রবিবার, ২০ জুলাই ২০২৫, ০৫:২০ অপরাহ্ন

পরিকল্পিতভাবে গাজায় হাজার হাজার ভবন গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ইসরাইল

Reporter Name
  • Update Time : রবিবার, ২০ জুলাই, ২০২৫
  • ৬ Time View

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : মার্চে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি প্রত্যাহার করার পর থেকে গাজাজুড়ে ইসরাইল হাজার হাজার ভবন গুঁড়িয়ে দিয়েছে। বিগত কয়েক সপ্তাহে পুরো শহর ও আশেপাশের এলাকা ধ্বংস করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেখানে আগে হাজার হাজার মানুষ বসবাস করত।

স্যাটেলাইট ছবিতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র দেখা যাচ্ছে, যেসব এলাকা ইসরাইলি সেনাবাহিনী “অপারেশনাল নিয়ন্ত্রণে” রয়েছে বলে দাবি করেছে। এই ধ্বংসযজ্ঞের বড় একটি অংশ পরিকল্পিতভাবে পরিচালিত করা হয়েছে। সেসব জায়গায় ক্ষতিগ্রস্ত ভবন এবং অনেক ক্ষেত্রেই অক্ষত ভবন পর্যন্ত গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

যাচাই করা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, টাওয়ার ব্লক, স্কুল ও অন্যান্য স্থাপনার ওপর ইসরাইলি বাহিনীর চালানো নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণে ধুলো ও ধ্বংসাবশেষের বিশাল মেঘ ছড়িয়ে পড়ছে।

বিবিসি ভেরিফাই-কে একাধিক আইন বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, ইসরাইল সম্ভবত জেনেভা কনভেনশনের অধীনে যুদ্ধাপরাধ করেছে, কারণ দখলদার শক্তির মাধ্যমে অবকাঠামো ধ্বংস করাকে সেখানে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ)-এর এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, তারা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কাজ করছে। তিনি বলছেন হামাস বেসামরিক এলাকায় ‘সামরিক সরঞ্জাম’ লুকিয়ে রেখেছে এবং “শুধুমাত্র সামরিক প্রয়োজনেই সম্পদ ধ্বংস করা হয়”। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে, ইসরাইলি বাহিনী এবং ঠিকাদাররা রাফার বিশাল অংশ মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে।

শিক্ষাবিদ কোরি শের এবং জ্যামন ভ্যান ডেন হোকের ক্ষয়ক্ষতির বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে এপ্রিল থেকে গাজায় সবচেয়ে বেশি ধ্বংসযজ্ঞ এই অঞ্চলে চালানো হয়েছে। নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ, এক্সক্যাভেটর এবং বুলডোজার দিয়ে পুরো এলাকা ধ্বংস করা হয়েছে।

ইসরায়েল দাবি করছে যে গাজা উপত্যকার বেশিরভাগ এলাকাই এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে, যেসব জায়গা এখন সামরিক জোনে পরিণত হয়েছে বা সে জায়গা খালি করার নির্দেশ কার্যকর রয়েছে।

বিবিসি ভেরিফাই মার্চে যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার পর থেকে ৪০টি স্থানে অবকাঠামো ধ্বংসের ভিডিও ফুটেজ শনাক্ত করেছে। 

স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, এই এলাকাটি আগেই ইসরায়েলি বোমা ও গোলাবর্ষণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তবে তখনো ডজনখানেক ভবন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল।

কিন্তু ১৩ই জুলাইয়ের মধ্যে ধ্বংসযজ্ঞ আরও বেড়ে যায়, যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলোর ধ্বংসাবশেষও সরিয়ে গোটা ব্লক মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলা হয়। হাতে গোনা কয়েকটি স্থাপনার একটি হিসেবে শুধু হাসপাতালটি রয়ে গেছে।

এছাড়া, পাশের সৌদি পাড়ায়ও এখন ধ্বংসের কাজ চলছে – যেখানে একসময় শহরের সবচেয়ে বড় মসজিদ ও বেশ কয়েকটি স্কুল ছিল।

একটি যাচাই করা ভিডিওতে দেখা গেছে, রাফাহ শহরের এক রাস্তায় একটি ট্যাংক চলছে এবং পাশেই একটি ভেকু কাজ করছে।

ইসরায়েলি ধ্বংসযজ্ঞের দৃশ্য গাজার অন্য অংশগুলোতেও দেখা গেছে, যেসব জায়গায় আগের বোমাবর্ষণেও তেমন ক্ষতি হয়নি।

খুজাহ নামের কৃষিভিত্তিক জনপদ ইসরায়েল সীমান্ত থেকে প্রায় ১.৫ কিলোমিটার (০.৯ মাইল) দূরে অবস্থিত।

যুদ্ধের আগে এই শহরের জনসংখ্যা ছিল ১১,০০০ এবং এর উর্বর কৃষিজমি টমেটো, গম ও জলপাইয়ের জন্য পরিচিত ছিল।মে মাসের স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যায়, জনপদের বেশিরভাগ ভবন তখনো অক্ষত ছিল। জুনের মাঝামাঝি সময়ে খুজাহ এলাকার বেশির ভাগ জায়গা ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে ধ্বংস হয়ে যায়।

আইডিএফ বলছে, তারা খুজাহ এলাকায় ১,২০০টি ভবন ধ্বংস করেছে, যেগুলো “হামাস পরিচালিত সন্ত্রাসী অবকাঠামো” ছিল বলে তারা দাবি করছে।

একই রকম দৃশ্য দেখা গেছে পাশের শহর আবাসান আল-কাবিরায়, যেখানে যুদ্ধের আগে প্রায় ২৭,০০০ মানুষের বাস ছিল। ৩১শে মে ও ৮ জুলাইয়ের ছবি থেকে বোঝা যায়, মাত্র ৩৮ দিনের মধ্যে বিশাল এলাকা মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলা ফেলা হয়েছে।

ইসরায়েল গাজায় বড় ধরনের ‘নিরাপত্তা অঞ্চল’ ও করিডর তৈরি করেছে, যেগুলো গাজার বিভিন্ন অংশকে আলাদা করেছে, আর এসব রুটের আশেপাশের বিপুলসংখ্যক ভবন ধ্বংস করেছে। এর সর্বশেষ করিডরটি খান ইউনিসের পশ্চিম অংশকে পূর্বাংশ থেকে আলাদা করেছে, যার মধ্যে রয়েছে খুজাহ ও আবাসান আল-কাবিরা।

এছাড়াও, যুদ্ধের শুরু থেকেই বিশ্লেষকরা বলছিলেন, ইসরায়েল সীমান্তবর্তী ভবন ধ্বংস করে গভীর ‘বাফার জোন’ তৈরির চেষ্টা করছে। যদিও সাম্প্রতিক যেসব এলাকা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে সেগুলোর অনেকগুলোই গাজার গভীরে।

ইসরায়েলি সীমান্ত থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কৃষিভিত্তিক বসতি কিজান আবু রাশওয়ান। সেখানে ১৭ই মের পর থেকে দেখা যাচ্ছে প্রায় প্রতিটি অবশিষ্ট স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয়েছে। বিবিসির যাচাই করা একটি ভিডিওতে দেখা গেছে যে একটি নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণে একগুচ্ছ বহুতল ভবন ধ্বংস করা হয়েছে।

বিবিসি ভেরিফাই আইডিএফ-এর কাছে যেসব জায়গায় ধ্বংসের প্রমাণ পাওয়া গেছে সেসবের তালিকা দিয়ে সুনির্দিষ্ট সামরিক ব্যাখ্যা চেয়েছিল। তারা কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি।

আইডিএফ-এর একজন মুখপাত্র বলেন, এটা বহুলভাবে প্রমাণিত যে হামাস ও অন্যান্য সন্ত্রাসী সংগঠন ঘনবসতিপূর্ণ বেসামরিক এলাকায় সামরিক সম্পদ লুকিয়ে রাখে,” । “আইডিএফ এসব এলাকায় অবস্থিত সন্ত্রাসী অবকাঠামো শনাক্ত করে ও ধ্বংস করে।

যেসব মানবাধিকার আইনজীবী বিবিসি ভেরিফাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের মতে এই অভিযান যুদ্ধাপরাধের পর্যায়ে পড়তে পারে।

জেরুজালেমভিত্তিক ডায়াকোনিয়া ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যানিটারিয়ান ল’ সেন্টারের জ্যেষ্ঠ আইন বিশেষজ্ঞ ইতান ডায়মন্ড বলেন, সাধারণত যুদ্ধকালে বেসামরিক নাগরিক সুরক্ষার বিষয়ে প্রযোজ্য চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের আওতায় এর খুব একটা যৌক্তিকতা নেই।আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুযায়ী যুদ্ধের সময় এমনভাবে বেসামরিক সম্পদ নিয়ন্ত্রিতভাবে ধ্বংস করাকে নিষিদ্ধ করে, কেবলমাত্র সামরিক অভিযানের প্রয়োজনীয়তার সংকীর্ণ শর্ত বাদে। 

ভবিষ্যতে কোনো সম্পত্তি হয়তো হামলার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে – এমন অনুমানের ভিত্তিতে ধ্বংস করা এই নিয়মের আওতার বাইরে।

অক্সফোর্ড ইনস্টিটিউট ফর এথিকস, ল’ অ্যান্ড আর্মড কনফ্লিক্টের সহ-পরিচালক অধ্যাপক জানিনা ডিল বলেন, কোনো দখলদার শক্তির ওই অঞ্চলের মানুষের কল্যাণে শাসন করতে হবে। এই নীতি সেসব সামরিক কৌশলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, যেখানে একটি অঞ্চলকে বাসযোগ্য রাখার বদলে সবকিছু ধ্বংস করে দেয়া হয়।

তবে কিছু বিশ্লেষক আইডিএফ-এর এই অভিযানকে সমর্থন করারও চেষ্টা করেছেন।

 

 

কিউএনবি/আয়শা//২০ জুলাই ২০২৫,/বিকাল ৫:১২

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

July 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit