আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপ থেকে তাড়া খেয়ে দলে দলে রাশিয়ার ধনকুবের ও অলিগার্করা দুবাইয়ে এসে আশ্রয় নিচ্ছেন। টাকার বস্তা নিয়ে আসা এসব ধনী অতিথিদের আদর আপ্যায়নে কোনো ত্রুটিই রাখছে না দুবাই কিংবা সংযুক্ত আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষ। তাদের আতিথ্যে পরিবার সমেত ভালোই দিন কাটছে এসব রাশিয়ান ধনকুবেরের। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আচড় তাদের ওপর খুব একটা পড়ছে না।
দুবাইয়ে ভিড়ছে রুশ ধনকুবেরদের বিলাসতরী
সম্প্রতি রুশ ধনকুবের আন্দ্রে মেলনিচেঙ্কোর মালিকানাধীন একটি সুপার ইয়টকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাস আল খাইমাহ বন্দরে ভিড়তে দেখা যায়। এ ছাড়া পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা রাশিয়ার পার্লামেন্ট সদস্য ও দেশটির অন্যতম ধনী আনদ্রেই স্কচের মালিকানাধীন সুপার ইয়ট মাদাম গুকে গত মার্চ মাসে দুবাইয়ে ভিড়তে দেখা যায়।
ব্রিটিশ প্রিমিয়ার লীগের শীর্ষ ফুটবল ক্লাব চেলসির সাবেক মালিক রোমান আব্রামোভিচের মালিকানাধীন বিশ্বের সবচেয়ে বিলাসবহুল ব্যক্তিগত বিমান হিসেবে পরিচিত ৩৫ কোটি ডলার মূল্যের একটি বোয়িং সেভেন এইট সেভেন ড্রিমলাইনার গত তিন মাস ধরে দুবাইয়ে অবস্থান করছে। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস জানিয়েছে, গেল ৪ মার্চ বিমানটি মস্কো থেকে দুবাই অভিমুখে সর্বশেষ যাত্রা করে।
রুশদের আশ্রয় দেয়ায় ক্ষুব্ধ পশ্চিমা বিশ্ব
কিন্তু দুবাইয়ে রাশিয়ানদের এ সুখ সহ্য হচ্ছে না মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী পশ্চিমা দেশগুলোর। অলিগার্ক হিসেবে পরিচিত রাশিয়ার ধনকুবেররা তাদের ব্যক্তিগত বিলাসবহুল ইয়ট কিংবা জেট বিমান নিয়ে দলে দলে ভিড় করছে দুবাইসহ সংযুক্ত আরব আমিরাতের অন্যান্য নগরীতে। এ ধরনের প্রতিবেদন আজকাল প্রায়ই প্রকাশ পাচ্ছে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোয়।
ব্লুগমবার্গ, বিজনেস ইনসাইডার, অবজারভার, গার্ডিয়ানসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বিষয়টি নিয়ে নিয়মিতই উষ্মা প্রকাশ করা হচ্ছে।
বিজনেস ইনসাইডারের প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয়, অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্টের অনুসন্ধানে উন্মোচিত হয়েছে যে, নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা ব্যক্তিরা কীভাবে তাদের ধন সম্পদ পশ্চিমা দেশগুলো থেকে দুবাইয়ে স্থানান্তরিত করছে।
নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, দুবাইয়ে পুতিনের ঘনিষ্ঠ অন্তত ৩৮ জন ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তার সম্পত্তি রয়েছে। তাদের মধ্যে অন্ত্যত ৬ জন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় রয়েছেন। এ ব্যক্তিদের মধ্যে রাশিয়ার প্রাদেশিক গভর্নর, নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের ম্যানেজার, রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ও রাজনীতিক রয়েছেন।
উঠছে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি
পশ্চিমা দেশগুলোর বিভিন্ন মহল থেকে রাশিয়ার মতো সংযুক্ত আরব আমিরাতকেও পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক ব্ল্যাক লিস্টে অন্তর্ভুক্ত করার আওয়াজ উঠছে।
রাশিয়ার মতো সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা দেয়ার তাগিদ জানিয়ে ক্যাম্পেইন পরিচালনাকারী বিল ব্রাউডার ব্রিটেনের অবজারভার পত্রিকাকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই কালো টাকার নিরাপদ আশ্রয়স্থল দুবাই। তাদের এখনই কালো তালিকাভুক্ত করা উচিত। পাশাপাশি তাদের নেতাদের ব্রিটেনে স্বাগত জানানো উচিত নয়।
সংযুক্ত আরব আমিরাতকে কালো তালিকাভুক্ত করার জন্য ইউরোপিয়ান কমিশনার মেইরেড ম্যাকগিনেসে কাছে গত মাসে আবেদন করেছেন ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের একদল সদস্য। সেই চিঠিতে বলা হয়, সংযুক্ত আরব আমিরাত ব্যাপক হারে অবৈধ অর্থপাচারে সহযোগিতা করছে। যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এবং এটা কোনোভাবেই বরদাশত করা যায় না।
এরমধ্যে স্বাক্ষরকারী ডেনিস ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য কিরা পিটার হ্যানসেন এক টুইটে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি প্রশ্ন রেখে বলেন, দুবাইকে ইইউ এর অবৈধ অর্থ লেনদেনের কালো তালিকাভুক্ত করতে আর কত কেলেঙ্কারির প্রয়োজন হবে।
তিনি ব্রিটেনের পত্রিকা গার্ডিয়ানকে বলেন, আমরা সংযুক্ত আরব আমিরাতকে কালো তালিকাভুক্ত করতে চাই। কারণ বিপুল সংখ্যক রুশ অলিগার্ক এ দেশটিকে নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর আড়াল হিসেবে ব্যবহার করছেন।
এদিকে পশ্চিমাদের এসব দাবির মুখে ইতোমধ্যেই তৎপর হয়েছে আন্তর্জাতিক আর্থিক অপরাধ নজরদারি সংস্থা ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স। গত মার্চ মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে ধূসর তালিকাভুক্ত করে তারা। পাশাপাশি অর্থপাচারের এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতের জড়িত থাকার বিষয়টিতেও খোঁজ খবর চালাচ্ছে সংস্থাটি।
পাশাপাশি কূটনৈতিক ফ্রন্টেও দুবাইয়ে রুশ ধনকুবেরদের উপস্থিতির ব্যাপারে নীরব রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষ। জাতিসংঘে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার নিন্দা জানিয়ে আনা প্রস্তাবে ভোট প্রদানেও বিরত ছিলো দেশটি।
দুবাইয়ে রুশ ধনকুবেরদের আনাগোনা এবং নিষেধাজ্ঞা ফাঁকি দিয়ে অর্থপাচারের বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)। সাবেক এফবিআই গোয়েন্দা কারেন গ্রিনওয়ে ব্রিটেনের গার্ডিয়ানকে বলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের কর্তৃপক্ষ মুখে আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিতের কথা বললেও তারা এখন রাশিয়া এবং পশ্চিমাদের মাঝের রাস্তা দিয়ে হাঁটছে।
পশ্চিমা মিত্রদের সঙ্গে দুবাইয়ের সম্পর্কে ফাঁটল
পুতিনের ঘনিষ্ঠ রাশিয়ার কোটিপতি ব্যবসায়ী ও অলিগার্কদের শাস্তি দিতে তাদের ধনসম্পদকে লক্ষ্য করাই ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয়দের নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য।
অথচ নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে ধন সম্পদ সরিয়ে সেই ধন সম্পদ সমেত এ রুশ ধনকুবেররা নিরাপদ আশ্রয় পাচ্ছে এমন দেশে যারা কি না আবার বিশ্বস্ত পশ্চিমা মিত্র হিসেবে পরিচিত। তাই বিষয়টি পশ্চিমাদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছে।
দুবাই ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের শাসকদের ওপর ক্ষোভ ঝাড়ছে পশ্চিমা দুনিয়া
নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানের নিন্দা না জানানোয় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ আরব মিত্র দেশগুলোর মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
তেল সংকট কাটাতে পশ্চিমা দেশগুলোর আহ্বানের সত্ত্বেও তেলের উৎপাদন বাড়ানোর ব্যাপারে অসম্মতি জানিয়ে আসছে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
রুশভাষীদের জনপ্রিয় গন্তব্যস্থল দুবাই
বেশ কয়েক বছর থেকেই রাশিয়ার পর্যটকদের জনপ্রিয় গন্তব্য দুবাই। পাশাপাশি দেশটিতে স্থায়ীভাবে বাস করে এক লাখেরও বেশি রুশভাষী।
দুবাইয়ের রিয়েল এস্টেট এজেন্ট বেটারহোমের জরিপে দেখা গেছে, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর দুবাইয়ে সম্পত্তি বিক্রি বেড়েছে ৬৭ শতাংশ। যার বেশিরভাগ ক্রেতাই রুশভাষী।
দুবাইয়ে ব্যবসা শুরুর জন্য কোম্পানিগুলোকে সহায়তাকারী কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান ভারচু জোন বিবিসিকে জানায়, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর তাদের রাশিয়ান গ্রাহক বেড়ে গেছে।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী জানান, যুদ্ধ শুরুর পর দুবাইয়ে ব্যবসা শুরু করতে রাশিয়ার নাগরিকদের খোঁজ খবর নেয়ার পরিমাণ ৫ গুণ বেড়ে গেছে।
এদিকে রাশিয়ার নাগরিকদের ব্যাপক হারে দুবাইয়ে আসার হিড়িকে পোয়াবারো দুবাইয়ের রিয়েল এস্টেট খাতের। ইতোমধ্যেই সেখানে বেড়ে গেছে ফ্ল্যাট, বাড়ি ও ভিলার দাম। রাশিয়ানরা ব্যাপক হারে দুবাইয়ের রিয়েল এস্টেট খাতে বিনিয়োগ করছে। মডার্ন লিভিং নামের দুবাইয়ের একটি রিয়েল এস্টেট এজেন্সি বিবিসিকে জানায়, ব্যাপক হারে রাশিয়ান গ্রাহক বেড়ে যাওয়ায় তাদের জন্য তারা অধিক হারে রুশ ভাষী কর্মী নিয়োগ দিচ্ছেন।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী থিয়াগো ক্যালডাস বিবিসিকে বলেন, রাশিয়ানরা শুধু বিনিয়োগের জন্যই না, বরং দুবাইকে তারা সেকেন্ড হোম হিসেবে বিবেচনা করছেন। পাশাপাশি অনেক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ও রাশিয়ান স্টার্টআপও তাদের কর্মীদের সংযুক্ত আরব আমিরাতের স্থানান্তরিত করছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ায় ব্যবসা বন্ধ করা গোল্ডম্যান স্যাচ, জেপি মরগান এবং গুগলের মতো প্রতিষ্ঠান তাদের রাশিয়ায় থাকা কর্মীদের দুবাইয়ে স্থানান্তর করছে।
দুবাইয়ের আতিথেয়তার মুগ্ধ রাশিয়ানরাও। নিউইয়র্ক টাইমসকে দুবাইয়ে আশ্রয় নেয়া রাশিয়ার এক ব্যবসায়ী বলেন, এ মুহূর্তে রাশিয়ার পাসপোর্ট কিংবা রাশিয়ার টাকা থাকাটা অনেকটা বিষের মতো। যখন কেউ আপনাকে গ্রহণ করছে না, তখন দুবাই আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে। রাশিয়ানদের নিয়ে দুবাইয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই।
কিউএনবি/আয়শা/১৩.০৬.২০২২ খ্রিস্টাব্দ/সন্ধ্যা ৬:৪০