আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষে ভারতের জাতীয় শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ (এনসিইআরটি) অষ্টম শ্রেণির সমাজবিজ্ঞান পাঠ্যবইতে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে, যা দেশটিতে তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। নতুন পাঠ্যবইয়ে মুঘল সম্রাট বাবর, আকবর ও আওরঙ্গজেবকে জ্ঞান-সাহিত্যের অনুরাগী হিসেবে উল্লেখ করা হলেও, তাদেরকে একইসাথে নৃশংস শাসক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে যারা লুটপাট, দাস বানানো এবং বলপ্রয়োগে ভারতীয় জনগণের উপর শাসন কায়েম করেছিল।
এনসিইআরটি দাবি করছে, এটি ইতিহাসকে ‘স্যানিটাইজড’ না করে তার সম্পূর্ণতা উপস্থাপনের প্রচেষ্টা। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, এটি একাডেমিক সততার চেয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি পদক্ষেপ, যা মুসলমানদের অবদানকে খাটো করে দেখিয়ে তাদের বর্বর হিসেবে তুলে ধরার মাধ্যমে ভারতের ইতিহাস থেকে তাদের বৈধতা মুছে ফেলার প্রচেষ্টা।
এটি নতুন কোনো ঘটনা নয়। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং তাদের আদর্শিক রূপ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) ধারাবাহিকভাবে ভারতের পাঠ্যবইগুলোতে পরিবর্তন এনেছে, যাতে ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরা যায়। এই প্রক্রিয়ায় মুসলিম শাসকদের, যারা এক সময় ভারতের বহুত্ববাদী ইতিহাসের অংশ ছিলেন, ‘বিদেশি দখলদার’ এবং ‘ধর্মীয় গোঁড়া’ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
পুরনো পাঠ্যবই থেকে দিল্লি সালতানাত এবং মুঘল দরবার নিয়ে সম্পূর্ণ অধ্যায় বাদ দেওয়া হয়েছে। এমনকি ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদকেও রাজনৈতিক বিজ্ঞান থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু ইতিহাসের এক অমোঘ সত্য হলো, রাজতন্ত্র সর্বত্রই সহিংসতাকে শাসনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। মুঘল সম্রাটদের মতো হিন্দু, খ্রিস্টান বা অন্য যে কোনো শাসক যুদ্ধ করেছে, বিরোধ দমন করেছে এবং কখনো কখনো উপাসনালয়ও ধ্বংস করেছে। ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ শাসকরা ইউরোপ এবং তাদের উপনিবেশে হত্যাযজ্ঞ, ধর্মান্তর ও দখলদারি চালিয়েছে। হেনরি অষ্টম তার স্ত্রী ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের হত্যা করেছেন। এলিজাবেথ প্রথম ক্যাথলিকদের দমন করেছেন এবং আয়ারল্যান্ডে যুদ্ধ করেছেন। এমনকি ইউরোপীয় রাজপরিবারের মধ্যেও ক্ষমতার জন্য ভাই, বোন, কাজিন ও উপদেষ্টাদের হত্যা করা হয়েছে। সহিংসতা এবং দখলদারি ছিল রাজতন্ত্রের শাসনের ভাষা।
শুধুমাত্র মুঘলদের ‘বর্বর’ হিসেবে চিহ্নিত করা এবং অন্যান্য শাসকদের একই ধরনের কাজ উপেক্ষা করা ইতিহাস বিকৃতি এবং একাডেমিক অসততা। মুঘলরা তাদের শাসনামলে প্রশাসন, শিল্প, স্থাপত্য ও আন্তঃধর্মীয় সংলাপে ভারতের বহু টেকসই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল। আকবরের ‘দীন-ই-ইলাহি’ এবং ‘সুলহ-ই-কুল’ নীতিমালা ধর্মীয় সহাবস্থানের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী প্রচেষ্টা ছিল।
এই ধরণের বিকৃত ইতিহাস চূড়ান্ত রাজনৈতিক পরিণতির জন্ম দেয়। তরুণ প্রজন্মকে একপাক্ষিক ইতিহাস শেখানোর মাধ্যমে ভারতের ২০ কোটি মুসলমানের প্রতি সন্দেহ এবং ঘৃণা জন্মানোর সুযোগ তৈরি করা হচ্ছে।
এটি শুধুমাত্র ইতিহাস বিকৃতি নয়, এটি ফ্যাসিবাদের বীজ বপন। মুঘলদের এভাবে দানব হিসেবে উপস্থাপন করা মুসলমানদের অন্তর্নিহিত সহিংস হিসেবে চিত্রিত করার বৈশ্বিক প্রয়াসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যার মাধ্যমে তাদের প্রান্তিক করা, নির্যাতন করা এবং এমনকি ধ্বংস করে দেওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়।
এই ধারা আমরা গাজায় গণহত্যা, এবং এর আগে ইরাক, লিবিয়া, লেবানন ও সিরিয়ায় বিদেশি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি করে মুসলিম দেশগুলোর রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো ভেঙে দেওয়ার মধ্যে দেখেছি।
ইতিহাসকে তার মহিমা ও বিভীষিকা উভয়ের সাথেই উপস্থাপন করতে হবে। কোনো সম্প্রদায়কে দানব হিসেবে তুলে ধরার জন্য নির্দিষ্ট অংশকে বেছে নিয়ে বাকি অবদান মুছে ফেলা স্পষ্টতই প্রোপাগান্ডা। এর পরিণতি সমাজে, রাজনীতিতে এবং রক্তে বিস্ফোরিত হবে।
লেখক লাহোরভিত্তিক একজন জননীতি বিশ্লেষক। তার সঙ্গে durdananajam1@gmail.com ঠিকানায় যোগাযোগ করা যেতে পারে।
কিউএনবি/আয়শা//১৯ জুলাই ২০২৫,/সন্ধ্যা ৭:৪৪