ডেস্ক নিউজ : মক্কা ও মদীনা সৌদি আরবের দুটি প্রসিদ্ধ শহর। মসজিদুল হারাম, মসজিদুন নববি এ দুই শহরের প্রধান আকর্ষণ। এছাড়া নবী ও রাসূলদের পদধূলিতে সুপ্রাচীন কাল থেকেই এ নগরী ধারণ করে আছে এক সমৃদ্ধশালী ইতিহাস।
রাসূল সা. এর জন্ম থেকে শুরু করে ৫৩ বছর অতিবাহিত করেছেন এই মক্কায় এবং জীবনের বাকি ১০ বছর পার করেছেন প্রশান্তিময় শহর মদীনাতে।
এই দীর্ঘ সময়ে তাদের সাথে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা কালের সাক্ষী হয়ে আছে আজও, যার ফলে বর্তমান সময়ের মানুষের জন্য মক্কা ও মদীনা এখন আবির্ভূত হয়েছে নানা রকম দর্শনীয় স্থানের সাক্ষী হয়ে।
আজ আমরা মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্র নগরী মক্কা শরিফের ঐতিহাসিক কয়েকটি স্থান নিয়ে আলোচনা করব।
মাওলিদুন্নবী
‘মাওলিদুন্নবী’ অর্থ নবীর জন্মস্থান। এটি মারওয়া পাহাড় বরাবর হারাম শরিফের পূর্ব দিকের চত্বরের পূর্বে রাস্তার পাশে অবস্থিত। বর্তমানে এখানে ‘মক্কা লাইব্রেরি’ নামে একটি ঘর রয়েছে। এটিই প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মস্থান।
জান্নাতুল মুআল্লা
এটা মক্কার কবরস্থান। এ কবরস্থান হারাম শরিফ থেকে উত্তর দিকে অবস্থিত। কবরস্থানের উত্তর দিকে পাহাড়ের কোলের মধ্যে যে অংশ সেটিই প্রাচীন অংশ, এখানেই রয়েছে হযরত খাদিজা (রা.)-এর কবর; যার সামনে জানালা যুক্ত একটা দেয়াল দেখতে পাবেন। এখানে তিনি ছাড়াও হাজার হাজার সাহাবি, তাবেয়ী, আলেম-উলামা ও বুযুর্গের কবর রয়েছে।
মসজিদে জিন
এখানে জিনরা হাজির হয়ে নবীজির কুরআন তিলাওয়াত শুনেছিল। এ মসজিদটি জান্নাতুল মুআল্লার গেটের কাছে অবস্থিত। গেটকে বাম দিকে রেখে গেট সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে আনুমানিক ১০০ কদম সামনের দিকে (উত্তর দিকে) অগ্রসর হলেই এ মসজিদ পড়ে।
জাবালে নূর ও গারে হেরা
মসজিদে হারাম থেকে তিন মাইল উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত একটা পাহাড়ের নাম ‘জাবালে নূর’ (জ্যোতির পাহাড়)। এই পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত একটি গুহাকে বলা হয় ‘গারে হেরা’ (হেরা গুহা)।
নবূওয়াত লাভের পূর্বে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই গুহায় ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। এখানেই সর্বপ্রথম ওহি নাজিল হয়েছিল।
পাহাড়টি ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ২৮১ মিটার উঁচু। ভূমি থেকে পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে সময় লাগে প্রায় এক ঘণ্টা। পাহাড়ের গুহাটির মধ্যে দুজন মানুষ আগে-পিছে হয়ে নামাজ পড়তে পারে।
জাবালে ছাওর ও গারে ছাওর
জাবালে ছাওর (ছাওর পাহাড়) মসজিদে হারাম থেকে চার কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত একটা পাহাড়। ভূ-পৃষ্ট থেকে এর উচ্চতা ৪৫৮ মিটার। সাধারণভাবে এ পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত উঠতে সময় লাগে দেড় ঘণ্টা।
হিজরতের সময় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা.) সহ তিন রাত এ পাহাড়ের চূড়ায় একটি গুহায় আত্মগোপন করেছিলেন। যে গুহাকে বলা হয় ‘গারে ছাওর’ (ছাওর গুহা)।
আরাফার ময়দান
মসজিদে হারাম থেকে দক্ষিণ-পূর্বে হারামের সীমানার বাইরে অবস্থিত একটা বিশাল ময়দান হল আরাফাত। ‘আরাফাত’ শব্দের অর্থ পরিচিতি।
এক বর্ণনামতে, হযরত আদম ও হাওয়া (আ.)-এর জান্নাত থেকে পৃথিবীতে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে অবতরণের পর এ ময়দানে দুজনের মধ্যে সাক্ষাত ও পরিচিতি ঘটেছিল বলে এ ময়দানকে আরাফার ময়দান বলা হয়।
‘তরীকুল মুশাত’ (হাঁটা পথ) দিয়ে আরাফাতের দূরত্ব মক্কা থেকে আরাফাত ১৭ কিলোমিটার।
আরাফার ময়দানের পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত মসজিদের নাম ‘মসজিদে নামিরা’। মসজিদের পশ্চিম পাশে ‘নামিরা’ নামে ছোট একটি পাহাড় রয়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতেই মসজিদটির এ নামকরণ হয়েছে। আরাফার দিন ৯ যিলহজ এ পাহাড়ের পাদশেষে নবীজীর তাঁবু স্থাপিত হয় এবং এ পাহাড়ের নিকটবর্তী ‘উরানা’ উপত্যকায় তিনি বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণ দেন এবং নামাজের ইমামতি করেন।
মসজিদে নামিরা থেকে দেড় কিলোমিটার পূর্ব দিকে আরাফার ময়দানের পূর্ব দিকে রয়েছে ‘জাবালে রহমত’। এটি কঠিন পাথরের চাঁই বিশিষ্ট ছোট একটি পাহাড়। পাহাড়টি ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৬৫ মিটার উঁচু। যার উপরিভাগে একটি চতুস্কোণী উঁচু পিলার রয়েছে। এ পাহড়ের পাদদেশে আরাফার দিন নবীজি দ্বি-প্রহর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দুআ-মুনাজাতে মশগুল থাকেন।
নহরে যুবাইদা
এটি একটি পানির নহর (ড্রেন)। আব্বাসী খলীফা হারূনুর রশীদের স্ত্রী যুবাইদা মক্কাবাসীদের পানির জন্য এ নহরটি তৈরি করেন। আরাফার জাবালে রহমতের পাদদেশে হয়ে ওয়াদী উরানা হয়ে মিনার নিচু এলাকা হয়ে নহরটি মক্কা মুকাররমায় এসেছিল। প্রায় ১২০০ বৎসর যাবত মক্কাবাসীরা এ নহরের পানি দ্বারা উপকৃত হন। এখনও এ নহরের দেয়ালের কিছু নমুনা দেখতে পাওয়া যায়।
মুযদালিফার ময়দান
মসজিদে হারাম থেকে পূর্ব দিকে হাঁটা পথে ৭.২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত খোলা ময়দানটি হল ‘মুযদালিফা’। যা মিনার সঙ্গে লাগোয়া এবং হারামের সীমানার মধ্যে অন্তর্গত।
‘মুযদালিফা’ অর্থ নিকটবর্তী বা রাতের অংশ। সম্ভবত ময়দানটি মিনার নিকটবর্তী হওয়ায় বা হাজীরা এখানে রাতের এক অংশে আগমন করেন বিধায় এ নামকরণ হয়েছে।
মুযদালিফার ময়দানের এক প্রান্তে রয়েছে ‘মসজিদে মাশআরে হারাম’। নবীজী আরাফা থেকে এসে এ মসজিদের কেবলার দিকের স্থানে মাগরিব ও ইশার নামাজ একসঙ্গে আদায় করেন।
মিনা
মসজিদে হারাম থেকে পূর্ব দিকে পায়ে হাঁটা পথ (সুড়ং পথ) দিয়ে ৪ কিলোমিটার দূরে পাহাড় ঘেরা ময়দানের নাম ‘মিনা’। বর্তমানে গোটা ময়দান ফায়ারপ্রুফ তাঁবু দিয়ে ঘেরা বিধায় এটিকে ময়দান মনে হয় না।
‘মিনা’ শব্দের অর্থ প্রবাহিত হওয়া। হাজীগণ এখানে কুরবানী করেন, এতে রক্ত প্রবাহিত হয়। এ হিসাবে এর নামকরণ হয়েছে মিনা।
মিনা ময়দানের পশ্চিম দিকে রয়েছে ‘মসজিদে খায়েফ’। এ মসজিদে নবীজী সহ অনেক নবী নামাজ পড়েছেন এবং এখানে ৭০ জন নবীর কবর রয়েছে।
মিনা ময়দানের পশ্চিম প্রান্তে শয়তানের উদ্দেশ্যে কংকর নিক্ষেপের ৩টা স্থান রয়েছে, এগুলোকে বলা হয় ‘জামারাত’ (তথা ছোট শয়তান, মেঝো শয়তান ও বড় শয়তান)।
হজের সময় হজরত ইবরাহীম (আ.)-এর সামনে শয়তান দৃশ্যমান হওয়ায় তিনি এ ৩টি স্থানে পর্যায়ক্রমে ৭টি করে মোট ২১টি কংকর নিক্ষেপ করেন। ফলে শয়তান সরে যায়। এখানেই তিনি স্বীয় পুত্রকে জবেহ করার জন্য কাত করে শুইয়েছিলেন।
লেখক: শিক্ষক, লেখক ও ধর্মীয় আলোচক
কিউএনবি/আয়শা/২৭ মে ২০২৫, /বিকাল ৫:৫৫