অফিস থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে নাহিদ। হোয়াটস্যাপ এ কলটি এলো তখনই। নিউয়র্কের কুইন্সের কিউ গার্ডেন থেকে কল করেছে রুমকী। নিজের রিভলবিং চেয়ারে গা টা এলিয়ে দিয়ে রুমকীর কল রিসিভ করল নাহিদ। শুরুতেই কুশল বিনিময় করল দুজনে।
নাহিদ কথার ফাঁকে ফাঁকে ভাবছে, রুমকী নিশ্চয়ই বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সংকট নিয়ে কথা শুরু করবে। কিন্তু এখনও শুরু করেনি। নাহিদ মনে মনে হাসছে। দেখি, রুমকী আজ নিজের থেকে কি কি নিয়ে কথা বলে ? নিজের থেকে সে কিছুই শুরু করতে চায়না। দেশকে নিয়ে কতটুকু ভাবে রুমকী, নাহিদ জানতে চায়।
রুমকী সাম্প্রতিক দেশ বিদেশের কোন বিষয় নিয়েই কোন কথা বলছেনা। রুমকী যে বিষয় নিয়ে কথা বলতে চায়, সে বিষয় নাহিদের জন্যে বড় কষ্টের। বেদনা মিশ্রিত অতীত। সে এক ধূসর নস্টালজিয়া।
মনে আছে নাহিদ? একবার এরশাদ ভ্যাকেশন হলো। তুমি আমি দুজনেই বাড়ীতে চলে গেলাম। প্রায় দুই মাস ক্যাম্পাস বন্ধ। বিকেল হলেই তুমি আমার বাসা আসতে। আমরা দুজনে কত বিষয় নিয়েই যে কথা বলতাম। তোমার কি সেই কথাগুলো মনে আছে ? নাহিদ বললো, সব মনে আছে আমার।
তুমি খুব সাহিত্য আর সংগীত প্রিয় ছিলে। আমাদের আলোচনার বিষয়গুলো বরাবরই সাহিত্য আর সংগীত ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। নাহিদ, তুমি ছিলে খুব আবেগপ্রবন একজন মানুষ। তুমি যেদিন আমাকে নিয়ে ঢাকায় ফিরলে, সেদিন নাইটকোচে সারারাত তুমি তোমার পছন্দের গান গুলো বাজিয়েছিলে। সিনেমার ঝাকানাকা গান শোনা যাত্রীরা সেদিন তোমার কারণে বড়ই বিরক্ত হয়েছিল। রুমকী একটানা স্মৃতি চারণ করে যাচ্ছে।
নামে নাইট কোচ। কিন্তু আমাদের ওখান থেকে নৈশকোচ ছাড়ত বিকালে। তুমি আমাকে নিয়ে নাইটকোচে ঢাকার উদ্যেশ্যে রওয়ানা দিলে যেদিন, সেদিন ভরা জোসনায় ছিল পূর্ণিমার রাত। বগুড়া পার হওয়ার পর রাতের অন্ধকার শুরু হত। নগরবাড়ীতে ফার্স্ট ফেরী ধরার জন্যে শা শা করে ছুটছে হিনো নাইট কোচ। পূর্ণিমার ভরা জোসনায় চারিদিকে ঝলমল করছে। বাসের জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস তোমার আমার চুল উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাসের ক্যাসেটে তখন বাজছে কিশোর কুমারের গান-
চিরদিনই তুমি যে আমার
যুগে যুগে আমি তোমারই
আমি আছি সেই যে তোমার
তুমি আছো সেই আমারই।
রুমকী, কি হয়েছে তোমার ? এই সব পুরোনো দিনরাত্রীর কথা বলে কি লাভ ? নাহিদ জিজ্ঞাসা করল রুমকীকে। রুমকী বলল, অতীতটাই এখন আমাদের সম্বল। এছাড়া আর কিইবা আছে আমাদের। নাইট কোচে সেদিনের রাতটি ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত। এক মুহূর্তের জন্যে তোমার হাতের মুঠোর বাইরে ছিলনা আমার হাত। রুমকীর গলায় ভাবাবেগ ছড়িয়ে পড়ছে। ফোনের এই প্রান্ত থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে নাহিদ।
এবার নাহিদই প্রসঙ্গ পাল্টাল। তুমি কি দেশের কোন খবর রাখছ ? কি হচ্ছে দেশে ? রুমকী বলল সব খবরই টিভি, নিউজ মিডিয়া আর ফেসবুক থেকে পাচ্ছি। লোড শেডিং, ভ্যাপসা গরমে হাঁসফাঁস করছে দেশের মানুষ। উর্ধমূল্যের নাভিশ্বাসে প্রচন্ড তাপদাহের চেয়েও নাস্তানাবুদ হচ্ছে দেশের মানুষ। সব খবরই রাখি। তবে অবাক হলাম, এত কিছুর পরেও সরকার অসতর্ক। মেট্রোরেলের ব্যয় বেড়ে গেল।
নাহিদ রুমকীর কথা কেড়ে নিয়ে বলল, মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) একনেক সভায় উঠেছে মেট্রোরেল মেগা প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব। প্রস্তাবনা অনুযায়ী, প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ছে দেড় বছর। ব্যয় বাড়বে ১১ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা। একইসঙ্গে দৈর্ঘ্য বাড়বে ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার। মোট ব্যয় দাঁড়াবে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। সর্বশেষ মেট্রোরেলের ব্যয় নির্ধারিত ছিল ২১ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা।
অবশেষে বিদ্যুৎ প্রসঙ্গ নাহিদ তুললো। রুমকী এর জবাবে শুধু একটি কথাই বলল, প্রতিকূলতার মুখে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। যুক্তি হিসাবে সরকার বিদেশের অবস্থাও তুলে ধরছে। কিন্তু এই সকল যুক্তি প্রতিষ্ঠার পিছনে সরকারের নৈতিক অবস্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। একটি মানুষ যখন নৈতিক অবস্থা হারিয়ে ফেলে তখন তার সত্য কথাটাও কেউ বিশ্বাস করতে চায়না। সরকারের মূল সমস্যা এখানেই।
রুমকী এবার বিদায় নিতে চায়। নাহিদ বলল, কিপ ইন টাচ। কল দিও নিয়মিত।
লেখকঃ লুৎফর রহমান। রাজনীতিবিদ, কলামিস্ট।
কিউএনবি/বিপুল/ ২২.০৭.২০২২/ রাত ১১.৪০