জীবন খাতার প্রতি পাতা- ২
——————————–
হুগলী মোহসিন কলেজ গেট দিয়ে বের হয়ে হাঁটছি আমরা দুজন। সংকেত দা শুরু করলেন হুগলী মোহসিন কলেজের ফুটবল টিমের গোলকিপার শ্যামল মিত্রের কাহিনী।
শ্যামল মিত্র ১৯২৯ সালের ১৪ জানুয়ারি জন্ম গ্রহণ করেন মৃত্যুবরণ করেন ১৫ নভেম্বর ১৯৮৭ সালে। পশ্চিম বাংলার এক প্রখ্যাত গায়ক, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের সবচেয়ে জনপ্রিয় গায়কদের অন্যতম। তার অনেক গান আজও বাঙালি শ্রোতাদের কাছে আদৃত। তার সুর করা জনপ্রিয় চলচ্চিত্র হল আনন্দ আশ্রম ও অমানুষ। তার পুত্রের নাম সৈকত মিত্র।
শ্যামল মিত্রের জন্ম বৃটিশ ভারতের অবিভক্ত চব্বিশ পরগনা জেলার নৈহাটিতে। অবশ্য তাদের আদি নিবাস ছিল হুগলি জেলার শিয়াখালার নিকটবর্তী পাতুল গ্রামে। পিতা ছিলেন নৈহাটির খ্যাতনামা চিকিৎসক সাধনকুমার মিত্র। তিনি চাইতেন শ্যামল তার মত একজন চিকিৎসক হন। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই শ্যামল মিত্র খুব গান ভালবাসতেন। মাতা প্রতিভাময়ী এবং স্থানীয় গায়ক মৃণালকান্তি ঘোষের অনুপ্রেরণায় সঙ্গীতেই আকৃষ্ট হন এবং সেই মতো সঙ্গীত শিক্ষা চলতে থাকে। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সদস্যরা প্রায়ই তাদের বাড়িতে বাবার কাছে আসতেন। তাদের সূত্রে তরুণ শ্যামল মিত্রের যোগাযোগ ঘটে সলিল চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি ভগিনী রেবাকে নিয়ে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ আয়োজিত পথসভায় প্রথম গাইলেন ও আলোর পথযাত্রী।
শ্যামলের প্রাথমিক শিক্ষা স্থানীয় স্কুলে। হুগলি মহসিন কলেজ থেকে আই.এ এবং কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন। তাঁর সঙ্গীত শিক্ষার গুরু সুধীরলাল চক্রবর্তী পরে শেখেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে।
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে শ্যামল মিত্র প্রথম রেকর্ড করেন সুধীরলাল চক্রবর্তীর সুরে। বিখ্যাত সুরকার সুবল দাশগুপ্ত, অনুপম ঘটক, হিমাংশু দত্ত, রবিন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে অনেক গান গেয়েছেন। তার রেকর্ডের সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার হাজার। প্রথম প্লে ব্যাক গায়ক হিসেবে ১৯৪৮ সালে ‘সুনন্দার বিয়ে’তে সাড়া ফেলেন। অনেক ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন তিনি। হিন্দি চলচ্চিত্রে বেশ কয়েকটি হিন্দি গানের সুরও তার দেওয়া।
মোহনাদি’র বাড়ী আরও কিছুটা দূরে। আমরা হাঁটছি। সংকেত’দা এবার শুরু করলেন হুগলী মোহসিন কলেজের আরেক ছাত্রকে নিয়ে। তিনি আর আর কেউ নন, দুই বাংলার জনপ্রিয় শিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। ড.সংকেত গঙ্গোপাধ্যায় শিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে বলতে গিয়ে বললেন, কোলকাতায় লতা মুঙ্গেশকর এসেছেন একটি অনুষ্ঠানে গান গাইতে। গান শুরুর আগে তিনি বলেছিলেন, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম না হলে বাংলা গানের একটি অধ্যায়, একটি স্তর, একটি শাখা চিরদিনই অজ্ঞাত থেকে যেত। সংকেত দা শুরু করলেন এবার সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের জীবন কাহিনী।
সতীনাথ মুখোপাধ্যায় ১৯২৩সালের ৭ জুন জন্মগ্রহণ করেন, মৃত্যু বরন করেন ১৩ ডিসেম্বর ১৯৯২ সালে। একজন খ্যাতিমান বাঙালি কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার ও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। তিনি আধুনিক বাংলা গান, নজরুল সংগীত ও গজল শিল্পী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
সতীনাথ মুখোপাধ্যায় ১৯২৩ সালে ভারতের লখনউতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা তারকদাস মুখোপাধ্যায়। পিতার চাকরিসূত্রে লক্ষ্ণৌতে জন্ম হলেও ছোটবেলাতেই সতীনাথ চলে আসেন হুগলির চুঁচুড়ায়। এখানেই তার বেড়ে ওঠা ও বিএ পর্যন্ত লেখাপড়া সম্পন্ন করেন হুগলী মোহসিন কলেজে। এরপর এমএ পড়ার জন্য কলকাতা আসেন।
ছোটবেলা থেকেই সতীনাথ সংগীতানুরাগী ছিলেন ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, ধ্রুপদ-ধামার-টপ্পা শেখেন। তার ঠাকুরদা রামচন্দ্র বেহালা বাজাতেন ও বাবা তারকদাস গান গাইতেন। তবে কেউ পেশাদারি ছিলেন না। কলকাতায় এসে পড়া বাদ দিয়ে সতীনাথ চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চা করেন। কর্মজীবনে যোগদান করেন কলকাতার অ্যাকাউন্টেন্স জেনারেল (এজি বেঙ্গল) এ।
সতীনাথের কাহিনী শুনতে শুনতে সংকেত দা ও আমি প্রবেশ করলাম সংকেত দা ও মোহনাদি’র বাড়ীতে। দোতালা বাড়ীর নীচতলা ড্রইং রুম, গেস্ট রুম ও কিচেন। ড্রইং রুম থেকে সংকেতদা চিৎকার করে ডাকলেন, মোহনা, দেখ তোমার ভাই এসেছে। দিদি হতদ্বন্দ হয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে নীচে নেমে এসে একমুখ হাসি নিয়ে বললেন, পথে কোন কষ্ট হয়নিতো ? আমি জবাব দিয়ে তাঁকিয়ে আছি একমনে দিদি মোহনা গঙ্গোপাধ্যায়ের মুখের দিকে।
একদা এই মুখটি ডুয়েট গাইতেন মান্নাদের সঙ্গে। মোহনা’দি ছিলেন মান্নাদে’র প্রিয় একজন সহশিল্পী। আমি দেখতে পাচ্ছি, দিদি মান্না’দের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গাচ্ছেন –
ভারত আমার ভারতবর্ষ
স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো
তোমাতে আমরা লভিয়া জন্ম
ধন্য হয়েছি ধন্য গো।
ছবিঃ ১. মোহনা গঙ্গোপাধ্যায় ও আমি ২. শ্যামল মিত্র। ৩. সতীনাথ মুখোপাধ্যায় । ৪. মোহনা দি, ও মান্নাদে’র সংগীত সন্ধ্যা ।
লেখকঃ লুৎফর রহমান। রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট।
কিউএনবি/বিপুল/ ১৯.০৭.২০২২/ রাত ৮.০৬