মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫, ০৪:১০ পূর্বাহ্ন

বিশ্বকে যুদ্ধমুখী করছে কারা?

Reporter Name
  • Update Time : শুক্রবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
  • ৮২ Time View

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় গোটা একটি পরিবার। ওই হামলায় কয়েকজন আইএস জঙ্গিকে হত্যার দাবি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু পরে জানা যায়, আইএস সদস্য নয়, ওই ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছে সাত শিশুসহ ১০ বেসামরিক আফগান। এদের মধ্যে ছিল মালাইকা ও সুমাইয়া নামে দুই বছর বয়সি দুই শিশুও। শুধু ইয়েমেন কিংবা আফগানিস্তান নয়; গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, মানবাধিকার রক্ষা ও সন্ত্রাস দমনের নামে যুক্তরাষ্ট্রসহ তার পশ্চিমা মিত্র বাহিনীর হাতে দেশে দেশে এমন নৃশংস হত্যাযজ্ঞের হাজারো নজির রয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে দশকের পর দশক ধরে চলা যুদ্ধ-অস্থিতিশীল পরিস্থিতির নেপথ্যে কারা, তা হয়তো নতুন করে মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তবে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সামনে এনেছে নতুন এক প্রেক্ষাপট। পরিস্থিতি বিবেচনায়, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ন্যাটো তথা ইউরোপের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ধারণাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। আবার শঙ্কা জাগাচ্ছে ক্রমবর্ধমান চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বও। এসবের মধ্যেই একটি প্রশ্ন বেশ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে; তা হলো, বিশ্বকে আসলে যুদ্ধমুখী করছে কারা?

‘নাশকতা, হত্যা এবং বিস্ময়ের মধ্যদিয়ে শত্রুর মনোবল ভেঙে দাও, এটাই যুদ্ধের ভবিষ্যৎ’, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হিটলারের এ উক্তি মেনেই হয়তো ইউক্রেনে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। অন্যদিকে ‘সে-ই সাহসী, যে পালিয়ে না গিয়ে তার দায়িত্বে থাকে এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে’, সক্রেটিসের এ বাণী মেনেই যেন রুশ বাহিনীকে প্রতিরোধ করে আসছে কিয়েভ।

প্রায় এক বছরে গড়িয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। হতাহত-ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে যুদ্ধ বন্ধে এ সময়ের মধ্যে আলোচনায়ও বসেছে উভয় পক্ষ। তবে শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই ফলপ্রসূ হয়নি, বন্ধ হয়নি যুদ্ধও। কারণ, যখনই এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়েছে, তখনই সেখানে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে হাজির হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা তার পশ্চিমা মিত্ররা। অনেক বিশ্লেষক তাই বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ না হওয়ার ক্ষেত্রে দায় এড়ানোর সুযোগ নেই ওয়াশিংটনের। আর এর নেপথ্যে রয়েছে অস্ত্রব্যবসা, যার বড় প্রমাণ, ধারাবাহিকভাবে ইউক্রেনকে পশ্চিমাদের দিয়ে আসা অস্ত্রসহায়তা।

গণতন্ত্রের নামে ‘অপকর্ম’

যুদ্ধ রফতানি, চরমপন্থি মতাদর্শ এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা উসকে দেয়ার মাধ্যমে সারা বিশ্বে রক্তপাত ও অশান্তির অসংখ্য পথ তৈরি করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। ‘গণতন্ত্রের মডেল’ তার উজ্জ্বলতা হারালেও, এখনও তথাকথিত গণতন্ত্রের শীর্ষ সম্মেলনের নামে একচেটিয়া চক্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে দেশটি।

মার্কিন ইতিহাসবিদ পল অ্যাটউডের মতে, ‘যুদ্ধ হলো আমেরিকান জীবনযাত্রা। জন্ম, বেড়ে ওঠার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র পরাশক্তিও হয়ে উঠেছে যুদ্ধ, দাসত্ব এবং মানবহত্যা থেকে।’

১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে নিজেদের ২৪০ বছরেরও বেশি দীর্ঘ ইতিহাসে মাত্র ১৬ বছর কোনো যুদ্ধে লিপ্ত ছিল না যুক্তরাষ্ট্র। পরিসংখ্যান বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ১৫৩টি স্থানে সংঘটিত ২৪৮টি সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যে ২০১টি শুরু করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যা মোট সংঘটিত যুদ্ধ-সংঘাতের ৮০ শতাংশেরও বেশি। এছাড়া ২০০১ সাল থেকে মার্কিন বাহিনীর যুদ্ধ এবং সামরিক অভিযানে নিহত হয়েছেন আট লাখেরও বেশি মানুষ, অসংখ্য মানুষ হয়েছেন বাস্তুচ্যুত।

বিশেষজ্ঞ এবং পর্যবেক্ষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র তার নিজস্ব অসংগঠিত গণতান্ত্রিক রেকর্ডের বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে, ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার’ অজুহাতে বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ চালাচ্ছে এবং নিজেদের অসংখ্য অপরাধ এড়িয়ে যাচ্ছে। তারাই মানবিক বিপর্যয় ঘটিয়ে সার্বভৌম শৃঙ্খলা ধ্বংসের মাধ্যমে বিশ্বশান্তিকে হুমকিতে ফেলছে।


কেউ কেউ বলছেন, যুদ্ধ রফতানি অর্থাৎ নিজেদের স্বার্থে দেশে দেশে যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়ার এ সংস্কৃতিই যুক্তরাষ্ট্রকে একসময় সীমাহীন লজ্জা এবং বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেবে।

ধ্বংসযজ্ঞ

মার্কিন যুদ্ধযন্ত্র সারা বিশ্বেই বিদ্যমান, যা বিভিন্ন দেশকে বিশৃঙ্খল অবস্থায় ফেলেছে এবং ধ্বংস করেছে মানুষের জীবন-জীবিকা।

সঠিক তথ্য না থাকলেও ধারণা করা হয়, কোরিয়ান যুদ্ধে (১৯৫০-৫৩) ৩০ লাখের বেশি বেসামরিক নাগরিক এবং প্রায় ৩০ লাখ শরণার্থীর মৃত্যু হয়েছিল। যুদ্ধের সময় মার্কিন বাহিনী উত্তর কোরিয়ার গোয়েন্দা এজেন্টরা উদ্বাস্তুদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে, এমন আশঙ্কায় শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানায়। যার ফলে প্রাণ হারান আরও ৩০ হাজারের বেশি নিরীহ বেসামরিক মানুষ। অথচ এ যুদ্ধ এবং দুই কোরিয়ার বিভক্তির পেছনে বড় প্রভাব ছিল যুক্তরাষ্ট্রের।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে যখন মিত্রশক্তি জাপানের সাম্রাজ্য ভাঙতে শুরু করল, তখন দেশটির অধীন থাকা কোরীয় উপদ্বীপ হয়ে পড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তৎকালীন ইউএসএসআর (বর্তমান রাশিয়া)-এর মধ্যে দরকষাকষির বিষয়। সাবেক মিত্রশক্তির প্রত্যেকেই প্রত্যেককে অবিশ্বাস করতে শুরু করল। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৪৮ সালে ৩৮তম অক্ষরেক্ষায় সীমানা চিহ্নিত করে কোরীয় উপদ্বীপকে ভাগ করে দেয়া হলো, জন্ম নিল যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত পুঁজিবাদী দক্ষিণ এবং ইউএসএসআর সমর্থিত কমিউনিস্ট উত্তর কোরিয়ার।

একইভাবে রক্তাক্ত এবং নৃশংস ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধও (১৯৫০-৭০)। ভিয়েতনাম সরকারের অনুমান, এ যুদ্ধে প্রায় ২০ লাখ বেসামরিক লোক নিহত হন। যাদের অনেককে ভিয়েত কং কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে মার্কিন বাহিনী পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছিল। পরিসংখ্যান বলছে, মার্কিন বাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যতগুলো বোমা ফেলেছিল, তার চেয়ে তিন গুণ বেশি বোমা ফেলেছে ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়ায়।

নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, ১৯৭৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে প্রায় ৪০ হাজার ভিয়েতনামি ল্যান্ড মাইন, ক্লাস্টার বোমা এবং অন্যান্য অস্ত্রের মাধ্যমে নিহত হয়েছেন এবং পঙ্গুত্ববরণ করেছেন ৬৭ হাজার মানুষ। এ ছাড়াও ভিয়েতনামে প্রাণঘাতী রাসায়নিক ডাই-অক্সিন থাকা দুই কোটি গ্যালন ‘এজেন্ট অরেঞ্জ’ ফেলেছিল মার্কিন বাহিনী, পরবর্তী সময়ে যা বেশির ভাগ স্থানীয়র মাঝে ক্যানসারসহ অন্যান্য জটিল রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

মধ্যপ্রাচ্যেও আমেরিকার যুদ্ধের শিখা কয়েক দশক ধরে চলে।

১৯৯১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট উপসাগরীয় যুদ্ধ শুরু করার জন্য ইরাকে আক্রমণ করে, যার ফলে সরাসরি প্রায় সাড়ে তিন হাজার বেসামরিকের মৃত্যু হয় এবং বিমান হামলায় ধ্বংস হয় প্রায় ১০ হাজার বাড়িঘর। ইউনিসেফের তথ্যানুসারে, যুদ্ধজনিত দুর্ভিক্ষ এবং স্থানীয় অবকাঠামো ও হাসপাতালে ক্ষয়ক্ষতি বড় ধরনের মানবিক সংকট সৃষ্টি করে। এর জেরে প্রায় পাঁচ লাখ শিশুর মৃত্যু হয়।

২০০১ সালে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে আফগানিস্তানে সেনা পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। এ যুদ্ধে কেবল এক লাখ বেসামরিক লোক প্রাণই হারাননি, ২০ লাখের বেশি মানুষকে উদ্বাস্তুতে পরিণত করেছে। শুধু তাই নয়, তারা দেশটিকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলে গেছে যেখান থেকে তাদের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুনর্গঠনও বেশ কঠিন।

ব্যাপক আন্তর্জাতিক বিরোধিতা সত্ত্বেও, ২০০৩ সালে ইরাকে আক্রমণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যার ফলে আনুমানিক দুই থেকে আড়াই লাখ বেসামরিক লোকের মৃত্যু হয়। চীনের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যাপক ও পরিচালক সান দেগাং জানান, মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট ইরাকে ব্যাপকভাবে ইউরেনিয়াম, ক্লাস্টার এবং সাদা ফসফরাস বোমা ব্যবহার করেছে এবং বেসামরিক মানুষের ক্ষতি কমাতে কিছুই করেনি।

জাতিসংঘ বলছে, ইরাকে এখনও প্রায় আড়াই কোটি ল্যান্ডমাইন এবং অন্যান্য বিস্ফোরক অস্ত্র রয়েছে, যা অপসারণ করা প্রয়োজন। ব্রিটিশ তদন্ত সংস্থা এয়ারওয়ারস-এর এক প্রতিবেদন বলছে, যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তান, ইরাক এবং সিরিয়ায় অভিযানসহ কমপক্ষে ৯১ হাজার ৩৪০টি হামলা চালিয়েছে, যা সরাসরি অন্তত ৪৮ হাজার ৩০৮ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।

চায়না ফরেন অ্যাফেয়ার্স ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক লি হাইডং সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসকে বলেন, ‘যুদ্ধ হলো একটি মূল উপায়, যার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বিদেশি কৌশল বাস্তবায়ন করে এবং বিশ্বব্যাপী আধিপত্য অর্জন করে। উত্থানের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায়, দেশটি সবসময় একটি সামরিকীকরণের মানসিকতা মেনে চলে এবং কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সামরিক জোটের যৌথ কৌশলকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। পাশাপাশি নিজের প্রভাব বলয়কে সুসংহত করার কৌশলগত প্রয়োজন অর্জনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের ওপরই নির্ভর করে।’

অস্ত্র ব্যবসায়ীদের ‘সমৃদ্ধি’

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার একবার স্বীকার করেছিলেন যে, ‘যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে যুদ্ধবাজ জাতি।’ বিষয়টি অস্বীকার বা লুকানোর সুযোগও কম। কারণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে প্রায় সব মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাদের পদে থাকাকালীন বিদেশি যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন বা হস্তক্ষেপ করেছেন, যার পেছনে রয়েছে বিভিন্ন কারণ।

অধ্যাপক লি হাইডংয়ের মতে, ‘অনেক দেশ বিশ্বাস করে যে যুদ্ধ অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক এবং তা এড়ানো উচিত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে যুদ্ধ সমৃদ্ধি আনতে পারে এবং আমেরিকান সমাজের জড়তা দূর করতে পারে। একইভাবে যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রকে অত্যাবশ্যক এবং গতিশীল রাখে, যা ওয়াশিংটনের একটি অন্তর্নিহিত ধারণা এবং দেশটির ২৪০ বছরের উন্নয়ন ইতিহাসে অভিজাত গোষ্ঠীর ঐতিহ্যের অংশ।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন সামরিকবাদের পেছনে রয়েছে একটি গোষ্ঠীর বিশেষ অন্তর্নিহিত স্বার্থ। স্বাধীন মার্কিন থিংক ট্যাঙ্ক সিকিউরিটি পলিসি রিফর্ম ইনস্টিটিউটের প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে শীর্ষ পাঁচটি অস্ত্র কোম্পানি: রেথিয়ন, লকহিড মার্টিন, জেনারেল ডাইনামিক্স, বোয়িং এবং নর্থরপ গ্রুম্যান–মার্কিন কংগ্রেসে মোট ২ দশমিক ০২ ট্রিলিয়ন ডলার লাভ করেছে।

মনে করা হয়, বর্তমান মার্কিন সামরিক-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডিপ-স্টেট’ হয়ে উঠেছে, যারা বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফেডারেল সরকারের নীতি নির্দেশনা নিয়ন্ত্রণ করে। পাশাপাশি, সামরিক তহবিল অর্জনে তারা ওয়াশিংটনের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে লবিং এবং তাদের প্রচারাভিযানে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে।

উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ২০১১ সালে বলেছিলেন, ‘লক্ষ্য (যুদ্ধের) হলো আফগানিস্তানকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপের কালো টাকা সাদা করা এবং একটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা অভিজাতদের হাতে তা ফিরিয়ে দেয়া। সফল নয়, তাদের লক্ষ্য অন্তহীন যুদ্ধ।’

‘ক্যাপিটালাইজিং অন কনফ্লিক্ট: হাউ ডিফেন্স কন্ট্রাক্টরস অ্যান্ড ফরেন নেশনস লবি ফর আর্মস সেলস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০০০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে মার্কিন অস্ত্র ব্যবসায়ীরা ওয়াশিংটনের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে লবিং করার জন্য তাদের প্রচারাভিযানে ২৮৫ মিলিয়ন ডলার এবং দুই শতাধিক সাবেক সরকারি লবিস্ট নিয়োগের জন্য আড়াই বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে।

অনেক বিশ্লেষকের মতে, পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র চাইলেও যুদ্ধবাজ মনোভাব থেকে তাদের বের হয়ে আসার পথ নেই। এর বড় কারণ, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি কখনোই জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করেনি, বরং সামরিক-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স (যুদ্ধযন্ত্র) এবং ওয়াল স্ট্রিট করপোরেশনের হাতে ‘হাইজ্যাক’ হয়েছে। এ ছাড়া মার্কিন জাতীয় নীতিতে জনগণের খুব কম প্রভাব রয়েছে, যা গণতান্ত্রিক অনুশীলনের একটি ক্লাসিক ট্র্যাজেডিও বটে।

দীর্ঘস্থায়ী বিপর্যয়

প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্র যেসব যুদ্ধে জড়িয়েছে, তা অনেক দেশকে কেবল ব্যর্থ রাষ্ট্রেই পরিণত করেনি বরং আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতাও বাড়িয়ে দিয়েছে।

ভিয়েতনাম যুদ্ধ কয়েক দশক আগে শেষ হলেও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের ফলে দেশটি অর্থনৈতিক পতন, মুদ্রাস্ফীতি-মূল্যস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। যুদ্ধটি ভিয়েতনামের জনসংখ্যার লিঙ্গ অনুপাতে একটি গুরুতর ভারসাম্যহীনতাও সৃষ্টি করেছে। পুরুষের তীব্র ঘাটতি বাধাগ্রস্ত করেছে ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নকে।

মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের কেন্দ্রস্থল মধ্যপ্রাচ্যে পরিস্থিতি আরও গুরুতর ও জটিল।

সংবাদমাধ্যম ফ্রান্স টোয়েন্টি ফোরের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে ইরাকি জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছিল এবং বেকার ছিল দেশটির ২৫ শতাংশ যুবক। এ ছাড়া ২০১৯ সালে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিপুল তেল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও ইরাকের চার কোটি মানুষের প্রায় ৬০ শতাংশ প্রতিদিন ছয় ডলারেরও কম আয় করেন।

আশির দশকের শুরুতে ইরাক ছিল মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম ধনী দেশ। সেই সময়ে, দেশটির মাথাপিছু জিডিপি চীনের চেয়ে বেশি ছিল এবং এর আগে থেকেই হাইওয়ের মতো ভালো অবকাঠামো ছিল। কিন্তু যুদ্ধের পর ইরাক দরিদ্র দেশে পরিণত হয়েছে, যেখানে মানুষের জীবন-জীবিকার অবনতি হয়েছে এবং তীব্রতর হয়েছে জাতিগত সংঘাত।

মার্কিন আগ্রাসনের সবশেষ উদাহরণ হলো আফগানিস্তান। করোনা মহামারির আগে দেশটির অন্তত ৫৪.৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত, যেখানে ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭২ শতাংশে।

সর্বোপরি, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়ার মতো দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রদায়িক এবং জাতিগত সংঘাত উসকে দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। জীবন বাঁচাতে শরণার্থী হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে লাখ লাখ মানুষ। বিশ্লেষকদের মতে, এতে শুধু আর্থসামাজিক সমস্যাই তৈরি হয়নি, বরং চরমপন্থি হুমকি আমদানির দ্বারও উন্মোচিত হয়েছে।

একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র বছরের পর বছর ধরে ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে’ লড়াই করে এলেও, সন্ত্রাসবাদ এখনও একটি সত্যিকারের হুমকি রয়ে গেছে। টাইমসের সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়েছিল, ‘আমেরিকার সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে এমন এক প্রজন্মকে লালন-পালন করেছে, যাদের আদর্শ মধ্যপ্রাচ্য থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। যেখান থেকে এখন নতুন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইউরোপে নতুন আক্রমণের পরিকল্পনা করে।’

এটা এখন প্রমাণিত সত্য যে, যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছাকৃতভাবে অন্য দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ ও শক্তি প্রয়োগ করে এবং অন্য দেশের ওপর তার ‘গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ’ চাপিয়ে দিয়ে আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। তবে এমন কৌশল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ‘তিক্ত পরিণতি’ নিয়ে আসবে বলেই মনে করেন অনেকে।

 

 

কিউএনবি/আয়শা/০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৩/বিকাল ৩:০৮

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

July 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit