নাহিদ-রুমকী – নিজ দলে বিবাদমান গ্ৰুপিং
—————————————————
আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট ৮৯ এর ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন পরবর্তী অনেক ঘটনায় আমি জড়িয়ে গেলাম নানাভাবে। একটার পর একটা ঝামেলা ঘাড়ের উপর জেঁকে বসতে শুরু করল। এরপরে নিজদলের উপকোন্দল জটিল আকার ধারণ করছে। ঘটনা বড়ভাইকে কেন্দ্র করে। কারান্তরীণ বড়ভাইয়ের অবস্থানকে ভেঙেগুড়ে চুরমার করে দেয়ার জন্যে একটি শক্তিশালী পক্ষ কাজ করছে। এর মধ্যে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ক্যাম্পাসে গ্ৰুপিং রাজনীতিতে একটি মোক্ষম অবস্থান তৈরী করতে সক্ষম হয়েছে ছাত্রনেতা মম। ক্যাম্পাস সহ ঢাকা শহরে ঠান্ডা মাথায় মানুষ খুন করার রেকর্ড যার মধ্যে আছে।
কথাগুলো শুরু করেছে নাহিদ। এরশাদ বিরোধী ছাত্রআন্দোলনের তুঙ্গ অবস্থায় ইতিহাসের পাতা উল্টাচ্ছে নাহিদ। এরমধ্যে সে রুমকী প্রসঙ্গ তুলতেও ভুললনা। নাহিদ বলছে, কি জানি শুরু হল আমাদের দুজনের মাঝে। কোন ঝগড়াও না, কোন দ্বন্দ্বও না। কিন্তু স্পষ্টতঃ অনুভব করছি আমাদের দুজনের মধ্যে একটা শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। তিল তিল করে রুমকী আর আমার মাঝে দূরত্ব বেড়েই চলেছে।
২০শে মার্চ ৮৯ এ দোয়েল চত্বরের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জিনেসিয়াম মাঠে ডাকসুর অভিষেক অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কবি বেগম সুফিয়া কামাল। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এদিন অভিনব এক প্রতিবাদ প্রদর্শন করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিজয়ে ডাকসুর অভিষেক মঞ্চের সামনে মুখে কালো কাপড় বেঁধে অবস্থান নেয় ছাত্রদল। বলতে গেলে মঞ্চের সম্মুখভাগের পুরো দখল নিয়েছে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। এদিন আমি সবচেয়ে নজরকাড়া ভূমিকা রাখতে সক্ষম হই। এই অনুষ্ঠানে রুমকীও উপস্থিত ছিল। অনুষ্ঠানের মাঝামাঝি সে আমাকে জিমনেসিয়াম মাঠ থেকে বের করে তিন নেতার মাজারের দিকে টেনে নিয়ে গেল।
রুমকী কিছুটা রাগান্বিত, বিরক্ত এবং বিভ্রান্ত। কণ্ঠে রুক্ষতা নিয়ে সে আমাকে কিছু কঠিন কথা শুনিয়ে দিল। নাহিদ তুমি কি করছ তা কি তুমি বুঝতে পারছ ? দিন দিন তুমি রাজনীতি নিয়ে উচ্ছন্নে যাচ্ছ। এ অবস্থা চললে আমাদের সম্পর্কটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে আমি বলতে পারছিনা। রুমকী ঘন ঘন শ্বাস ফেলে কথাগুলো বলছে। তার সমস্ত রাগ যেন নিঃশ্বাস দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। আমি যতই রুমকীকে রিলাক্স হতে বলছি, ততই সে উগ্রমূর্তি ধারণ করা শুরু করল। একপর্যায়ে সে রাগে হন হন করে ছুটে গিয়ে রিকশায় উঠে পড়ল। আমি রুমকীর চলে যাওয়ার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি শুধু।
সেদিন সন্ধ্যায় কোথা থেকে বন্ধু শফিক এসে জুটল জানিনা। সে আমাকে নিয়ে গেল সাকুরায়। শেরাটনের সামনে সাকুরা বারে দুজনে ড্রিংক করলাম গলা পর্যন্ত। আমার কোন নেশার অভ্যেস নেই। কিন্তু রুমকী আমার সঙ্গে এত খারাপ ব্যবহার করল যে আমি আর কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমার এই মোক্ষম অসহায় মুহূর্তে শফিক আমাকে হাত বাড়িয়ে দেয়। নেশার রঙিন জগতে আমাকে প্রবেশ করায়।
ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া শুরু হয়ে গেছে। ছাত্রদলের বিবাদমান দুটি গ্রূপ স্বসস্ত্র অবস্থান নিয়ে চলছে। সূর্যসেন মুহসিন হলে একটি গ্ৰুপ এবং জসিমুদ্দিন হলে অপর গ্ৰুপটি মূল স্বসস্ত্র অবস্থান গ্রহণ করলেও কমবেশি সকল হলেই এর প্রভাব পড়তে শুরু করল। অস্ত্র সংগ্রহ করা, অস্ত্র কেনা একটা ফ্যাশনে যেন দাঁড়িয়ে গেল। মাঝারি শ্রেণীর ছাত্রদলের যে কর্মীটি কোনদিন অস্ত্র দেখেনি সে কিনা রাতে হলের ছাদে কোমরে কাটা রাইফেল কিংবা পিস্তল নিয়ে হল পাহারা দেয়।
আমি কৌশলগত কারণে কিছুটা মাঝামাঝি অবস্থান গ্রহণ করলাম কিন্তু আমার সখ্যতা মুহসিন-সূর্যসেন হল কেন্দ্রিক গ্ৰুপ টির দিকেই। আমার উঠাবসা আপেক্ষিক ভাবে বেশি হতে লাগল এই দুই হলের সঙ্গেই। যদিয় ক্যাম্পাসে আমার পরিচিতিটা কারান্তরীণ বড় ভাইয়ের পক্ষে বলেই সকলই জানে। তারপরেও আমাকে প্রতি মুহূর্তে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সাথে জীবন অতিবাহিত করতে আমি বাধ্য হচ্ছিলাম।
কমল আর মুহিদ এই দিন গুলোর কথা সবই জানে। হয়ত এতকিছু জানেনা রুমকী, জানেনা নিপা। নাহিদ এ কারণে এই দিনের টুকরো টুকরো কথা গুলো বলার চেষ্টা করছে। ছাত্রদলের গ্ৰুপিং রাজনীতিতে মুহিদ ও কমল ছিল পরস্পর বিরোধী। দুজন ছিল দুই মেরুর বাসিন্দা। এবারে কমল মুখ খুলে বলল, বড়ভাইতো জেলে। বড় ভাইর পক্ষে মিয়াভাই মুহসিন হলে থেকে তার প্রতিনিধিত্ব করার চেষ্টা করছিল। মিয়াভাইর গ্ৰুপে আমার অবস্থান কি ছিল তোরা জানিস। এবারে আমি কিছু ভিতরের কথা বলতে চাই।
লেখকঃ লুৎফর রহমান। লেখক, রাজনীতিবিদ। ‘৮০ এর দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র ছিলেন। বাংলাদেশের বৃহত্তম এক ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। নিজে স্বক্রিয় ভাবে এরশাদ বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করে তৎকালীন ”ক্যাম্পাস উপাখ্যান” এর কাহিনী তুলে এনেছেন তিন দশক পরে। ধারাবাহিক ভাবে এই পর্ব কাহিনী আমরা প্রকাশ করছি তাঁর ফেসবুক টাইমলাইন থেকে সংগ্রহ করে।
কিউএনবি/বিপুল/১৩.০৮.২০২২/ রাত ৮.৫৫