প্রথম সমুদ্র দেখা
——————–
আমার একটা লিস্ট আছে, যে লিস্ট এ আমার প্রথম সারির ১০ টা ভালোলাগার গল্প আছে। যখন মন খারাপ থাকে সেই লিস্ট এর কথা ভাবতেই মন ভালো হয়ে যায়! তার মধ্যে এক নম্বরে আছে আমার প্রথম সমুদ্র দেখা।
সেই ছোট বেলা থেকেই খুব ইচ্ছে সমুদ্র দেখবো। অনেক স্বপ্ন সাজিয়েছি মনে। সময় সুযোগের অভাবে আর যাওয়া হয়ে উঠেনি কখনো।
আমার দুলু(দুলাভাই), সেই ছোট বেলা থেকেই মুটামুটি যখন যা মুখ দিয়ে বের করেছি, তিনি তার শাদ্ধ মত আমাদের সামনে হাজির করেছেন বা ইচ্ছে পূরণ করেছেন বাবার থেকেও বেশি।
২০০১, মে অথবা জুন মাস, দুলু ঠিক করলেন উনার জীপ নিয়ে কক্সবাজার বেড়াতে যাবেন আমাদের নিয়ে। যখন থেকে শুনেছি সবুদ্র দেখতে যাবো, আমার তো রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেলো। এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম যে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না সমুদ্র দেখতে যাবো!
অবশেষে আকাঙ্খিত দিন টি এলো! দুলুর এক বন্ধুর ফ্যামিলি, আমার বোনের ফ্যামিলি, আমি আর আমার ছোট ভাই ইমন, সবাই মিলে সকাল সকাল রওনা হয়ে গেলাম।
কয়েক ঘন্টা ড্রাইভ করার পর পর আমরা থামছিলাম এক এক জায়গায় চা খেতে আর রেস্ট নিতে। একটু রেস্ট নিয়ে আবার ড্রাইভিং শুরু। বৃষ্টিও নামছিল খুব। গাড়িতে উচ্চ শব্দে গান বাজছিল, চলছিল গল্প সবার মাঝে। ভীষন আনন্দে কাটছিল সময়টি!
কক্সবাজার পৌঁছনোর আগে দুলু বললো- রুপা তুই এখন রাস্তা থেকেই সমুদ্র দেখতে পারবি। আমাকে সামনের সিটে বসানো হলো।
গাড়ি আস্তে আস্তে কক্সবাজার ঢুকছে আর ঐ তো, দুর থেকে দেখতে পাচ্ছি সমুদ্র, যেনো পাহাড়ের মত উচু হয়ে আছে! পানি দেখা যাচ্ছে, গভীর ঘোলাটে পানি, বড় বড় ঢেউ! গাড়িতে জোরে গান বাজছে “ওরে নীল দরিয়া, আমায়….” অসাধারণ মনোমুগ্ধকর পরিবেশে কখন যে আমার গলা দিয়ে চিৎকার বের হয়েছে সে দিকে আমার খেয়ালই নেই! একটু পর দেখি সবাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
হোটেলে গেলাম, একটু রেস্ট নিলাম সবাই। দুলু বললো – সবাই চলো, বিকেল বিকেল থাকতে রুপাকে সাগরের পারে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।
সন্ধে হয়ে যাওয়ায় আর পানিতে নামা হলো না। মেঘলা মেঘলা সূর্যাস্ত দেখলাম মুগ্ধ মনে!
ঠিক হলো পরদিন সকালে নাস্তা খেয়ে ১১/১২ টার দিকে সমুদ্রে ভিজবো। রাত যেনো আমার আর কাটে না! কখন সকাল হবে আর আমি ঝাঁপিয়ে পড়বো সমুদ্রের বুকে!
সকালে নাস্তা খেয়ে সবাই রেডি হচ্ছি সমুদ্রে ভিজতে যাবো। সেই সময় গুরি গুরি বৃষ্টি শুরু হলো। কেউ আর যেতে চাইলো না, আমার মন ভীষন খারাপ হয়ে গেলো!
দুলু বুঝতে পেরে বললো – ঠিক আছে সবাই চলো গাড়িতে বসেই ঘুরে আসি, অন্য সময় ভেজা হবে নাহয়!
আমরা বের হলাম, সাগরের পার ঘেঁষে গাড়ি চলছে তো চলছেই। আমি অপলক তাকিয়ে সাগরের পানে! খুব জোড়ে বৃষ্টি শুরু হলো। গাড়ির ছাদে বৃষ্টির ঘন বরিষণের শব্দে মনটা কেমন যেনো ব্যাকুলতায় ভরে উঠছিলো। হঠাৎ দুলু গাড়ি থামালো, হয়তো আমার মনের ভাব বুঝতে পেরেই বললো – যা ভিজতে যা, কিন্তু একটা শর্ত আছে, ভেজা গায়ে গাড়িতে উঠতে পারবি না। গাড়ির ছাদে বসে ফিরতে হবে হোটেলে।
নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বোকার মত কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে এক চিৎকারে গাড়ি থেকে নেমে দিলাম এক দৌড়! বৃষ্টির কারণে কেউ ছিলো না সাগর পারে। শুধুই আমি একা সাগরের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। এক দিকে বৃষ্টি আর আরেক দিকে সাগর! একটা ম্যাজিকাল মোমেন্ট তৈরি হয়েছিল আমার জন্য! মনে হচ্ছিল থেমে যাক সময় এখানেই!
ডাক পড়লো আমার, হোটেলে ফেরার সময় হয়েছে, জলদি এসো। উঠে বসলাম গাড়ির ছাদে! ঝুম বৃষ্টি, আর গাড়ি চলছে সাগরের পাড় ঘেঁষে! উপভোগ করেছি প্রতিটা মুহূর্ত, প্রতিটা বৃষ্টি ফোঁটা মেখেছি গায়ে! মনে হয়েছে জীবনে আর কিছুই চাওয়ার নেই! সব পাওয়া এখানেই।
লেখিকাঃ রুপা মোজাম্মেল। কানাডা প্রবাসী। দেশে লেখাপড়া শেষ করে কানাডায় বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কোর্স শেষ করেছেন। সেখানেই তাঁর কর্ম জীবন। লেখালেখি করেন নিয়মিত। জীবনের খন্ডচিত্র আঁকতে পারদর্শিনী রুপা মোজাম্মেল।
কিউএনবি/বিপুল/০৪.০৭.২০২২/ রাত ১০.০৫