বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১২:৪৪ পূর্বাহ্ন

রুপা মোজাম্মেল এর জীবনের গল্পঃ পূজা দেখতে যাওয়া

রুপা মোজাম্মেল। কানাডা প্রবাসী।
  • Update Time : বুধবার, ৫ অক্টোবর, ২০২২
  • ১৩০৪ Time View

 পূজা দেখতে যাওয়া
————————-

ঢং ঢং ঢং, টিং টিং টিং টিং, হুলুলুলুলুলুলুলু…. পাশেই মন্দির, আর এই শব্দ গুলোতে সকাল সকাল চোখ খুলতো যখন খালার বাসায় বাংলাবাজার যেতাম। খুব উপভোগ করতাম সেই সকাল গুলো।

বলতে গেলে প্রায় পুরো মহল্লাটাই হিন্দু মহল্লা ছিল। এই মহল্লার মানুষ গুলোর আন্তরিকতার কোনো কমতি ছিল না। ভীষন ভালো লাগতো। এক ছাদের সাথে আরেক বাসার ছাদ মনে হতো জোড়া লাগানো।

আমার খালা আমাদের নিজের বাচ্চার মত আদর করতেন। আমরা উনাকে আম্মু ডাকি। আম্মুর বাসায় বেড়াতে খুব ভাল লাগতো।

পূজার সময় সেখানে গেলে দেখতে পেতাম, পুরোটা মহল্লা উৎসবে গমগম করছে। আসেপাশের বাসা থেকে প্লেট ভরে ভরে নাড়ু মুয়া আসতে থাকতো। খুব মজা করে খেতাম, আর দোয়া করতাম যেনো প্রতিবার পূজার সময় আম্মুর বাসায় আসতে পারি। তাহলে পূজাও দেখতে পারি আর নাড়ু মুয়া ও খেতে পারি। বাসায় থাকলে আম্মা, আব্বুর ভয়ে পূজা দেখাতো দূরের কথা, ঘর থেকেই বের হওয়া অসম্ভব।

তখন বয়স ১০/১১ হবে, খুব ইচ্ছা দুর্গা পূজা দেখতে যাব। মনে মনে প্ল্যান করি কিভাবে যাবো, কিন্তু প্ল্যান সব ফেল হয়। একবার যা আছে কপালে ভেবে লুকিয়ে লুকিয়ে বিকেলে একাই বের হলাম দুর্গা পূজা দেখতে। সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরে এলেই আম্মা বুঝতেই পারবে না আমি কোথায় গিয়েছিলাম।

শুনেছি মন্দিরের প্রসাদ খেতে অনেক মজা! অনেক কিছু এক সাথে মাখিয়ে পূজারী নাকি সবার হাতে একটু একটু করে দেয়, আর সেটা খেতে নাকি অম্মৃতের মত লাগে। ওটা আমাকে খেতেই হবে। খুশিতে দৌড়াতে লাগলাম।

এক মন্দিরে গেলাম, গিয়ে অনেকক্ষণ মন্দিরের সামনে দাড়িয়ে রইলাম। চোখ ঝলমল করতে লাগলো মূর্তি গুলোর সাজসয্যা দেখে! কত সুন্দর শাড়ী, গয়না, মাথায় বিশাল মুকুট। অবাক হয়ে শুধু দেখছিলাম আর দেখছিলাম, দুর্গার দশ হাত, আর এই হাতে কত শক্তি! সে একজন মানুষকে বল্লম ও মারতে পারে! আবার তার কপালেও একটা চোখ আছে!

হঠাৎ পেছন থেকে কানে ভেসে এলো কেউ বলছে –
— চলরে, মাধব বাড়ির ঠাকুর এই বছর সবচেয়ে বড় আর সুন্দর বানিয়েছে, দেখে আসি চল, পুরা রাস্তাও নাকি লাল নীল লাইট দিয়ে সাজিয়েছে, চলরে…।

আমি মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম একদল ছেলে মেয়ে চলছে মাধববাড়ির ঠাকুর দেখতে। কিছু না ভেবে আমিও চললাম তাদের পিছু পিছু হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার সেই ইদুর গুলির মত। শুধু ভাবতে লাগলাম এই মন্দিরের দুর্গা এত বড় আর এত সুন্দর, তাহলে মাধব বাড়ির দুর্গা কত বড় আর কত সুন্দর হতে পারে!

মাঝপথে এসে হঠাৎ মনে পড়লো প্রসাদ খাওয়া হয়নি, আফসোসের আর শেষ রইলো না।
আবার ভাবলাম ধুর, বড় মন্দিরেতো যাচ্ছি, ওখানে গিয়ে খাবো। অনেক দূর হাঁটলাম সবার পিছু পিছু, কাউকে চিনিও না। শুধু রাস্তা খেয়াল রাখছিলাম বাসায় যেনো ফিরতে পারি।

কেউ আবার বললো –
— এই দেখ দেখ, ঐতো দূরে লাইট দেখা যাচ্ছে!
আমিও সাথে সাথে দেখার চেষ্টা করলাম। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসাতে লাইট গুলো দুর থেকে বিয়ে বাড়ির মত জ্বলছিল।

অবশেষে মন্দিরে এলাম। কি সুন্দর কি সুন্দর বলে মন নেচে উঠলো! এতো বড়ো পূজার মূর্তি আর কখনোই দেখিনি! মন্দিরের সামনে কয়েকজন ঢোল বাজাচ্ছে, আবার কয়েকজন সেই তালে তালে নাচছে।

ভীড় ঠেলে ঠুলে মন্দিরের একদম সামনে গিয়ে পৌঁছলাম। পূজারী ধুপ দিচ্ছে আর ঘন্টি বাজাচ্ছে টিং টিং টিং টিং। পূজারীকে সেই মূর্তির সামনে লাগছিল একদম ছোট। অনেকক্ষণ রেলিং ধরে ঠায় দাড়িয়ে রইলাম, কেউ সরাতে পারেনি। হঠাৎ পূঁজারী হাত বাড়িয়ে আমাকে মিষ্টি কিছু দিলো, আমি হাত বাড়িয়ে নিয়ে সাথে সাথে খেয়ে ফেললাম। কি মজা, মুখের ভেতর একদম যেনো মিশে গেলো। অনেক লোভ হচ্ছিল পূঁজারীকে বলি আরেকটু আমাকে দিতে, কিন্তু সাহস করতে পারছিলাম না।

হঠাৎ মনে পড়লো আমি তো সন্ধা হওয়ার আগেই বাসায় যেতে চেয়েছিলাম। এখন তো চারপাশ অন্ধকার! ভয়ে বুক কাপতে লাগলো। তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে। যেখান থেকেই বের হতে চাই, সব এক রকম লাগছে। চারপাশ ত্রিপল দিয়ে ঘেরাও করা। রাস্তা চিনতে পারছি না। কান্না আসছে, কিন্তু মানিজ্যতের ভয়ে কান্তেও পারছিনা। এভাবে রাস্তায় দাড়িয়ে কি কান্না করা যায়, ভীষন লজ্জা।

অনেকক্ষণ এদিক সেদিক ছুটা ছুটি করলাম। আম্মা আব্বুর রাগান্বিত মুখ চোখের সামনে ভেসে ভেসে উঠল।
হঠাৎ কেউ বললো –

— এই, এটা রুপা না?

আমি তাকিয়ে দেখি মহল্লার এক মামা। মামাকে দেখেই কেঁদে ফেললাম।

— তুমি কার সাথে এসেছো?

— একা একা ভ্যা….. আমি রাস্তা ভুলে গেছি। কিভাবে বাসায় যাবো রাস্তা চিনি না, ভ্যা…..আম্মা মারবে, ভ্যা…..
— কাঁদে না মামা ছিঃ চোখ মুছো। ভাগ্য ভালো আমিও পূজা দেখতে এসেছিলাম। চলো তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেই।

মামা একটা রিক্সা ডাকলো। আমাকে সাথে করে বাসায় পৌছে দিল।

আর এদিকে আমাকে খুঁজা খুঁজি শুরু হয়ে গিয়েছিল পুরো মহল্লায়।

আমাকে পেয়ে আম্মা প্রথমে দুর্গাপূজার ঢোলের মত কতক্ষন বাজিয়ে নিলেন। তারপর কান ধরে জিজ্ঞেস করলেন কোথায় গিয়েছিলি বল?
আমার ফিল হতে লাগলো, কান দিয়ে দুর্গা পূজার ধূপের ধোঁয়া বের হচ্ছে।

 

 

লেখিকাঃ রুপা মোজাম্মেল লেখাপড়া শেষ করে কানাডা প্রবাসিনী হয়েছেন। পুরো পরিবার নিয়ে কানাডায় থাকেন, সেখানেই তাঁর কর্ম জীবন। লেখালেখি করেন নিয়মিত। জীবনের খন্ডচিত্র আঁকতে পারদর্শিনী রুপা মোজাম্মেল। আজকের গল্পটি তাঁর কাছ থেকে সরাসরি সংগৃহিত।

 

 

 

কিউএনবি/বিপুল/০৫.১০.২০২২/ রাত ৯.৪৪

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

May 2024
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit