
ডেস্ক নিউজ : দেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধের সময়সীমা বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ ২০২১ সালের মধ্যে দেশ ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম মুক্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ হলেও তা সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে কয়েক দফা সময় পেছালো সরকার। সম্প্রতি নতুন করে ২০২৫ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধ করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নতুন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধ হবে কি না তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে, এতে যেন কারো কোনো দায় নেই। আমরা এখনো শিশুশ্রম কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধ করতে পারছি না। এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক। তারা বলেন, দরিদ্রতা, অশিক্ষা, অসচেতনতা, আইন প্রয়োগের দুর্বলতা শিশুদের শ্রমের ঠেলে দিচ্ছে। আবার শিশুদের সস্তা শ্রমের জন্য কতিপয় অসাধু ব্যক্তি নানা রকম প্রলোভনে শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে টেনে আনে।
এতে যেন কারো কোনো দায় নেই বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন শিশুদের নিয়ে কাজ করা সংস্হা ইসিডিন বাংলাদেশ-এর নির্বাহী পরিচালক এ কে এম মাসুদ আলী। তিনি মনে করেন শিশুশ্রম ও ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম শিশু অধিকারের লঙ্ঘন। আমরা এখনো শিশুশ্রম কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধ করতে পারছি না। এটা দুঃখজনক। আমাদের চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে শিশুদের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করা এবং শিশুশ্রম সংক্রান্ত আইন প্রাতিষ্ঠানিক খাতকে নির্দিষ্ট করে করা হয়েছে।
শিশুশ্রম পরিস্হিতি
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত জাতীয় শিশুশ্রম সমীক্ষায় (সিএলএস) দেখা যায়, ২০০৩ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ৫-১৭ বছর বয়সি শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ৭৬ লাখ থেকে কমে ৩৫ লাখে নেমে আসে। সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৪ বছরের নিচে শ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা ছিল ৩২ লাখ, যা ২০১৩ সালে ১৭ লাখ ৭০ হাজারে নেমে আসে। ২০১৩ সালের সার্ভে অনুযায়ী অনানুষ্ঠানিক খাতে ৯৫ শতাংশ শিশুশ্রমিক নিযুক্ত। ২০১৮ সালের মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস) অনুযায়ী ৫-১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ শিশু শ্রমে নিয়োজিত।
সমীক্ষায় দেখা যায়, শ্রমের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে শিশুদের স্কুলে উপস্হিতি কমে যায়। শিশুশ্রমে নিযুক্ত ৬৩ শতাংশ শিশু স্কুলে যায় না। এদের মধ্যে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ কখনো স্কুলে যায়নি। ২০১৩ সালে সার্ভে মতে, ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। ২০১৩ সালে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে ১০ জনের মধ্যে ৯ জন ছেলে ছিল এবং ২০১৮ সালে ১০ জনের মধ্যে ছয় জন ছেলে ছিল। ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম হিসেবে নির্ধারণ করা হয় ধূলিকণা, ধোঁয়া, শব্দ বা কম্পন এবং বিপজ্জনক সরঞ্জামের ব্যবহারের মধ্যে কাজ করাকে। এছাড়া আগুনের শিখা, গ্যাস এবং প্রচণ্ড তাপ বা ঠাণ্ডার মধ্যে কাজ করা।
লেবার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সাকিল আখতার চৌধুরী বলেন, ২০১০ সালে শিশুশ্রম নিরসনে সরকার একটি নীতিমালা করে। ঐ নীতিমালার আলোকে ২০১২ সালে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সেই কর্মপরিকল্পনাতে ২০১৬ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ২০১৬ সালে লক্ষ্য পূরণ না হলে তা ‘রিভাইজ’ করা হয় ২০২১ সালকে লক্ষ্য ধরে। কিন্তু এবারও আমাদের লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।
শ্রেণিবৈষম্য বৃদ্ধির কারণেই বেড়েছে শিশুশ্রম
জাতীয় শিশুশ্রম কল্যাণ পরিষদের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী ইত্তেফাককে বলেন, আমরা মধ্যম আয়ের দেশের দিকে যাচ্ছি। মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যে যোগ্যতা লাগে সেখানে শিশুশ্রম থাকতে পারে না। করোনায় শিশুশ্রম বাড়ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শ্রেণিবৈষম্য অনেক বেড়েছে বলেই বেড়েছে শিশুশ্রম। আমি মনে করি সরকার ও যেসব এনজিও শিশুশ্রম নিরসনে কাজ করছে তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে। সমন্বয় করে কাজ করলে আমরা ভালো কিছু করতে পারব।
তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্হা বলে মনে করেন আইএলও-এর ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেটর এশিয়া প্যাসেফিক সৈয়দা মুনিরা সুলতানা। তিনি বলেন, শ্রম আইন অনুযায়ী কোনো প্রতিষ্ঠান ১৪ বছরের নিচে শিশুশ্রমিক নিযুক্ত করলে মাত্র ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এটি বৃদ্ধি করতে হবে। যেহেতু শ্রমে প্রবেশের বয়স ১৪ বছর তাই বাধ্যতামূলক শিক্ষা ১৪ বছর পর্যন্ত করতে হবে। এছাড়া শিশুদের সামাজিক নিরাপত্তার বেষ্টনীর আওতায় আনতে হবে। এ বিষয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হলে কেউ কোনো মন্তব্য করেন না। তবে শ্রম ও কর্ম সংস্হান বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি মুজিবুল হক চুন্নু এমপি বলেন, কাজের ধীরগতির জন্য বন্ধ হচ্ছে না ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম। ২০১৮ সালে ১ লাখ শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে সরিয়ে আনার পরিকল্পপনা করা হয়, যা বাস্তবায়নের কাজ কেবল শুরু হয়েছে। কাজটি গুরুত্ব দিয়ে দ্রুততার সঙ্গে করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কিউএনবি/আয়শা/১৮ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ/দুপুর ১২:২৮