ডেস্কনিউজঃ বিশ্ব অর্থনীতিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব দেখা দিতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে জ্বালানিসহ নিত্যপণ্যের বাজার। এ যুদ্ধ বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও নানামুখী প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ যুদ্ধের প্রভাবে বাণিজ্য ঘাটতির শঙ্কা তৈরি হতে পারে। এছাড়া জাহাজ ভাড়া ও বীমা মাশুল বেড়ে যাওয়ায় টাকার অবমূল্যায়নের আশঙ্কাও রয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব শীর্ষক একটি প্রতিবেদন বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সংসদীয় কমিটিতে উপস্থাপন করা হয়। দেশের অর্থনীতিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ১২ ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মুহম্মদ ফারুক খান এ প্রসঙ্গে বলেন, এটা কূটনৈতিক নয়, মূলত অর্থনৈতিক সমস্যা। অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি দেখছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে পণ্যবাহী জাহাজের ভাড়া ও বীমা মাশুল বেড়ে যেতে পারে। রফতানির পুরোটাই বাংলাদেশ এফওবি (ফ্রি অন বোর্ড) ভিত্তিতে করে। ফলে রফতানির খরচ বাড়বে না। কিন্তু আমদানির বেশির ভাগই সিঅ্যান্ডএফ (কস্ট অ্যান্ড ফ্রেইট) ভিত্তিতে হওয়ায় পণ্যবাহী জাহাজ ভাড়া বেড়ে আমদানিকারকের খরচ বাড়াবে, যার প্রভাব পড়বে আমদানীকৃত পণ্যমূল্যে। আমদানি ব্যয় বেড়ে গেলে বাণিজ্য ঘাটতিও বাড়বে। এরই মধ্যে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধে বাণিজ্য ঘাটতি ১ হাজার ৫৬১ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা গত বছর একই সময়ে ছিল ৬৮৭ কোটি ডলার। পাশাপাশি মুদ্রাবাজারে ডলারের বিপরীতে টাকার আরো অবমূল্যায়ন ঘটতে পারে।
চলতি অর্থবছরে রাশিয়া থেকে চার লাখ টন গম আমদানি করা হয়েছে। আরো দেড়-দুই লাখ টন আমদানির টেন্ডার প্রক্রিয়াধীন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সূর্যমুখী ও তুলাবীজের সবচেয়ে বড় অংশ রাশিয়া থেকে আসে। রাশিয়া থেকে আমদানিতে অসুবিধা হলে বিকল্প বাজার খুঁজে বের করতে হবে। রাশিয়া ও ইউক্রেন মিলে বিশ্বে ৩০ শতাংশ গম সরবরাহ করে। রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে গম আমদানির ওপর মধ্যপ্রাচ্য ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। দেশ দুটি থেকে বাংলাদেশ খুব বেশি গম আমদানি না করলেও বৈশ্বিক বাজার পরিস্থিতির কারণে সরবরাহ প্রভাবিত হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও প্রেষণে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য ড. দেলোয়ার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধে জ্বালানি, খাদ্যসহ প্রত্যেকটা খাতেই বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতির দেশ। আমদানি-রফতানির বিষয় আছে, খাদ্যের বিষয় আছে, দেশের ভেতরে বিভিন্ন বিনিয়োগের বিষয় আছে, ফলে বিশ্বের অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশেও যুদ্ধের প্রভাব পড়ছে। যুদ্ধের কারণে কোন কোন খাতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে বা পড়তে পারে, সেগুলো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চিহ্নিত করেছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। তবে সমস্যাগুলো শুধু চিহ্নিত করলেই হবে না, সেগুলো সমাধানেও সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে বিকল্প উৎস ও বাজার খুঁজতে হবে। এ সংকটজনক পরিস্থিতিতে সরকারকে কৃচ্ছ্র সাধনের ওপরও নজর দিতে। পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনীতির এ সংকটের প্রতিটি মুহূর্ত পর্যবেক্ষণ করা এবং সে অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা নেয়াও জরুরি।
সংসদীয় কমিটিতে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়, নয় বছরের মধ্যে তেলের দাম সর্বোচ্চ। বাংলাদেশ বর্তমানে প্রতি বছর ৫০ লাখ টন ডিজেল, ১৩ লাখ টন অপরিশোধিত তেল, দুই লাখ টন ফার্নেস অয়েল ও ১ লাখ ২০ হাজার টন অকটেন আমদানি করে। বর্তমানে যে দামে জ্বালানি তেল কিনে বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি করা হয়, তাতে প্রতিদিন ১৫ কোটি ডলারের ওপর লোকসান গুনতে হচ্ছে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম আরো বাড়বে। এর প্রভাবে দেশে পরিবহন ভাড়া বাড়বে। কৃষি উৎপাদনেও খরচ বাড়বে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউরোপ ৪৭ শতাংশ গ্যাস রাশিয়া থেকে আমদানি করে। নর্ড স্ট্রিম-১ পাইপলাইনের মাধ্যমে তা সরবরাহ করা হয়। নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইন চালু হলে রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ দ্বিগুণ হয়ে যাবে। তবে পরিস্থিতি বলছে, যুদ্ধ বন্ধ হলেও ইউরোপীয়রা রাশিয়ান গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করবে। সেক্ষেত্রে তারা কাতার, ওমান, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলো থেকে গ্যাস আমদানির চেষ্টা করতে পারে। ফলে ওইসব দেশ গ্যাস রফতানির ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। জ্বালানি চাহিদায় বাংলাদেশ মূলত কাতার ও ওমান থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে। ফলে এ বাজারগুলোয় এলএনজির মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা থাকবে। এছাড়া আমদানীকৃত এলএনজিবাহী জাহাজ কোন কোন বন্দর হয়ে আসবে এবং কোন রুট ব্যবহার করবে, সে বিষয়েও সতর্ক থাকার কথা বলা হয়েছে।
ইউক্রেন সংকটের কারণে ইউরোপজুড়ে উদ্বাস্তু সমস্যা তৈরি হবে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, চলমান আফগান সংকটকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য প্রাপ্ত আন্তর্জাতিক আর্থিক সহায়তার পরিমাণ কমে যেতে পারে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২সহ যেসব প্রকল্পের ব্যাপারে রাশিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে, সেগুলো দীর্ঘসূত্রতার কবলে পড়তে পারে।
এরই মধ্যে বেশকিছু রাশিয়ান ব্যাংককে বৈশ্বিক আন্তঃব্যাংক লেনদেন-সংক্রান্ত সুইফট সিস্টেমে নিষিদ্ধ করার প্রসঙ্গটিও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন সংস্থা যাদের রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি রয়েছে, তাদের মূল্য পরিশোধের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কেননা নিষেধাজ্ঞার আওতাধীন কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করলে তা মাঝপথে আটকে যেতে পারে। এ অর্থ আর পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নাও হতে পারে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ রাশিয়ার সঙ্গে ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি করে। বাংলাদেশ রুবলের বদলে ডলারে ঋণ নিতে চাওয়ায় এ অর্থ আসছে প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক হয়ে। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এ লেনদেনে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে রাশিয়ার ৩ হাজার ৭৬০ ও ইউক্রেনের ২১৭ জন নাগরিক কর্মরত। প্রতিবেদনে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ ৬৫০ মিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রাশিয়ায় রফতানি করে। বেশকিছু রাশিয়ান ব্যাংক সুইফটে নিষিদ্ধ হওয়ায় রাশিয়ায় বাংলাদেশের পণ্য রফতানি হুমকির মধ্যে পড়তে পারে। ফলে যেসব তৈরি পোশাকের অর্ডার শিপমেন্টের জন্য প্রস্তুত, সেগুলোর পেমেন্ট রিকভারি নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের এ প্রতিবেদনকে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত এখন থেকেই রফতানি বাজার পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা। এ বিষয়ে কূটনৈতিক যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে হবে। বড় অর্থনীতির দেশগুলো সম্ভবত দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের আশঙ্কায় পণ্য মজুদ করে রাখবে। আমাদের সে সক্ষমতা না থাকলেও বিকল্প ভেবে রাখতে হবে। প্রয়োজনীয় কোনো পণ্যের জন্য বেসরকারিভাবে কেউ বাইরের দেশে বিনিয়োগ করতে পারলে সেক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা করা উচিত।
তিনি বলেন, ইউরোপের বাজারে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হলে এবং তাতে সেসব দেশের প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হলে তার প্রভাব আমাদের রফতানিতেও পড়তে পারে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে যথাযথ কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। যুদ্ধের কারণে দেশের মূল্যস্ফীতি কতটুকু বাড়বে তা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকও ইঙ্গিত দিয়েছে যে মূল্যস্ফীতির প্রতিক্রিয়া আরো কিছুদিন থাকবে।
অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, এ পরিস্থিতিতে বাজারে পণ্য সরবরাহ যতটা সম্ভব স্থিতিশীল রাখা প্রয়োজন, তা দেশের মধ্যে বা আমদানীকৃত পণ্যের মাধ্যমেই হোক না কেন। মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর যে প্রভাব পড়বে তা যেন দীর্ঘস্থায়ী না হয়, সেদিকেও নজর দিতে হবে। তাই সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমগুলোর আওতা বাড়াতে হবে। আগামী বাজেটে সরকার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে। পাশাপাশি তেল সরবরাহ স্থিতিশীল রাখার জন্যও সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে।
কিউএনবি/বিপুল /২৯ এপ্রিল ২০২২ খ্রিস্টাব্দ / বিকাল ৪.০০