শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন প্রথম আলোকে বলেন, বিসিআইসির পাঠানো চিঠি তিনি এখনো পাননি। তবে সার গুদামে সরবরাহ না করার বিষয়টি জানার পরই মেসার্স পোটন ট্রেডার্সের বিষয়ে তদন্ত করতে বলা হয়। তদন্তে কারও বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সারের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের ব্যবসা সরকার বিসিআইসির মাধ্যমে পরিচালনা করে। দেশে কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য ইউরিয়া সার উৎপাদন করে প্রতিষ্ঠানটি। আবার ঘাটতি মেটাতে বিদেশ থেকে আমদানিও করে তারা। আমদানি করা সার বন্দর থেকে গুদামে নিতে ঠিকাদারদের দায়িত্ব দেয় বিসিআইসি। ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে একাধিকবার সার আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে, প্রমাণও পাওয়া গেছে।
বিসিআইসির নথিপত্র থেকে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আমদানি করা ৩ লাখ ৯৩ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া সার খালাসের পর সরকারি গুদামে পৌঁছে দিতে পোটন ট্রেডার্সের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। নিয়ম হলো, সারগুলো ৫০ দিনের মধ্যে গুদামে পৌঁছে দিতে হবে। সর্বশেষ ১০ ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, খালাস হওয়া সারের মধ্যে ৭২ হাজার টন গুদামে সরবরাহ করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পোটন ট্রেডার্স, যার বাজারমূল্য ৫৮২ কোটি টাকা।
পোটন ট্রেডার্সের গুদামে আমদানি করা সার মজুত আছে কি না, তা যাচাই করতে গত ১০ নভেম্বর বিসিআইসি দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। দুই কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে গত ৮ ডিসেম্বর। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, পোটন ট্রেডার্স গত অক্টোবরের শুরুতে জানিয়েছিল যে তাদের ৬টি গুদামে ৬৬ হাজার টন সার রয়েছে। তবে সরেজমিন তদন্তে দেখা গেছে, গুদামে আছে মাত্র ১ হাজার ৩০০ টন সার। এই সারও ব্যবহারের অনুপযোগী এবং কৃষক পর্যায়ে বিতরণযোগ্য নয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সার মজুত না থাকার বিষয়টি পোটন ট্রেডার্সের মহাব্যবস্থাপক শাহাদাত হোসেন ও মহাব্যবস্থাপক (পরিচালন) নাজমুল হোসেন স্বীকার করেছেন এবং এ–বিষয়ক নথিতে সইও করেছেন। বিষয়টি নিয়ে জানতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে শাহাদাত হোসেনের মুঠোফোনে কল করা ও খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠানো হয়। পাশাপাশি ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপে তাঁর নম্বরে প্রশ্ন লিখে পাঠানো হয়। তিনি সাড়া দেননি।
কামরুল আশরাফ খান ২০১৪ সালে নরসিংদী-২ আসনে জাসদের প্রার্থী জায়েদুল কবিরকে হারিয়ে সংসদ সদস্য হন। জায়েদুল মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেন। কামরুল আশরাফ খান আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। বর্তমানে এই আসনের সংসদ সদস্য তাঁর ভাই আনোয়ারুল আশরাফ খান, যিনি আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত। সার আত্মসাতের বিষয়ে কামরুল আশরাফ খানের বক্তব্য জানতে গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা এবং খুদে বার্তা পাঠানো হয়েছিল। প্রশ্ন পাঠানো হয়েছিল হোয়াটসঅ্যাপেও। তবে সাড়া পাওয়া যায়নি।
বিসিআইসি সূত্র জানায়, পোটন ট্রেডার্স সার সরবরাহ না করার বিষয়ে গত ১২ ডিসেম্বর বিসিআইসির বোর্ড সভায় আলোচনা হয়। ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা চাওয়া হবে। পোটন ট্রেডার্সের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন বিসিআইসির তৎকালীন চেয়ারম্যান শাহ মো. ইমদাদুল হক। তিনি গত ২৯ ডিসেম্বর অবসর–উত্তর ছুটিতে গিয়েছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি এখন দায়িত্বে নেই। তাই কোনো কথা বলবেন না।
বিসিআইসি একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২২–এর তথ্য বলছে, সর্বশেষ সাত অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ৩ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকার বেশি লোকসান দিয়েছে। এর মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৫২ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১০৩ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল বিসিআইসি।
জানতে চাইলে দুর্নীতি প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সার আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি যতই ক্ষমতাবান হন না কেন, তাকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। এখানে রাষ্ট্রের সম্পদ অপচয় ও ক্ষমতার অপব্যবহার হওয়ায় এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া সমীচীন হবে।