আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ইউক্রেন বিশেষ অভিযান শুরুর পর থেকেই রাশিয়াকে কার্যত ফাঁদে ফেলে দিয়েছিল পুরো পশ্চিমা বিশ্ব। রাশিয়াকে পরাজিত করতে দশ হাতে সাহায্য করেছিল নাটের গুরু যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের ক্ষমতাধর দেশগুলো। সঙ্গে যোগ দিয়েছিল রাশিয়ার ঘরের পাশের প্রতিবেশীরাও। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে (২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২) রাশিয়াকে হারাতে বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে ইউক্রেনের ‘গডফাদার’ রাষ্ট্রগুলো।
কিন্তু দিন শেষে জয় হলো রাশিয়ারই। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন অবশ্য শুরু থেকেই বলছিলেন, লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এক পাও পিছু হটবে না মস্কো। পশ্চিমা বিশ্বের চোখ রাঙানি, বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, ইউক্রেনকে অত্যাধুনিক সব অস্ত্র সরবরাহ-কোনো কিছুই নোয়াতে পারেনি লৌহমানব পুতিনকে।
এক চুলও নড়েননি লক্ষ্য থেকে। উলটো বুক ফুলিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্র নির্দেশিত যুদ্ধবিরতি চুক্তি। প্রতিবারই বলেছেন, ইউক্রেনের ন্যাটো স্বপ্নভঙ্গ ও ভূখণ্ড ছাড়-এই দুই শর্ত ছাড়া যুদ্ধবিরতি নয়। শেষ পর্যন্ত সেটি মেনে নিয়ে বুধবার ২৮ দফা শান্তি চুক্তির প্রস্তাবের ঘোষণা দিল যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপ প্রাথমিকভাবে অসম্মতি জানালেও অতীত ইতিহাস বলে-যুক্তরাষ্ট্রই তাদের শেষ কথা। এএফপি, টেলিগ্রাফ।
ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ থামাতে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে তিনি প্রস্তুত আছেন। তবে ইউরোপের বেশকিছু মিত্রদেশ বলছে, যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত এ পরিকল্পনাটি রাশিয়ার স্বার্থেই বেশি কাজ করবে। বৃহস্পতিবার জেলেনস্কির কার্যালয় নিশ্চিত করেছে যে প্রেসিডেন্ট ওই পরিকল্পনার একটি খসড়া হাতে পেয়েছেন। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলবেন।
যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের নতুন ২৮ দফা
১. ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা হবে।
২. রাশিয়া, ইউক্রেন ও ইউরোপের মধ্যে একটি বড় শান্তি চুক্তি হবে। গত ৩০ বছরের ঝামেলা শেষ বলে ধরা হবে।
৩. রাশিয়া আর প্রতিবেশী দেশে আক্রমণ করবে না, ন্যাটো আর বড় হবে না।
৪. যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে রাশিয়া ও ন্যাটো কথা বলবে, যাতে নিরাপত্তা সমস্যা সমাধান হয় এবং উত্তেজনা কমে।
৫. ইউক্রেনকে শক্ত নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেওয়া হবে।
৬. ইউক্রেনের সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ ছয় লাখ হবে।
৭. ইউক্রেন সংবিধানে লিখবে ন্যাটোতে যাবে না।
ন্যাটোও নিশ্চয়তা দেবে ইউক্রেনকে ভবিষ্যতেও নেবে না।
৮. ন্যাটো ইউক্রেনে সেনা রাখবে না।
৯. ইউরোপের যুদ্ধবিমান পোল্যান্ডে থাকবে।
১০. যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চয়তার নিয়ম
যুক্তরাষ্ট্র এই গ্যারান্টির জন্য ক্ষতিপূরণ পাবে। ইউক্রেন যদি রাশিয়ায় আক্রমণ করে তবে এই চুক্তি বাতিল। রাশিয়া যদি ইউক্রেনে আক্রমণ করে তবে দেশটিতে আবার নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে। ইউক্রেন কারণ ছাড়া মস্কো বা সেন্ট পিটার্সবার্গে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়লে চুক্তি বাতিল।
১১. ইউক্রেন ইইউ-তে যোগ দেওয়ার যোগ্য
হবে এবং আপাতত ইউরোপের বাজারে
বিশেষ সুবিধা পাবে।
১২. ইউক্রেন পুনর্গঠন পরিকল্পনা
দ্রুত বাড়ছে এমন খাতে বিনিয়োগের জন্য ‘উন্নয়ন তহবিল’। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের গ্যাস অবকাঠামো মেরামত ও চালাতে সাহায্য করবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত জায়গা পুনর্গঠন। অবকাঠামো উন্নয়ন। খনিজ উত্তোলন। বিশ্বব্যাংকের বিশেষ অর্থায়ন।
১৩.রাশিয়াকে আবার বিশ্ব অর্থনীতিতে ফেরানো
ধাপে ধাপে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া শক্তি, সম্পদ, অবকাঠামো, আর্কটিক খনিজ ইত্যাদিতে দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতা করবে। রাশিয়াকে আবার জি৮-এ ডাকা হবে।
১৪. জব্দ সম্পদ ব্যবহারের প্রস্তাব
১০০ বিলিয়ন ডলার ইউক্রেন পুনর্গঠনে যাবে; যুক্তরাষ্ট্র লাভের ৫০% পাবে। ইউরোপ
আরও ১০০ বিলিয়ন দেবে। ইউরোপীয় জমাটবদ্ধ টাকা মুক্ত হবে। বাকি রাশিয়ান
টাকা যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া যৌথ তহবিলে যাবে, যাতে দুই দেশের সম্পর্ক শক্ত হয়।
১৫. নিরাপত্তা বিষয় দেখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া যৌথ টিম গঠিত হবে।
১৬. রাশিয়া ইউরোপ ও ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আক্রমণ না করার আইন করবে।
১৭. রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি বাড়াবে। ইউক্রেন পরমাণু অস্ত্র রাখবে না।
১৮. ইউক্রেনের অ-পারমাণবিক অবস্থান।
ইউক্রেন পারমাণবিক অস্ত্র অপসারণ
চুক্তি অনুযায়ী নিজেকে একটি অ-পারমাণবিক রাষ্ট্র হিসাবে বজায় রাখবে।
১৯. জাপোরিঝঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আইএইএর তত্ত্বাবধানে কেন্দ্রটি চালু
করা হবে এবং উৎপাদিত বিদ্যুৎ রাশিয়া ও ইউক্রেন সমান হারে পাবে
২০. শিক্ষা ও সমাজে সহনশীলতা বাড়ানোর কর্মসূচি
ইউক্রেন ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘু সুরক্ষায় ইইউ নিয়ম মানবে। দুই দেশেই মিডিয়া ও শিক্ষায় সমান অধিকার থাকবে। নাৎসি মতবাদ পুরো নিষিদ্ধ হবে।
২১. অঞ্চল নিয়ে সিদ্ধান্ত
ক্রিমিয়া, লুহানস্ক, দোনেৎস্ক বাস্তবে রাশিয়ার অংশ হিসাবে স্বীকৃতি পাবে। খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়া নিয়ন্ত্রণরেখা অনুযায়ী ‘ফ্রিজ’ হবে। রাশিয়া অন্য বাড়তি দখলকৃত এলাকা ছেড়ে দেবে।
২২. বলপ্রয়োগ নিষিদ্ধকরণ
ভবিষ্যৎ ভূখণ্ড ব্যবস্থা নিয়ে সম্মত হওয়ার পর রাশিয়া ও ইউক্রেন কোনোভাবেই বলপ্রয়োগ করে এই ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনবে না। এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হলে কোনো নিরাপত্তা গ্যারান্টি প্রযোজ্য হবে না।
২৩. দিনিপ্রো নদী ও কৃষ্ণ সাগর
রাশিয়া ইউক্রেনকে দিনিপ্রো নদী ব্যবহার করে বাণিজ্য পরিচালনায় বাধা দেবে না। কৃষ্ণ সাগর দিয়ে শস্য পরিবহণে অবাধ চলাচল নিশ্চিত করতে দুপক্ষ চুক্তিতে পৌঁছাবে।
২৪. মানবিক কমিটি
অমীমাংসিত বিষয়ে একটি মানবিক কমিটি গঠন করা হবে। সব বন্দি ও মৃতদেহ ‘সবার বিনিময়ে সবাই’ নীতিতে বিনিময় করা হবে। সব বেসামরিক আটক
ব্যক্তি ও জিম্মিদের, এমনকি শিশুদেরও, ফেরত পাঠানো হবে। পরিবার পুনর্মিলন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে। সংঘাতের শিকার মানুষের দুঃখ লাঘবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
২৫. ইউক্রেনে নির্বাচন
ইউক্রেন ১০০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করবে।
২৬. সাধারণ পূর্ণ ক্ষমা
যুদ্ধকালীন কর্মকাণ্ড নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবপক্ষ পূর্ণ ক্ষমা পাবে এবং ভবিষ্যতে কোনো দাবি বা অভিযোগ উত্থাপন না করার অঙ্গীকার করবে।
২৭. চুক্তির আইনগত বাধ্যবাধকতা
এই চুক্তি আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক হবে। এর বাস্তবায়ন তদারকি ও নিশ্চয়তা দেবে পিস কাউন্সিল, যার প্রধান থাকবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
২৮. চূড়ান্ত ধাপ
সবপক্ষ এই স্মারক চুক্তিতে সম্মত হলে, উভয়পক্ষ নির্ধারিত স্থানে সরে যাওয়ার পরই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে এবং চুক্তির বাস্তবায়ন শুরু হবে।
কিউএনবি/আয়শা/২২ নভেম্বর ২০২৫,/দুপুর ২:৩২