ডেস্ক নিউজ : সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখের তরুণের কণ্ঠে ‘পানি লাগবে, পানি’— এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হৃদয় ছুঁয়ে যায় কোটি মানুষের। মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে তার মুঠোফোনে দৃশ্যটি ধারণ করে তার বন্ধুরা। পরবর্তীতে ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
গত বছরের এ দিনেই ১৮ জুলাই উত্তরায় কোটা আন্দোলনে তৎকালীন আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী ও শিক্ষার্থীদের সাথে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সেখানেই মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ মারা যান। ব্যক্তিগত খরচে তিনি পানি আর বিস্কুট বিতরণ করছিলেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মাঝে, এমনকি অসুস্থ কয়েকজনকেও নিয়ে গিয়েছিলেন হাসপাতালে।
তবে মানুষের পানির পিপাসা মেটাতে পারলেও নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়, পেছন দিক থেকে মাথায় লাগা গুলিতে হঠাৎ লুটে পড়েন তিনি, দুই হাতে পানি আর বিস্কুট তখনও ছিল অক্ষত, রক্তাত্ত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়েও বাঁচানো যায়নি।
মূহুর্তেই জীবন্ত রঙিন ক্যানভাসটি সাদা কালো বিষাদে পরিণত হলো। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে গোটা দেশের মানুষকে শোকে স্তব্ধ করে দিয়ে মুগ্ধ শুয়ে আছে ঢাকার কামারপাড়া (বামনারটেক) কবরস্থানে। সারাদেশ তথা বিশ্বের কাছে পরিচিত পেলেন অভুত্থ্যানের অন্যতম হিসেবে। আবু সাঈদ, ওয়াসিম, মুগ্ধদের আত্মত্যাগের পরেই কোটাবিরোধী আন্দোলন বেগবান হয় আরও। যা রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে ফেসবুকে বেশ কয়েকটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন মুগ্ধ। পরবর্তীতে সেগুলো ছড়িয়ে পড়ে বেশ।
গত বছরের ১৫ জুলাই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের ভিডিও শেয়ার করে তিনি বলেছিলেন, ‘ওখানে থাকতে পারলে ভালো হতো।’
মুগ্ধ এখন সারা বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে স্ব-মহিমায় জায়গা করে নিয়েছে। পরের দিন রংপুরে আবু সাঈদের মৃত্যু হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছিল তার। সে ভিডিও শেয়ার করে লিখেছিল, ‘লোক দেখানো চেতনা না এটা। কতটা চেতনা থাকলে নিজের জীবন দিয়ে দেয়া যায়—দেখে নাও কুকুরের দল। এই রক্তের শোধ দিতে হবে না?’
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন:
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গনিত ডিসিপ্লিন থেকে স্মাতক সম্পন্ন করেন মুগ্ধ। পরে মার্স্টাসে ভর্তি হন বাংলাদেশ ইউনির্ভাসিটি প্রফেশনাল (বিউপি) বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া হলেও ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছেন রাজধানীর উত্তরায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের স্মৃতিচারণায় মুগ্ধ কেবলই তাদের শক্তি, প্রেরণা। এরইমধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্মিত প্রধাণ ফটকের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ মুগ্ধ তোরণ।
রাজধানীতে হলেও পড়াশোনার সুবাধে খুলনাকে বেশ আপন করে নিয়েছিল। ভাবনায় ছিল কোনও এক সময় একটি ফ্ল্যাট নেবেন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে, সময় কাটাবেন প্রিয়জনদের সঙ্গে। কিন্তু তা আর হলো না।
দুরন্তপনা, পরোপকারী মুগ্ধ ক্যাম্পাসে সকালে বের হতেন, ফিরতেন রাতেই। ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিয়েও নিয়মিত ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করতেন। কারও বিপদে-আপদে এগিয়ে যেতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনে এগিয়ে আসতেন, নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে একাধিক অনুষ্ঠানে।
সর্বশেষ মুগ্ধ তার ফেসবুক প্রোফাইলের ছবিতে ক্যাপশন দিয়েছিলেন— ‘বাবুমশায়, জিন্দেগি বড়ি হোনে চাহিয়ে, লম্বি নেহি’ অর্থাৎ জীবন লম্বা নয়, বড় হওয়া জরুরি। ঠিক তেমনই দেশের প্রয়োজনে নিজের জীবন অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন তিনি। হয়েছেন কোটি মানুষের প্রেরণা।
কিউএনবি/আয়শা//১৮ জুলাই ২০২৫,/রাত ১১:১২