ডেস্ক নিউজ : একজন মুসলিম হিসাবে আরবিতে ১২ মাসের নাম আমাদের মনে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা প্রায় সবাই ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী জীবন-যাপন করি, যার ফলে আমরা ইসলামি ক্যালেন্ডারের মাস খুব একটা মনে রাখি না।
আরবি ক্যালেন্ডারের ১২ মাসের প্রতিটি নামের নিজস্ব অর্থ এবং তাৎপর্য রয়েছে, যা আরবি ভাষা ও সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে গঠিত। প্রতিটি মাসের নামের পেছনে একটি ইতিহাস ও অর্থ রয়েছে যা ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
হিজরি ক্যালেন্ডারের উৎপত্তি ও পটভূমি
আরবি ক্যালেন্ডার বা হিজরি ক্যালেন্ডার একটি চন্দ্রভিত্তিক বর্ষপঞ্জি, যা চাঁদের গতি ও পর্যায় অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম ধর্মের নবী মুহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার বছর থেকেই এই ক্যালেন্ডারের গণনা শুরু হয়। এই ঘটনাটি ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এর উপর ভিত্তি করে হিজরি ক্যালেন্ডারের গণনা চলে।
হিজরি ক্যালেন্ডার এবং চন্দ্র ও সৌর বর্ষপঞ্জির পার্থক্য
হিজরি ক্যালেন্ডার সম্পূর্ণভাবে চন্দ্রের উপর নির্ভরশীল, যার ফলে প্রতি মাস ২৯ থেকে ৩০ দিনের হয় এবং পুরো বছর প্রায় ৩৫৪ দিনে সম্পন্ন হয়। অন্যদিকে সৌর বর্ষপঞ্জি বা ইংরেজি ক্যালেন্ডার ৩৬৫ দিনের এবং সূর্যের উপর নির্ভরশীল।
এই পার্থক্যের কারণে হিজরি মাসগুলো প্রতি বছর সৌর ক্যালেন্ডারের সঙ্গে ১০-১২ দিন পিছিয়ে যায়। এ কারণেই ইসলামি গুরুত্বপূর্ণ মাস যেমন রমজান, ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা বিভিন্ন বছরে ভিন্ন সময়ে আসে।
হজরত আবু বাকরা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, বছরে বারোটি মাস রয়েছে, তার মধ্যে চারটি মাস হলো সম্মানিত। (সহিহ বুখারি)
ইসলামি পঞ্জিকার ১২টি মাস হলো: মুহররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউস সানি, জমাদিউল আউয়াল, জমাদিউস সানি, রজব, শাবান, রমজান, শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ।
এই মাসগুলোর মধ্যে চারটি মাসকে সম্মানিত মাস হিসেবে ধরা হয়। এই মাসগুলো হলো: জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব। প্রতিটি মাসেই কিছু নির্দিষ্ট ইবাদত, উৎসব ও ঐতিহাসিক ঘটনা পালিত হয়।যেমন,
১. মুহাররম:-মুহাররম মাস ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেননা এই মাসের ১০ তারিখে আশুরা পালন করা হয়। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আশুরার দিন রোজা রাখলে এক বছরের গুনাহ মাফ করা হয়। (সহিহ মুসলিম)
২. সফর:- সফর মাস সম্পর্কে কিছু ঐতিহ্য অনুযায়ী, মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার জন্য সফর মাসে কিছু সতর্কতা ও বিশেষ ইবাদত পালন করা হয়।
৩. রবিউল আউয়াল :-রবিউল আউয়াল হলো মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম এবং ইন্তেকালের মাস। মুসলিমরা এই মাসে নবীজীর স্মরণে মিলাদুন্নবী ও সিরাতুন্নবী (সা.) পালন করেন।
৪. রবিউস সানি:- এই মাসটি ‘দ্বিতীয় বসন্ত’ এবং ইসলামের ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে পরিচিত। এই মাসেও কিছু বিশেষ ইবাদত রয়েছে যা ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা রয়েছে।
৫. জমাদিউল আউয়াল:- এই মাসটির অর্থ হচ্ছে ‘প্রথম শীতলতা’। এই সময় প্রাচীন আরবে শীতকাল ছিল বিধায় জমাদিউল আউয়াল মাস নামকরণ করা হয়েছিল। ইসলামে এই মাসটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় হিসেবে বিবেচিত হয়।
৬. জমাদিউস সানি:-এই মাসটির অর্থ হচ্ছে ‘দ্বিতীয় শীতলতা’। এটি ইসলামের ঐতিহ্যে এই মাসেও নফল রোজা ও বিশেষ ইবাদত পালিত হয় এবং আরবের শীতকালের শেষ মাস হিসেবে পরিচিত।
৭. রজব:- রজব মাসে শবে মেরাজ পালন করা হয়। যে রাতে আমাদের প্রিয় রাসুল (সা.) মহান আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই রাতে মুসলিমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য বেশি বেশি দোয়া করেন।
৮. শাবান:- শাবান হচ্ছে মূলত হলো পবিত্র রমজানের আগের মাস। এই মাসে শবে বরাত পালন করা হয়, যা মুসলিমদের জন্য একটি বিশেষ রাত। শবে বরাতে মুসলিমরা বিশেষ ইবাদত করেন এবং দোয়া করেন।
৯. রমজান:- রমজান হলো ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ মাস। এই মাসে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছিল এবং মুসলিমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রোজা রাখেন। মুসলিমরা আত্মশুদ্ধি এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করেন মূলত রমজানে রোজা রাখা, ইফতার করা, তারাবি নামাজ পড়া এবং লাইলাতুল কদর পালনের মাধ্যমে।
১০. শাওয়াল মাস:-শাওয়াল মাস হলো ঈদুল ফিতরের মাস, যা রমজানের শেষে শাওয়াল মাসের ১ তারিখে পালিত হয়। ঈদুল ফিতর মুসলিমদের জন্য একটি আনন্দের উৎসব, যেখানে তারা একত্রিত হয়ে নামাজ আদায় করেন এবং সবার মাঝে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করেন। ঈদুল ফিতরের পরে শাওয়াল মাসের ৬টি রোজা রাখলে অতিরিক্ত সওয়াব লাভ করা যায় বলে হাদিসে বর্ণিত আছে।
১১. জিলক্দ:-জিলক্দ মাস হচ্ছে মূলত পবিত্র হজের প্রস্তুতির একটি মাস। এটি সাধারনত শান্তির মাস হিসেবে বিবেচিত এবং এই মাসে যুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ছিল।
১২. জিলহজ:- জিলহজ হলো হজের মাস, যখন মুসলিমরা মক্কায় গিয়ে হজ পালন করেন। এই মাসের ১০ তারিখে ঈদুল আজহা পালিত হয়, যা কুরবানির উৎসব হিসেবে পরিচিত।
*এই বারোটি মাসের মধ্যে চারটি মাস বিশেষভাবে সম্মানিত: রজব, জিলকদ, জিলহজ্ব এবং মহররম।
* রমজান মাস মুসলিমদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাস, যেখানে রোজা রাখা ফরজ এবং লাইলাতুল কদর এই মাসেই হয়ে থাকে।
* জিলহজ মাসে হজ ও কুরবানি করা হয়।
* মহররম মাসের দশম দিনটি আশুরা নামে পরিচিত, যা মুসলিমদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন।
ইসলামিক দেশগুলোতে আরবি মাসের বর্তমান প্রভাব:-
বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে আরবি মাসগুলোর গুরুত্ব রয়েছে। আরবি ক্যালেন্ডারের সঙ্গে ইসলামিক ধর্মীয় উৎসবগুলো পালিত হয় এবং এ মাসগুলোতে বিভিন্ন রাষ্ট্রে সরকারি ছুটি ও বিশেষ ইবাদতের আয়োজন থাকে। উদাহরণস্বরূপ, রমজান মাসে রোজা রাখা, ইফতার আয়োজন এবং তারাবি নামাজ মুসলিম বিশ্বের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান।
আরবি ১২ মাসের প্রতিটি নাম, তাদের ইতিহাস এবং তাৎপর্য ইসলামি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অপরিহার্য অংশ। এই মাসগুলো ইসলামি অনুষ্ঠান, ইবাদত ও ধর্মীয় রীতিনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। চন্দ্র ক্যালেন্ডারের ভিত্তিতে গণনা হওয়ায় এ মাসগুলোতে চাঁদের পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে। বর্তমান মুসলিম সমাজে এই মাসগুলোর প্রতি যে গুরুত্ব আরোপ করা হয় তা আমাদের ঐতিহ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয় এবং বিশ্বজুড়ে মুসলিম সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করে।
এই মাসগুলোর প্রতি সচেতনতা ও সম্মান প্রদর্শন আমাদের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে, যা ইসলামি সংস্কৃতির পরিচয় ও তাৎপর্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অপরিহার্য।আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে আরবি বার মাসের ফজিলত, মর্যাদা ও আমলের প্রতি গুরুত্বারোপ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
কিউএনবি/আয়শা//০৮ জুলাই ২০২৫,/রাত ৮:০৪