ডেস্ক নিউজ : পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ এখন দিন কাটাচ্ছেন ফসলের যত্নে। ধান, মরিচ, মারফা, ভুট্টাসহ নানা ফসলের পরিচর্যায় পরিবারের সবাই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করছেন। দুপুরে বিশ্রামের জন্য পাহাড়ে তৈরি হচ্ছে অস্থায়ী জুম ঘর। শত শত বছর ধরে এই জনগোষ্ঠী জুম চাষের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ জানায়, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে খাগড়াছড়িতে প্রায় ১ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে ৫ হাজার পরিবার জুম চাষ করছে, যা গত বছরের তুলনায় ২৬ হেক্টর বেশি। গত বছর ধান উৎপাদন হয়েছিল ১ হাজার ৫৪০ মেট্রিক টন, এ বছর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ হাজার ৫৪৮ মেট্রিক টন। সবচেয়ে বেশি আবাদ হয়েছে দীঘিনালা উপজেলায়।
জুম চাষের নিয়ম অনুযায়ী পৌষ-মাঘ মাসে পাহাড় নির্বাচন করে জঙ্গল কেটে শুকিয়ে আগুনে পোড়ানো হয়। বৈশাখে প্রথম বৃষ্টির সঙ্গে ধান বপন করা হয়, পরে রোপণ করা হয় মরিচ, শশা, বরবটি, কুমড়া, কচুসহ নানা শাকসবজি ও ঔষধি গাছ। এখন এসব সবজি প্রতিটি হাটে সহজলভ্য এবং সমতলে পাইকারি দামে বিক্রি হচ্ছে।
অনুকূল আবহাওয়া ও প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাতের কারণে বিবর্ণ পাহাড়গুলো সবুজ ফসলে ভরে উঠেছে। ছবি: সময় সংবাদ
জুমচাষীরা জানান, এবছর অন্যান্য অঞ্চলে সবজির দাম বেশি থাকায় তারা তাদের উৎপাদিত ফসল ভালো দামে বিক্রি করতে পারছেন। অন্যান্য বছর মারফা ২০–২২ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে দাম দাঁড়িয়েছে ২৫–৩০ টাকা কেজি। ফলে তারা খুশি।
দীঘিনালার মেরুং, কবাখালী, বোয়ালখালী ও বাবুছড়া ইউনিয়নের দুর্গম নাড়াইছড়ি এলাকায় সবচেয়ে বেশি জুম চাষ হয়। ফলন ভালো হলেও সড়ক যোগাযোগ না থাকায় চাষীরা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। স্থানীয় শিক্ষক অনন্তহীন চাকমা জানান, এবছর গেলং, বাদেয়ি ও রেংগুই জাতের ধানের ফলন ভালো হলেও বাজারজাতকরণে সমস্যায় পড়ছেন কৃষকরা। ইউপি চেয়ারম্যান গগন বিকাশ চাকমাও একই কথা জানিয়েছেন।
খগেন্দ্র ও হরি ত্রিপুরা বলেন, ‘চৈত্র–বৈশাখে রোদ আর জ্যৈষ্ঠ–আষাঢ়ে পর্যাপ্ত বৃষ্টির কারণে এ বছর জুমের ফলন অনেক ভালো হয়েছে। ভূমিধসও কম হয়েছে।’ বর্তমানে আলুটিলা ও দীঘিনালা সড়কের বিভিন্ন স্থানে ধান কাটা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট পরীক্ষামূলকভাবে বিরি–২৪, বিরি–২৬, বিরি–২৭সহ কয়েকটি জাতের ধান আবাদ করেছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক মো. বশিরুল আলম জানান, এর মধ্যে বিরি–২৪ ও বিরি–২৭ এর ফলন সবচেয়ে বেশি। এবছর জুমচাষীদের সরকারি প্রণোদনার আওতায় আনার উদ্যোগও নেয়া হয়েছে।
খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ আল মালেক বলেন, ‘আগে এক পাহাড়ে দীর্ঘ ব্যবধান রেখে জুম চাষ হলেও এখন প্রতি বছর একই জমিতে চাষ হচ্ছে। তবে আধুনিক প্রযুক্তি ও সারের সঠিক ব্যবহার করলে উৎপাদন টেকসইভাবে বাড়ানো সম্ভব।’
জুম চাষকে অনেকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর মনে করলেও বাস্তবে এটি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর টিকে থাকার অন্যতম ভরসা। চাকমারা একে বলে ‘জুম’, ত্রিপুরারা বলে ‘ছুগ’, আর মারমারা বলে ‘ইয়া’। ১৯৮৮ সালে গৌতম কুমার চাকমার একটি নিবন্ধে বলা হয়, তৎকালীন সময়ে প্রায় ১ লাখ পরিবার জুম চাষ করত। ২০০১ সালে ব্র্যাক জরিপে দেখা যায়, মুরং সম্প্রদায়ের ৮৪%, ত্রিপুরাদের ৫৪%, মারমাদের ৪২%, চাকমাদের ২২% এবং কিছুসংখ্যক বাঙালি পরিবারও জুম চাষের সঙ্গে যুক্ত।
বছরের পর বছর ধরে পাহাড়ের মানুষ জুম চাষের ওপর নির্ভর করে তাদের সংসার চালিয়ে যাচ্ছে। এবারের বাম্পার ফলনে তাই তারা আনন্দিত। তবে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে এবং আধুনিক কৃষি পদ্ধতির প্রসার ঘটলে জুম চাষ আরও লাভজনক হয়ে উঠবে বলে আশা করছেন কৃষি কর্মকর্তারা।