ডেস্ক নিউজ : আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন লুটপাট হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, এমনকি সরকারি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে পরিচালকদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে লুটপাট হয়েছে। আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ আর্থিক খাতের দুর্বৃত্তরা এসব করেই ক্ষান্ত হয়নি। তারা সবল ব্যাংক দখল করে লুটপাট চালিয়েছে। লুটের টাকা পাচার করেছে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ ও রাজনৈতিক বিবেচনায় ছাড় দেওয়ার কারণে ব্যাংকগুলোর আয় কমেছে রেকর্ড পরিমাণে। একই সময়ে মূলধন ঘাটতি ও প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে। তারল্য সংকটও বেড়েছে। সব মিলে ব্যাংক খাত দুর্বল হয়েছে। ব্যাংক খাতের দুর্বলতার কারণে এখন অর্থনীতির গতি কমে গেছে। তারল্য সংকটের ফলে অভ্যন্তরীণ ঋণের জোগান হ্রাস পেয়েছে।
সরকারি খাতে সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যাংক ছিল বেসিক ব্যাংক। লুটপাটের মাধ্যমে এটিকে অত্যন্ত দুর্বল করা হয়েছে। আগে পদাধিকারবলে এর পর্ষদের চেয়ারম্যান থাকতেন শিল্প সচিব। সদস্য হিসাবে থাকতেন আরও কিছু সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা। ফলে ব্যাংকটি বেশ ভালোভাবে চলছিল। এর খেলাপি ঋণ ছিল ৩ শতাংশের কম। প্রতিবছর সরকারকে মোটা অঙ্কের লভ্যাংশ দিত। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এর চেয়ারম্যান করা হয় দলীয় ঘনিষ্ঠ আবদুল হাই বাচ্চুকে। তিনি চেয়ারম্যান হয়ে ব্যাংকের প্রশাসন ব্যবস্থা ভেঙে ফেলেন। যাকে খুশি তাকে ঋণ দিতে থাকেন। পর্ষদকে বানিয়ে ফেলেন অন্ধ ঘোড়া। যাদের ক্ষমতা আছে অনেক, কিন্তু কিছুই করতে পারেন না।
এই সুযোগে ব্যাংকের একক কর্তৃত্ব নিয়ে তিনি যাকে খুশি তাকে ঋণ নিতে শুরু করেন। কোনো নিয়ম-কানুনের বালাই ছিল না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন ড. আতিউর রহমান। তাকে বেসিক ব্যাংকের বিষয়গুলো জানানো হলে তিনিও লুটপাটের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো অবস্থান নেননি। ২০১০ থেকে ২০১৩ এই তিন বছরে ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা চলে যায় লুটপাটকারীদের হাতে। এই টাকা আদায় না হওয়ায় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। গত মার্চে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ শতাংশে। খেলাপি ঋণের কারণে মূলধন ঘাটতি বেড়েছে। তারল্য সংকট প্রকট হয়েছে। ফলে এক সময়ের সবল ব্যাংকটি এখন ভয়ানকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। লাভের পরিবর্তে লোকসান হচ্ছে। সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে অন্যতম দুর্বল ব্যাংক হচ্ছে বেসিক। অর্থ সংকটে কর্মীদের বেতন-ভাতা ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারছে না।
সরকারি খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবার ওপরে ছিল জনতা ব্যাংক। সময় নিয়ে লুটপাট করে দুর্বল করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিসমিল্লাহ গ্রুপের মাধ্যমে এ ব্যাংকে লুটপাট শুরু হয়। এর নেপথ্যে ছিলেন সরকারদলীয় একজন সংসদ-সদস্য। তিনি প্রভাব খাটিয়ে প্রথমে জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। পরে আরও ৬টি ব্যাংক থেকে মোট ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পুরোটাই বিদেশে পাচার করে দেন। এরপর সরকারি প্রভাবে ক্রিসেন্ট গ্রুপের ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি, এ্যানন টেক্স গ্রুপের ৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি ঘটনা ঘটে।
বেক্সিমকো গ্রুপ প্রভাব খাটিয়ে শুধু স্থানীয় কার্যালয় থেকেই ঋণ নেন ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। অথচ একটি শাখা বা কোনো ব্যাংক একজন গ্রাহককে এত বেশি ঋণ নিতে পারে না। এসব ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো অনুমোদনও নেওয়া হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জনতা ব্যাংকের কাছে দফায় দফায় বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণের তথ্য চেয়েও পায়নি। ওই ঋণের মধ্যে এখন ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা খেলাপি। এছাড়া ব্যাংকটি রাজনৈতিক চাপে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নগদ টাকায় খেলাপি ঋণ কিনে সেগুলোকে নতুন ঋণ দিয়েছে। সেসব ঋণ এখন আবার খেলাপি হয়েছে। সব মিলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫ শতাংশে। ২০০৯ সালের শুরুতে খেলাপি ঋণ ছিল ৫ শতাংশের নিচে। ব্যাংক এখন প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতিতে ভুগছে। ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে গেছে। প্রতিবছর লোকসান দিচ্ছে।
সরকারি খাতের অগ্রণী ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ২০০৯ সালের শুরুতে ছিল ২০ শতাংশের কম। এখন তা বেড়ে ৪১ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। সরকারি খাতের সোনালী ব্যাংকে ২০১০ সালেই শুরু হয় হলমার্ক গ্রুপের কেলেঙ্কারি। গ্রুপটি সোনালী ব্যাংকসহ ২৭টি ব্যাংক থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেন। এর নেপথ্যে থেকে গ্রুপকে সমর্থন দিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এক উপদেষ্টা। ওই সময়ে এটিই ছিল সবচেয়ে বড় ঋণ কেলেঙ্কারি। এ কারণে সোনালী ব্যাংক দুর্বল হয়েছে। এ ধকল এখন কিছুটা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। এরপর ব্যাংক থেকে আর বড় কোনো ঋণ দেওয়া হয়নি। যে কারণে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ এখন ২১ শতাংশের মধ্যে সীমিত রয়েছে।
সরকারি খাতের রূপালী ব্যাংকে লুটপাটের থাবা কম পড়েছে বলে এ ব্যাংক কিছুটা কম দুর্বল হয়েছে। তারপরও এতে বেক্সিমকো গ্রুপসহ আরও কয়েকটি গ্রুপের নামে বড় অঙ্কের ঋণ রয়েছে। যে কারণে খেলাপি ঋণ বেড়ে এখন ৩৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বেসরকারি খাতের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ইসলামী ব্যাংক দখল করে লুটপাট করা হয়েছে। এই ব্যাংক থেকে ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা বের করে নেওয়া হয়েছে। এগুলো এখনো সব খেলাপি হয়নি। ধীরে ধীরে খেলাপি হচ্ছে। যে কারণে খেলাপি ঋণ বেড়ে এখন ২৮ শতাংশে উঠেছে। আগে খেলাপি ঋণ ছিল ৯ শতাংশের কম।
দুই দফা দখল করে লুটপাট চালানো হয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংকে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রথমে এটি দখলে নেয় সিকদার গ্রুপ। তারা ব্যাপক লুটপাট করে। পরে এটিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হলে সিকদার গ্রুপ আপত্তি করে। তখন সাবেক গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার ব্যাংকটি এস আলম গ্রুপের হাতে তুলে দেন। তারাও ব্যাংকটিতে লুটপাট চালায়। ফলে এখন খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫ শতাংশ। মূলধন ঘাটতিও প্রকট।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক এস আলম গ্রুপের দখলেই ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইন প্রয়োগের শিথিলতার সুযোগ নিয়ে এটিতেও তারা লুটপাট চালায়। লুটের ঋণ সব খেলাপি হচ্ছে। যে কারণে এখন খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৭ শতাংশে। আইএফআইসি ব্যাংকে সালমান এফ রহমান একাই লুটপাট করেছেন। যে কারণে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এখন ৫৮ শতাংশের বেশি। লুটপাটের কারণে নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত। এর মধ্যে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ৫৫ শতাংশ। পদ্মা ব্যাংকে দুই দফায় লুটপাট হয়েছে। প্রথমে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের হাত ধরে ব্যাংকটি চালুর পরই তিনি লুটপাট করেন। তিনি ছিলেন ব্যাংকটির উদ্যোক্তা চেয়ারম্যান।
পরে ব্যাংকটি অচল হয়ে পড়লে একে নতুন করে পুঁজির জোগান দেওয়া হয় সরকারি খাতের ব্যাংক থেকে। তখন এর নেতৃত্বে আসেন নাফিজ সারাফত। তিনি ব্যাংকে লুটপাট করেন। যে কারণে এখন খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৭ শতাংশে। সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকে লুটপাটের কারণে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৭ শতাংশে। ইউনিয়ন ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯০ শতাংশ। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে যে লুটপাট হয়েছে তার পুরোটাই করেছেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ ও তার ঘনিষ্ঠরা। প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে। ব্যাংকে এখন খেলাপি ঋণ ১৫ শতাংশ।
কিউএনবি/আয়শা//১৮ জুলাই ২০২৫,/বিকাল ৪:৫৪