ক্রিস হেমসওয়ার্থ আর একজন লুছমি – পর্ব এক
———————————————————-
অর্ক বসে আছে সেই নীল ক্যাফেতে। আমার আসতে অনেক দেরী হয়ে গেলো। আজকে কোন ভাবেই আমার ইচ্ছে করছিল না আসি। তারপর ও আসলাম। কদিন থেকেই আমার মন ভীষণ খারাপ এটা অর্ক জানে। কিন্তু কেন মন খারাপ তা জানে না। আর আমিও অর্কর সঙ্গে প্রতারণা করতে পারবো না তাই আমি ইচ্ছে করেই সরে যেতে চাচ্ছি। আমি চাইনা মিথ্যা নিয়ে তার সঙ্গে চলি।
আমি নীল ক্যাফেতে ঢুকলাম। অর্ক বসে অপেক্ষা করছে বুঝতে পারছি। আমি বললাম, “সরি অর্ক তোমাকে অনেকক্ষন বসিয়ে রেখেছি। আমার আসতে দেরী হলো কারণ বিন্তির শরীর খারাপ ছিল। ” কোন সমস্যা নেই জয়া। আমি তোমার জন্য জনম জনম অপেক্ষা করতে পারি। বসো চায়ের অর্ডার দেই।”
“আচ্ছা অর্ক আমি খুব বেশী সময় দিতে পারবো না কিন্তু। “
“তুমি আমাকে কিছুদিন হলো এড়িয়ে যাচ্ছো,আমি তোমাকে ভীষণ পছন্দ করি সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো।”
“আমার জীবনের গল্প শুনলে তুমি আমাকে এড়িয়ে যাবে অর্ক।”
“এটা তোমার অবচেতন মনের ধারনা। আমি কখনো তোমাকে এড়িয়ে যাবো না জয়া। আমাদের পড়াশোনা শেষ দুজনেই চাকুরী করছি। আমরা কেন আর সময় নেব। “
আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলাম অর্কর সামনে। আমাদের কোন কথা নেই চুপচাপ বসে আছি।আমাদের সামনে ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ। আমি বললাম,
“অর্ক তুমি কী জান চা বাগানের শ্রমিকদের ইতিহাস। আর ইন্টারেস্টিং গল্প এ চায়ের সঙ্গে আমার গভীর ক্ষতের গল্প আছে। আমার জীবনের গল্প। আজকে না অন্য কোন দিন এ গল্প টা করবো আমার জীবনের গল্প। “
“আজকেই বল শুনি।”
অর্ক বলল।
আমি বললাম, “শুনে ভীষণ অবাক হবে তুমি অর্ক।
সকালে লবন দিয়ে একমগ চা তার সঙ্গে দুমুঠো চাল ভাজা,দুপুরে ভাতের সঙ্গে মরিচ ডলা তার সঙ্গে চা পাতার চাটনি,সন্ধ্যায় লবন চা,ও বনরুটি রাতে কখনো অনাহারে। এখানে জীবন মাপি ধ্রুব সময়ে… চায়ের চামচে জীবন বয়ে চলে। এর সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক আছে অর্ক। আমি এখন উঠবো অর্ক। “
—- চলো তোমাকে পৌঁছে দিব। আর গাড়িতে বসে তোমার চায়ের কাপের গল্প শুনবো জয়া।
আমি আর অর্ক এক সঙ্গে বের হলাম নীল ক্যাফে থেকে। অর্ক গাড়ি ড্রাইভ করছে। আমি পাশে বসে আছি। মৃদু ভলিউমে গান বাজছে লালনের গান। অর্ক লালনের গান খুব পছন্দ করে আর সে নিজেও ভীষণ ভালো গাইতে পারে লালনের গান।
অর্ক বলল,”কই গল্প শুরু করো জয়া।” আমি বললাম, “শোন ১৯২১ সালের ৩ মে কাছাড়ের চা বাগানের শ্রমিকরা এসে জড়ো হন করিমগঞ্জে রেলওয়ে জংশনে।সেখান থেকে শুরু হয় মুল্লুক চলো অভিযান। শ্রমিকরা বড়লেখা, জুড়ি পাড় হয়ে কুলাউড়া জংশন পৌঁছলে তাদের সঙ্গে যুক্ত হন সিলেট বরমচালের শ্রমিকরা। তখন সিলেট অঞ্চলের ২০ হাজার শ্রমিক যুক্ত হন কাছাড়ের ১০ হাজার শ্রমিকের সঙ্গে। কুলাউড়া থেকে শ্রীমঙ্গল , সাতগাঁও, শায়েস্তা গন্জ হয়ে তারা আসেন লাকসাম জংশনে।সেখান থেকে বদাখাল হয়ে চাঁদপুর। ২০ মে সর্বসাকুল্যে ৩০ হাজার চা শ্রমিক চাঁদপুরে পৌঁছেন পদযাত্রায়। এখানেই শুরু হয় ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকান্ড। “
“তারপর কী হলো জয়া?”
-“শোন বলছি,আন্দোলন শুরু হয় করিমগঞ্জ থেকে আর শেষ হয় চাঁদপুর এসে। এক প্রান্তে করিমগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন অন্য প্রান্তে চাঁদপুর রেল স্টেশন। আর আমাদের লেখকদের মধ্যে ঘটনার একপ্রান্তে ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী, আর অন্য প্রান্তে যাযাবর। দুই মাস এ আন্দোলনের সময় সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন সিলেট এমসি কলেজের সদ্য পাশ করা যুবক। চা আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন সিলেট। তার বাবা ছিলেন সাব- রেজিস্ট্রার। ১৯১৯ সালে সিলেট ভ্রমণের সময় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় হয়। ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি সেখানে ভর্তি হন। সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন শান্তিনিকেতন প্রথম দিকের ছাত্র। “
“তারপর কী হলো? “
-” তিনি চা শ্রমিকদের আন্দোলনের স্মৃতিবাহী পথ ধরে চাঁদপুর হয়ে কলকাতা যান। অন্য দিকে এ ঘটনার প্রতক্ষ্যদর্শী ছিলেন বিনয় মুখোপাধ্যায়, আর তিনি যাযাবর নামে পরিচিত। এ সময় যাযাবরের পিতা ফনীভুষণ মুখোপাধ্যায়ের কর্মস্থল ছিল চাঁদপুর। আর যাযাবর ছিলেন চাঁদপুর জুবিলী স্কুলের ছাত্র। “
সমসাময়িক দুজন লেখকের লিখায় চা আন্দোলনের প্রভাব আছে। আর সিলেটের পটভূমিতে লেখা সৈয়দ মুজতবা আলীর “পাদটীকা ” গল্পের সঙ্গে চা শ্রমিকদের দুঃখ গাঁথার একটা তুলনামূলক চিত্র উপস্থাপন করা,যায়।
— অর্ক বলল,
“পাদটীকা ” গল্পের প্রধান চরিত্র পন্ডিত মশাইয়ের মাসিক বেতন ২৫ টাকা । মোট ২৫ টাকায় চলে পন্ডিত মশাইয়ের ৮ সদস্যের সংসার। অন্য দিকে লাট সাহেব তার কুকুরের পেছনে খরচ করেন ৭৫ টাকা। পন্ডিত মশাইয়ের প্রশ্ন সে কুকুরের যদি ৩টি ঠ্যাং হয় আর প্রতিটি পায়ের পেছনে যদি ২৫ টাকা খরচ হয় তাহলে ব্রাহ্মণ পন্ডিতের পুরো পরিবার লাট সাহেবের কুকুরের কয়টা ঠ্যাংএর সমান। এখানে হৃদয় বিদারক তিক্ত হাস্যরসের মধ্যে লুকিয়ে আছে প্রভু ইংরেজ আর দেশীয় মানুষদের জীবন মানের বিশাল পার্থক্যের করুন কাহিনি। “
আমি অর্ককে বললাম,
“জান আমার কাহিনি ও এরকম করুন। বলবো তোমাকে অন্য কোন দিন। “
অর্ক গাড়ি ড্রাইভ করছে । ওকে দেখে খুব চিন্তিত মনে হলো। আমি খুব ভালো করে অর্ক কে খেয়াল করলাম। (চলবে)
লেখিকাঃ শাহানা জেসমিন নিয়মিত লেখালেখি করেন। পেশাগত জীবনে তিনি একটি সরকারী স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা।বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন সাহিত্যমূলক পেজ ও গ্ৰুপে তাঁর লেখা প্রকাশ পেয়ে থাকে। জীবনের গল্প সৃষ্টিতে অনুপম দক্ষতা শাহানা জেসমিন এর। জীবনের খন্ডচিত্রকে জোড়া লাগিয়ে তিনি আঁকতে পারেন জীবনবোধ সম্পন্ন গল্প, কাহিনী। ”ক্রিস হেমসওয়ার্থ আর একজন লুসমি” শিরোনামে তাঁর এই ধারাবাহিক গল্প কাহিনী এক যুদ্ধ শিশুকে নিয়ে।
কিউএনবি/বিপুল/২৬.১২.২০২২/ সন্ধ্যা ৭.০ ৩