আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হল দূরপাল্লার একটি অস্ত্র যা বাঁকা গতিপথ অনুসরণ করে নির্ধারিত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। এটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়, যার ওয়ারহেড নির্দিষ্ট বস্তু বা স্থাপনা ধ্বংসে প্রয়োজনীয় বিস্ফোরক বহনে সক্ষম।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা এবং জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের ওপর হামলার প্রতিক্রিয়ায় দেশটি ইসরায়েলের দিকে শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। এরমধ্যে কিছু কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতেও সক্ষম হয়েছে।
যদিও ইসরায়েল ইরানের ছোঁড়া অনেক ক্ষেপণাস্ত্র তাদের ‘আয়রন ডোম’-এর মাধ্যমে প্রতিহত করেছে বলে দাবি করেছে। তবে বেশ কয়েকটি তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে ফেলে ভূমিতে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। এর ফলে তেল আবিব, বন্দর নগরী হাইফাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় উল্লেখযোগ্য ক্ষতিসাধন হয়েছে। সেইসাথে হতাহত হয়েছে বহু ইসরায়েলি।
যদিও ইরানের কাছে ঠিক কতগুলো ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে তা স্পষ্ট নয়। তবে তাদের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো যে এই অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত এবং অপ্রতিরোধ্য, তা সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সহজেই অনুমান করা যায়।
ব্যালিস্টিক মিসাইল সাধারণত তিনটি ধাপে কাজ করে। এই ধাপগুলো হল—
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো মহাদেশ জুড়ে কয়েকশ কিলোমিটার থেকে শুরু করে ১০ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকে মূলত তাদের পাল্লার ওপর ভিত্তি করে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়—
যুদ্ধক্ষেত্রের পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (বিআরবিএম): এ ধরনের মিসাইলের পাল্লা ২০০ কিলোমিটারের কম (১২৪ মাইল)।
স্বল্প পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (এসআরবিএম): এ ধরনের মিসাইল দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে এক হাজার কিলোমিটারের কম (৬২১ মাইল)।
মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (এমআরবিএম/আইআরবিএম): এ ধরনের মিসাইল এক হাজার কিলোমিটার থেকে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার (৬২১-২১৭৫ মাইল) পাল্লার হয়ে থাকে।
দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (এলআরবিএম): এটি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার (২১৭৫-৩৪১৮ মাইল)।
আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম): এ ধরনের মিসাইল সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটারের বেশি (৩৪১৮ মাইল) পাল্লার হয়ে থাকে।
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো অত্যন্ত উচ্চ গতি সম্পন্ন হয়ে থাকে। এগুলো মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে। তারা যে গতিতে ভ্রমণ করে, তা ‘ম্যাক’ এ পরিমাপ করা হয়, যা শব্দের গতির সমান। যদি বলা হয়, ‘ম্যাক ৫’, তার মানে সেই ক্ষেপণাস্ত্রের গতি শব্দের গতির চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি।
কিছু সাধারণত স্বল্প-পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল সুপারসনিক গতিতে পৌঁছায়, যা ম্যাক ১ এর চেয়ে দ্রুত। এর গতি ঘণ্টায় প্রায় ১,২২৫ কিমি বা ৭৬১ মাইল/ঘন্টা। তবে দূরপাল্লার মিসাইলগুলো হাইপারসনিক গতিতে ভ্রমণ করতে পারে। যার গতি ‘ম্যাক ৫’ এর চেয়ে বেশি (৬১২৫ কিমি/ঘণ্টা বা ৩৮০৬ মাইল প্রতি ঘণ্টা) হয়ে থাকে।
ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যে দূরত্ব প্রায় ১৩০০ কিলোমিটার থেকে ১৫০০ কিলোমিটার (৮০০-৯৩০ মাইল)। সেই হিসেবে ইরান থেকে ‘ম্যাক ৫’ গতিতে যাত্রা করা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো মাত্র ১২ মিনিটের মধ্যে ইসরায়েলে আঘাত হানতে পারে। যদিও সঠিক সময় ক্ষেপণাস্ত্রের ধরণ এবং উৎক্ষেপণের স্থানের ওপরও অনেকাংশে নির্ভর করে।
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর দীর্ঘ পাল্লা এবং উচ্চ গতির কারণে এগুলোকে বাধা দেওয়া অত্যন্ত দুরূহ। আর এই বৈশিষ্ট্যই মিসাইলগুলোকে বিশেষভাবে বিপজ্জনক করে তোলে।
মিসাইলগুলো অনেক দ্রুত ও অত্যাধিক উঁচু দিয়ে উড়ে যাওয়ার কারণে সাধারণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলোর (রাডার) চোখ অনেকটাই ফাঁকি দিতে সক্ষম। আর যখন সেটি বায়ুমণ্ডলে পুনরায় প্রবেশ করে, তখন তা আরও দ্রুতবেগে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। তাই পাল্টা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলো বেশিরভাগ সময়ই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রকে পরাস্ত করতে পারে না।
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের বিপরীতে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রগুলো পাইলটবিহীন বিমানের মতো নিচু এবং স্থিরভাবে উড়ে যায়। যা তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অতিক্রম করতে সাহায্য করে। যদিও এগুলো ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের তুলনায় অনেক ধীর গতিতে ভ্রমণ করে, তবে তাদের নিম্ন উড়ানের পথ এগুলোকে সনাক্ত করা কঠিন করে তোলে।
ইরান থেকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো প্রায় ১২ মিনিটের মধ্যে ইসরায়েলে পৌঁছাতে পারলেও, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রগুলো প্রায় দুই ঘণ্টা এবং ড্রোনগুলি নয় ঘণ্টা পর্যন্ত সময় নিয়ে থাকে।
উল্লেখ্য, ইরান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রও ব্যবহার করেছে।
গত তিন দশক ধরে ইরান বিভিন্ন ধরণের ব্যালিস্টিক মিসাইল এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে। নিচের গ্রাফটিতে ইরানের কিছু উল্লেখযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র এবং তাদের পাল্লার সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরা হয়েছে।
ইসরায়েলের কাছে ক্ষেপণাস্ত্রের একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ অস্ত্রাগার রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে দূরপাল্লার এবং পারমাণবিক ওয়ারহেড বহনে সক্ষম মিসাইল। আর এগুলো তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক দশকের সহায়তায় তৈরি করেছে। নিচের গ্রাফটিতে ইসরায়েলের কিছু উল্লেখযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র এবং তাদের নিজ নিজ পাল্লা তুলে ধরা হয়েছে।
ইসরায়েলি বিমান প্রতিরক্ষা মূলত ‘আয়রন ডোম’ সিস্টেমের ওপর নির্ভর করে। যা একটি রাডার দিয়ে সজ্জিত এবং তার দিকে আগত যে কোনও ধরণের মাঝারি এবং দীর্ঘ পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রকে প্রতিহত করতে সক্ষম।
তবে দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে তা কতটুকু কার্যকর তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
ছবি ও তথ্যসূত্র: আলজাজিরা
কিউএনবি/আয়শা/১৭ জুন ২০২৫, /রাত ৮:০৮