সিনেমা শিল্পের বিকাশের লক্ষ্যে অভিনয়শিল্পী, নির্মাতা ও কলাকুশলীদের আরও উৎসাহিত করার জন্য ১৯৭৬ সাল থেকে সরকারি অনুদান প্রথা চালু হয়। মাঝে কয়েক বছর বন্ধ থাকলেও এ প্রথা এখনো চলমান। কিন্তু এ অনুদান নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। প্রতিবছর অনুদানপ্রাপ্ত সিনেমার তালিকা প্রকাশ হলেই নানা অভিযোগের আঙুল ওঠে অনুদান কমিটির স্বচ্ছতা নিয়ে।
প্রশ্ন ওঠে, স্বজনপ্রীতি ও দলীয় ক্ষমতা প্রয়োগ নিয়েও। এ ছাড়া অনুদান যারা পাচ্ছেন তারাইবা এর কতটা সঠিক ব্যবহার করছেন? সরকারি কোষাগার থেকে অর্থ নিয়ে কি তারা ঠিকঠাক নিয়ম মেনে সিনেমা নির্মাণ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দেন?
এ ছাড়া শুরু থেকেই নানা অনিয়মের অভিযোগেও বিতর্কিত এ আর্থিক কার্যক্রম। ২০২৪-এর ৫ আগস্ট পরবর্তী নতুন বাংলাদেশেও সরকারি অনুদান নিয়ে এ বিতর্ক চলমান। তবুও সব বিতর্ক পাশ কাটিয়ে একটি প্রশ্ন উঠছে, সর্বোপরি কি অনুদানের সিনেমা সফল হচ্ছে? কেনই বা এসব সিনেমার প্রতি এত অনাগ্রহ? বিস্তারিত রয়েছে এ প্রতিবেদনে।
বাংলাদেশের প্রথম অনুদানপ্রাপ্ত সিনেমা ছিল ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত হাতেগোনা কয়েকটি সিনেমা ছাড়া বেশিরভাগই ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ। বিশেষ করে গত এক দশকে একটি সিনেমাও দেখেনি সফলতার মুখ। এর মধ্যে বিতর্ক তো রয়েছেই। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের অনুদান তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পরও শুরু হয় তুমুল আলোচনা-সমালোচনা।
প্রশ্ন তুলে অনেকেই বলছেন, নীতিমালা অবজ্ঞা করে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় অনেকেই সরকারি অনুদান পাচ্ছেন। চলতি বছর সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত সিনেমার তালিকায় রয়েছে ৩২টি। এর মধ্যে ১২টি পূর্ণদৈর্ঘ্য ও ২০টি স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা রয়েছে। এগুলো নির্মাণের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯ কোটি টাকা। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যদি একটু হিসাব করা হয়, তাহলে বিগত ৫০ বছরে এসব সিনেমা নির্মাণে সরকারের তহবিল থেকে ব্যয় হয়েছে প্রায় কয়েকশ কোটি টাকা। সরকারি অনুদানে নির্মিত সিনেমার সংখ্যাও প্রায় চার শতাধিক। প্রশ্ন হলো, এর মধ্যে কয়টি সিনেমা ব্যবসায়িকভাবে সফল হয়েছে বা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে? আন্তর্জাতিক হিসাব বাদ দিলে, দেশেও এসব সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে দর্শক টানতে ব্যর্থ হচ্ছে। কেন মুখ থুবড়ে পড়ছে এ অনুদানের সিনেমা?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনুদান প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকে মাত্র কয়েকটি সিনেমা বিশ্বস্বীকৃতি পেয়েছে ও পুরস্কার অর্জন করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’। ১৯৭৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ সিনেমাটি ১৯৮০ সালে মস্কো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল পুরস্কৃত হয়েছে। ‘গাড়িওয়ালা’ নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা ২৬টি দেশের ৭৮টি ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয় এবং স্পেনের পিকনিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা সিনেমার পুরস্কার এবং টেক্সাস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সাতটি পুরস্কার অর্জন করে। ‘মাটির প্রজার দেশে’ নামে একটি সিনেমা ২০১৮ সালে দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। এটি যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, শিকাগোর সাউথ এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ইতালির কারাওয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ও ইন্দোনেশিয়ার রয়্যাল বালি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালসহ ২০টির বেশি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নেয়।
এর মধ্যে শিকাগোর সাউথ এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দর্শক পছন্দে সেরা পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমার পুরস্কার লাভ করে। ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ নামে একটি সিনেমা ২০১৪ সালে দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। এটি ২০১৬ সালের শ্রীলংকার কলম্বোয় অনুষ্ঠিত সার্ক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয়। এ ছাড়া কলকাতা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও অংশ নেয়।
গত কয়েক বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত অনুদানের সিনেমার দিকে নজর দিলে দেখা যায়, এগুলো শুধুই যে ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ হয়েছে তা নয়, ব্যাপকভাবে সমালোচিতও হয়েছে। এসব সিনেমা নিয়ে দর্শকদের পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদেরও কোনো ধরনের আগ্রহ নেই। বিষয়টি এমন যে, নিয়ম রক্ষার্থে বানাতে হবে, তাই বানানো। যার মান নিয়েও বরাবরই প্রশ্ন ওঠে।
ফলে, এসব ‘মানহীন’ সিনেমা দর্শক অনাগ্রহ সৃষ্টি করছে। শুধু তাই নয়, অনুদানের সিনেমা মানেই ‘মানহীন’ এমন একটি ধারণাও তৈরি করেছে সিনেমাপ্রেমী সাধারণ দর্শকদের মধ্যে। গত তিন বছরের সিনেমাগুলোর দিকে তাকালে একটিও সফল সিনেমা পাওয়া যায়নি।
২০২৩ সালে মুক্তি পেয়েছে ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’ নামে একটি সিনেমা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকারি অনুদান পায় এটি। নুসরাত ইমরোজ তিশা অভিনীত ভিন্ন ঘরানার এ সিনেমাটি ব্যবসায়িকভাবে সুবিধা করতে পারেনি। একই বছর মুক্তি পায় ‘লাল শাড়ি’ নামে একটি সিনেমা। যার প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন অপু বিশ্বাস ও সাইমন সাদিক। ২০২১-২২ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্ত এ সিনেমাটিও মুখ থুবড়ে পড়ে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ‘১৯৭১ সেই সব দিন’ নামে একটি সিনেমাও রয়েছে ফ্লপের তালিকায়।
২০২৪ সালেও একাধিক অনুদানের সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। রয়েছে শবনম বুবলী অভিনীত সিনেমা ‘দেয়ালের দেশ’। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে অনুদান পায় এটি। ব্যবসায়িকভাবে খুব একটা সফল না হলেও, প্রশংসিত হয়েছে এটি। ২০২০-২১ অর্থবছরে অনুদান পায় ‘শ্রাবণ জ্যোৎস্নায়’ নামে একটি সিনেমা। এটি গত বছরে মুক্তির পর বেশ সমালোচিত হয়। জনগণের টাকা অপচয় হয়েছে এমনটাই মন্তব্য করছিলেন দর্শক।
এ ছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া ‘ছায়াবৃক্ষ’ নামে একটি সিনেমাও ছিল এ তালিকায়। এটিও ফ্লপ তকমা পায়। এদিকে ‘মেঘনা কন্যা’ ও ‘আহারে জীবন’ নামে সিনেমাগুলোও মুখ থুবড়ে পড়ে।
চলতি বছরের গত ছয় মাসে একাধিক অনুদানের সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। যার একটিও সফল হয়নি। বরং হয়েছে সমালোচিত। একটি হয়েছে প্রশংসিত। এটি হচ্ছে ২০২০-২১ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্ত সিনেমা ‘বলী’। এটি প্রেক্ষাগৃহে সেভাবে সুবিধা করতে না পারলেও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উৎসবে অংশ নিয়ে হয়েছে প্রশংসিত।
এদিকে ‘দায়মুক্তি’ নামে একটি সিনেমা রয়েছে তালিকায়, যা মুক্তির পর আলোচনার চেয়ে সমালোচনাই বেশি হয়েছে। ২০১৭-১৮ সালের অর্থবছরে অনুদান পায় এটি। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্ত সিনেমা ‘জলরঙ’। এটি প্রেক্ষাগৃহে এখনো মুক্তি পায়নি। তার আগেই গত কুরবানির ঈদে ওটিটিতে মুক্তি দেওয়া হয়।
অনলাইন নিউজ ডেস্ক:
কিউটিভি/রাজ/২১ জুলাই ২০২৫, দুপুর :১২.১০