনে মীরা দেব বর্মনকে রেখে আসলেন ভাসি’র এক বৃদ্ধাশ্রমে।
মীরা দেব বর্মন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পরপরই স্বাধীন বাংলাদেশের নিজভূমি কুমিল্লায় ছুটে এসেছিলেন। গ্রামের পুকুর পারে দেখতে পেলেন একটি চৌদ্দ-পনের বছরের মেয়ে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদছে। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন সদ্য মেয়েটির বিয়ে হয়েছে, ভাই আসবে তাকে বাপের বাড়ি নিয়ে যেতে। সকাল থেকে অপেক্ষা করে করে সে এখন ক্লান্ত, ভাইয়ের দেখা নাই। মীরা দেব বাড়ি ফিরেই লিখেছিলেন – কে যাস রে ভাটি গাঙ গাইয়া, আমার ভাই ধনরে কইয়ো নাইওর নিতো আইয়া।
মীরাদেব বর্মন একজন আবেগী মানুষ ছিলেন। তাঁর বিষয়ে একজন সংগীত বোদ্ধার অভিমত এরকম, ‘শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তুখোড় জ্ঞান সম্পন্ন গায়িকা, নৃত্যশিল্পী, রবীন্দ্রসংগীতেও সমান দক্ষতা, গানের কথাকার হিসেবে আধুনিক মনস্কতা, শব্দের ব্যবহার, মাটির কাছাকাছি থাকার প্রবণতা, অবাক হতে হয়; সহকারি সঙ্গীত পরিচালক হিসেবেও চমক দেয়ার মতো সুরের প্রতিভা ছিল তাঁর।’
গান তখনই কাছের হয়ে ওঠে, যখন মাটির গন্ধটা মেখে গান হয়ে ওঠে রাজসিক। গান আত্মার আরো কাছাকাছি চলে আসে, যখন সেটাকে ছোঁয়া যায় । গান তখনই মনের কাছের হয়ে যায়, যে মুহূর্তে শ্রোতা বলে উঠতে পারেন, আরে এটা তো আমার গান! মীরা দেববর্মণের গানগুলো একদমই তেমন ছিল।
নিটোল পায়ে রিনিক ঝিনিক,
পায়েলখানি বাজে,
মাদল বাজে সেই সংকেতে,
শ্যামা মেয়ে নাচে।।
পাগলপারা চাঁদের আলো
নাচের তালে মেশে—-
এই গানটা শোনা হয়নি, এমন বাঙালি সঙ্গীত প্রেমী বিরল। এর গীতিকার মীরা, তিনি যে কেবল তাঁর স্বামী শচীন দেব বর্মণের গানের নোটেশন সংরক্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন তা নয়। স্বামী ও পুত্রের চরম উৎকর্ষে পৌঁছে দেয়ার মাপকাঠি নির্দিষ্ট করেছিলেন। অবশ্যই নিজেকে প্রচারের আলোয় না এনে, থেকেছেন আড়ালে। অসামান্য সঙ্গীতের বোধ ও শিক্ষা তাঁর ছিল। তিনি ছিলেন একাধারে গীতিকার, সঙ্গীতশিল্পী ও নৃত্যশিল্পী। প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন, সেই সঙ্গে যুগের তুলনায় সঠিকভাবে তালিমও পেয়েছিলেন। শচীন দেব বর্মনের যে গান গুলোর সুরের আবেশে মাতাল হই আমরা এবং নিয়মিত গুনগুন করি সেগুলোর অনেক সুর-ই মীরা দেব বর্মণের সহায়তায় তৈরি হয়েছে ।
গোমতী কন্যা মীরা দেববর্মন। বাংলাদেশের ময়নামতি, কুমিল্লার সন্তান মীরা দাশ গুপ্তা, যিনি পরবর্তীতে দুনিয়া জোড়া খ্যাতি লাভ করেন মীরা দেব বর্মন নামে। ২০০৬ সালে ত্রিপুরা সরকার মীরাদেবকে বৃদ্ধাশ্রম থেকে মুম্বাইতে স্থানান্তর করেন। তাঁকে মুম্বাইতে প্রয়াত পুত্র রাহুল দেব বর্মনের বাড়িতেই আবার নিয়ে রাখা হয়। পরবর্তীতে ২০০৭ সালের ১৫ অক্টোবর দীর্ঘকালীন রোগভোগের কারণে গোমতী কন্যা মীরা দেব বর্মনের মহাপ্রয়াণ ঘটে।
————————————————–
প্রিয় নাহিদ/ ভালোবাসা জেনো। আজকের পর্বে গোমতী কন্যা মীরাদেব বর্মনের মহাপ্রয়ানের ঘটনাবলী লিখলাম। এই পর্বটি লিখতে অনেক কস্ট হলো। ফুল জমে পাথর হয়ে যাওয়ার মত। মীরাদেব বর্মন, শচীনদেব বর্মন, রাহুলদেব বর্মন ও তাঁর স্ত্রী আশা ভোঁশলেকে নিয়ে লেখার পর্ব কাহিনিতে মীরাদেব বর্মন পর্বটি শেষ করলাম। আগামী পর্ব গুলোতে ধারাবাহিক ভাবে সকলকে নিয়ে লিখব ইনশাআল্লাহ। তুমি সাথেই থেকো। এর মাঝে আর ফোনে কথা বলতে চাইনা। আর হ্যা, লেখাটার শুরুতেই এই চিঠিটি লিখতে পারতাম। কিন্তু লেখিনি। মীরাদেবকে বিশেষ সন্মান জানিয়ে আমার চিঠিটি শেষেই লিখলাম। ভালো থেকো তুমি।
-তোমারই রুমকী।
তথ্য সূত্রঃ সোমনাথ সেন গুপ্ত, ওমেন চ্যাপ্টার। ইঁচড়েপাকা। ইশরাত জাহান, পেজফোর ও উইকিপিডিয়া।
লেখকঃ লুৎফর রহমান একজন রাজনীতিবিদ ও লেখক। তিনি নিয়মিত লেখালেখির পাশাপাশি ইলেক্ট্রনিক নিউজ মিডিয়ার সম্পাদক ও প্রকাশক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র লুৎফর রহমান ৮০ এর দশকের স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরতে দুটি রাজনৈতিক উপন্যাস লিখেছেন, যা দেশ বিদেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় জীবনের খন্ডচিত্র এঁকে তিনি এখন ব্যাপক পরিচিত।
কিউএনবি/ নাহিদা /১৭.০৮.২০২৩/ বিকাল ৫.১০