জালাল আহমদ : বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেভাবে আসে : সেনাপ্রধান হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারকে বন্দুকের নলের মুখে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন ।দেশে তখন রাজনৈতিক অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করলে এরশাদকে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ১৯৮৩ সালে ২০ নভেম্বর ঢাকায় এক সমাবেশে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ সর্বপ্রথম
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাব দেন।
নির্দলীয় সরকার ছাড়া সকল দল এরশাদের অধীনে সাধারণ নির্বাচনে না যাওয়ার অঙ্গীকার করেন।কিন্তু আওয়ামী লীগ সহ কয়েকটি দল সেই অঙ্গীকার ভঙ্গ করে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। বিরোধী দলগুলো ১৯৮৮ সালের নির্বাচন বর্জন করে এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে পড়ে।সেই আন্দোলন চাঙ্গা হয় ১৯৯০ সালের অক্টোবরে।
তখন বিএনপি, আওয়ামীলীগ এবং বাম দলগুলোর পক্ষ থেকে ‘তিন জোটের রূপরেখা’ ঘোষণা করা হয়, যেখানে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে
ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানানো হয়েছিল।
দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকার বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন ১৬ সদস্য বিশিষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিষদ গঠন করেন।বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই প্রথম নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তবে তখনও সংবিধানে এই ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল না। ১৯৯১ সালে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার হিসেবে মূলত ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার এদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিয়েছিল জাতিকে।
মাগুরা উপনির্বাচন দিয়ে বির্তক শুরু: ১৯৯৪ সালে মাগুরা-২ আসনের আওয়ামী লীগের দলীয় সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান মৃত্যুর পর ‘উপনির্বাচন’ কে আওয়ামীলীগ ও বিএনপি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে। কারণ সে বছর জানুয়ারীতে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে রাজশাহী ও খুলনায় জয়লাভ করে বিএনপি। অপরদিকে ঢাকা ও চট্টগ্রমে জয় লাভ করে আওয়ামীলীগ। তাই দুই দলের রাজনীতির জনপ্রিয়তার মাপকাঠি হিসেবে মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচন জাতির নজর কাড়ে।
তাই আওয়ামীলীগ ও বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রচার-প্রচরণায় নির্বাচনী পরিবেশ ঘোলাটে হতে থাকে। মাগুরা-২ নির্বাচনী এলাকাটি সদর থানার চারটি ইউনিয়ন, শালিখা ও মোহাম্মদপুর থানা নিয়ে গঠিত। নির্বাচনে আওয়ামীলীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের প্রার্থী সহ ৪ জন ছিল মোহাম্মদপুর এলাকার এবং অপরদিকে বিএনপির প্রার্থী কাজী সলিমুল হক কামাল ছিল শালিখার অধিবাসী। তাছাড়া জাতীয় পাটি প্রার্থী নিতাই রায় (বর্তমানে বিএনপি নেতা) সংখ্যালঘু হওয়ায় আওয়ামীলীগের ভোট ব্যাংকে আঘাত হানে। ফলে বিএনপির প্রার্থী সলিমুল হক কামাল জেতার সম্ভাবনা তৈরি হয়। অতীতে এ আসন হতে আওয়ামীগ প্রার্থী জয়ী হওয়ায় আওয়ামী লীগও আশাবাদী ছিলেন।
বিএনপির প্রার্থীকে জেতাতে দলটির তৎকালীন কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল মান্নান ভুই।য়া সহ একাধিক মন্ত্রী, এমপি নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিলে আওয়ামীলীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা নিজেই প্রচারণায় অংশ নেন। শেখ হাসিনা এত বেপরোয়া ও বেসামাল হয়েছিলেন যে, ১৮ মার্চ অনুমতি ছাডাই সার্কিট হাউজের একটি কক্ষ দখলে নেন। অবশ্যই ১৯ মার্চ বেলা ১টায় তাকে সার্কিট হাউজ ত্যাগ করতে হয়েছিল।
২০ মার্চ ভোটের দিন সকালে নির্বাচন সুষ্ঠু হলেও দুপুরের পর নির্বাচনী উত্তেজনা বাড়াতে থাকে। সন্ধায় ভোট গ্রহণের ৩ ঘন্টা পর বিভিন্ন কেন্দ্রের ফলাফল আসতে থাকলে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয়ের আভাস পাওয়া যায়। শেখ হাসিনা আওয়ামীলীগ প্রার্থীর শহরের বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখান করেন। নির্বাচনে আওয়ামীলীগ যেসব কেন্দ্রে কারচুরির অভিযোগ আনেন, সেসব কেন্দ্রের সব ভোট আওয়ামীলীগ পেলেও বিজয়ের সম্ভবনা ছিল না।
আওয়ামীলীগ নির্বাচনে জালভোট প্রদানের অভিযোগ তোলে।মূলকারণ হলো পাঁচজন প্রার্থীর অবিরাম প্রচারণার ফলে এ নির্বাচনে ভোট গ্রহণের হার ৭২% ছিল। ১৯৯৪ সালে ফিলিস্তিনের হেবরনে ২৯ জন মুসলমানকে হত্যার নিন্দা প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে বিরোধীদল গুলো সংসদ বর্জন করে। আওয়ামীলীগ যুক্তি দেখায় যে, সরকার যদি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল আনে, তাহলে তারা সংসদে যোগদান করবে।
১৯৯৪ সালের ২৬ জুন পূর্ব নির্ধারিত আল্টিমেটামের দিন শেষ হওয়ার পর ২৭ জুন বিরোধী দল গুলো (আওয়ামীলীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত) নির্বাচনকালীন সরকারের রুপরেখা প্রকাশ করেন। আওয়ামীলীগের শেখ হাসিনা, জামায়াতের মতিউর রহমান নিজামী, জাতীয় পার্টির ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদ সহ বিরোধী দলের নেতারা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। পরে তারা জাতীয় সংসদে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্তাবধায়ক সরকারে উপর বিল উত্থাপন করেন।
২৮ অক্টোবর আওয়ামীলীগের পক্ষে দিনাজপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য আবদুর রহিম, জামায়াতের পক্ষে মতিউর রহমান নিজামী ও জাতীয় পাটির পক্ষে মনিরুল হক চৌধুরী সংসদে পৃথক ৩টি বিল উপস্থাপন করেন। সংকট নিরসনে কমনওয়েলথ মহাসচিব এমেকা আনিয়াত্তকু বাংলাদেশ বাংলাদেশ সফর করে সরকারী ও বিরোধী দলের সাথে কয়েক দফা আলোচনার ভিত্তিতে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেন। তিনি উভয় পক্ষেকে আলোচনার জন্য ৩ দফা পরিকল্পনা পেশ করেন যা প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা মেনে নেন।
৩ দফার ভিত্তিতে আলোচনার জন্য ১৯৯৪ সালে ১০ অক্টোবর কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গর্ভনর জেনারেল স্যার নিনিয়ান মার্টিন স্টিফেন সস্ত্রীক ঢাকায় আসেন। তিনি ছয় সপ্তাহ ধরে দুই দলের সাথে বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক আলোচনা করেন। তিনি উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে সাংবিধানিক কাঠামোর ভেতর থেকে একটি ফর্মুলা প্রস্তাব করেন। ফর্মুলাটি এ রকম, ‘নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১১ সদস্য বিশিষ্ট সর্বদলীয় মন্ত্রীসভা থাকবে’ যাতে প্রধানমন্ত্রী সহ সরকারী দলের ৫জন এবং বিরোধী দলগুলো থেকে ৫ জন মন্ত্রী থাকবে। এছাড়া উভয়ের সম্মতিতে একজন নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তি থাকবে যার হতে স্বরাষ্ট্র, সংস্থাপন ও তথ্য মন্ত্রণালয় গুলোর ভার থাকবে।”
প্রধান বিরোধী দল আওয়ামীলীগ এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে স্যার নিনিয়ানের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আনেন। আওয়ামীলীগ পক্ষে শাহ এ.এম.এস কিবরিয়া কমনওয়েলথ মহাসচিব এমকো আনিয়াওকুর কাছে লিখিত অভিযোগ ফ্যাক্স এর মাধ্যমে পাঠান। কমনওয়েলথ মহাসচিব পাকিস্তানে সফলকালে সংবাদ সম্মেলন এ বক্তব্য প্রত্যাখান করেন। অবশেষে ব্যর্থ হয়ে ১৪ নভেম্বর স্যার নিনিয়ান স্টিফেন দেশে ফিরে যান। যাওয়ার প্রক্কালে তিনি বলেন, “সহিংসতা ও হাঙ্গামার মাধ্যমে কিছুই অর্জিত হবে না। সহিংসতা ও হাঙ্গামা শুধু ক্ষোভ আর হতশার পথেই দেশেকে নিয়ে যাবে। ”
এর পরেও তৎকালীন আওয়ামীলীগের নেত্রী শেখ হাসিনাকে বিষয়টি সমাধানের জন্য প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কয়েক দফা চিঠি পাঠান। এমনকি এক পর্যায়ে ২৬ নভেম্বর বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সেখানে না থাকায় কল রিসিভ করেন নি। ফিরতি কলে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা কে আলোচনায় বসে সংকট সমাধানের আশ্বাস দেন। কিন্তু শেখ হাসিনা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করেন।
এক পর্য়ায়ে ১৯৯৪ সালে ২৮ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ,জামায়াত ও জাতীয় পার্টির ১৪৭ জন সংসদ সদস্য একযোগে সংসদ হতে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের সাথে হরতালের কর্মসূচীও শুরু হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামীলীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত ১৭৩ দিন হরতাল অবরোধ পালন করেন। এতে ৬৪ জন নিহত এবং কয়েক শতাধিক আহত হয়।
আন্দোলনে আওয়ামীলীগ নেতা তোফায়েল আহমদ সহ কয়েকজন নেতা আটক হলে গুলশান-বারিধারার বিদেশী কুটনৈতিকরা সরকারকে বিল পাসের জন্য আহবান জানান। কিন্তু সংসদে সরকারী দলের ২০০ এমপি না থাকায় এবং বিরোধী দল পদত্যাগ করায় সংসদে বিল আনা সম্ভব হয় নি। অবশেষে সব দাবি উপেক্ষা করে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং নতুন আইন পাশের জন্য এই নির্বাচন অনিবার্য ছিল।
১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ৪৭ সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রীপরিষদ শপথ গ্রহণ করে। সংসদের ১ম অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস বলেন, “সংবিধানে একটি উর্পযুক্ত সংশোধনী আনা হবে যাতে আগামী সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়।” রাষ্ট্রপতি যখন সংসদে এ ঘোষণা দেন, তখনও বিরোধী দল গুলোর আন্দোলনের কারণে সংসদের আশেপাশের এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা এবং বিএনপি সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ২৩ মার্চ আওয়ামীলীগ প্রেসক্লাবের সামনে ঢাকার সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা হানিফের নেতৃত্বে ‘জনতার মঞ্চ ’ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
অপরদিকে বিএনপির নেতৃত্বে ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ হতে খালেদা জিয়া বলেন “১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।”অবশেষে ২৫ মার্চ রাতভর আলোচনা শেষে ভোররাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস হয় এবং ত্রয়োদশ সংশোধনী গৃহীত হয়। ২৬ মার্চ সকাল ৬ টায় সংসদে বিল পাসের পর সংক্ষিপ্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, “আমি প্রতিশ্রুতি পালন করলাম।”
২৮ মার্চ রাষ্ট্রপতি বিলে সম্মতি প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী ২৯ মার্চ রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করে সংসদ ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতিকে আহবান জানান। তত্ত্বাবধায় সরকার ইস্যুতে গণভোট নেওয়া হবে কিনা সে বিষয়ে আলোচনা চলছিল। ৩০ মার্চ সরকারী আমলা মহিউদ্দীন খান আলমগীর সহ কিছু সরকারী কর্মকতা নিয়ম লংঘন করে সেখানে যোগ দেন। ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে গণভোট নেওয়া সম্ভব হয়নি।
৩০ মার্চ সন্ধ্যায় সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর অধীনে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে হাবিবুর রহমান প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বৈধতা নিয়ে আদালতে রিটঃ
১৯৯৬ সালে সৈয়দ মসিউর রহমান নামে এক আইনজীবী ১৩ তম সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে রিট করলে বিচারপতি মোজাম্মেল হক ও এম এ মতিনের একটি বেঞ্চ রিটটি খারিজ করে দেন।
যেসব আওয়ামীলীগপন্থী আইনজীবী ১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে আন্দোলন করেছিলেন, তারাই আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর কাঙ্খিত সুবিধা না পেয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বৈধতা নিয়ে ১৯৯৯ সালের অক্টোবর মাসে হাইকোর্টে রিট করেন।তাদের মধ্যে আইনজীবী এম সলিমুল্লাহ, রুহুল কুদ্দুস বাবু এবং মো: আবদুল মান্নান।
২০০৩ সালের ২১ জুলাই বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান ও বিচারপতি আব্দুল আউয়াল এ বিষয়ে বৃহত্তর বেঞ্চ গঠনের জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করেন। ২০০৪ সালের ১ জুন বিচারপতি জয়নুল আবেদীন,আওলাদ আলী ও মির্জা হোসাইন হায়দারের নেতৃত্ব একটি বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করা হয়।
পূর্ণাঙ্গ ও চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট হাইকোর্টের তিন বিচারপতির বিশেষ ও বৃহত্তর বেঞ্চ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বৈধ ঘোষণা করে বলেন, ‘১৯৯৬ সালের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানসম্মত’ [৫৭ ডিএলআর (২০০৫)]।
তাদের মধ্যে এম. সলিমুল্লাহ ২০০৫ সালে মারা যান। রুহুল কুদ্দুস বাবু নানাভাবে বির্তকিত হয়েও অনেকটা দলীয় ক্ষমতার জোরে ২০১০ সালে হাই কোর্টে বিচারপতি হন।
একমাত্র রিটকারী হিসেবে আছেন এম. আবদুল মান্নান। আপিল বিভাগে টানা ৭ বছর পেন্ডিং থাকার পর ৩ বার বাদী পরিবর্তন করে ২০১১ সালের ১লা মার্চ শুনানি শুরু হয়ে শেষ হয় ৬ এপ্রিল।
আদালত ব্যারিস্টার রফিকুল হক সহ ৮জন অ্যামিকাস কিউরির(আদালতের বন্ধু) মতামত নেন। তাদের মধ্যে ৫জন সরাসরি পক্ষে, ১ জন বিপক্ষে এবং ২জন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নতুন ফর্মূলার পক্ষে মতামত দেন।
আপীল বিভাগের ৬ জন বিচারপতির মধ্যে ৩ জন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মত দেন।কিন্তু প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিপক্ষে মতামত দিয়ে বিচারকদের সংখ্যা গরিষ্ঠতার বিচারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ বলে রায় দেন।
নানা কারণে এ রায়টি বিতর্কিত।কারণ গুলো হলো:
ক) বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে প্রধান বিচারপতি করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির সংখ্যা ৭ থেকে বাড়িয়ে ১১ জন করা হয়।২ জন যোগ্য ও দক্ষ বিচারপতিকে ডিঙ্গিয়ে তাকে আওয়ামী লীগ সরকার স্বার্থ হাসিলের জন্য প্রধান বিচারপতি করেছিল। তার এ অবৈধ পদোন্নতি মেনে নিতে না পেরে একজন সিনিয়র বিচারপতি তাকে অবমূল্যায়ন ও অপমানের অভিযোগ এনে রাগে,ক্ষোভে ও অভিমানে পদত্যাগ করেছিলেন।
কাজেই জনগণের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে,সরকার তার সুবিধা মত রায় পাওয়ার জন্য তাদের আজ্ঞাবহ এ বিচারপতি কে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রধান বিচারপতি করেছিলেন।
(খ)প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর এবিএম খায়রুল হক
চিকিৎসা ভাতার নাম দিয়ে ২০০৯ সালের ২৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর তহবিল হতে ১০ লক্ষ ৩৭ হাজার ২৫০ টাকা এবং পরদিন ৯ লক্ষ টাকা উত্তোলন করেছিলেন।এটা অনৈতিক সুবিধা। বিস্তারিত দেখুন দৈনিক আমার দেশ (৩০ মে, ২০১১)।
(গ)বাংলাদেশের বিচারবিভাগের ইতিহাসে এবিএম খায়রুল হক একজন চরম দলবাজ বিচারপতি হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন।২০০৫ সালে মুন সিনেমা হলের মালিকানা সংক্রান্ত একটি মামলার রায়ে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে।
২০০৮ সালের ৩০ জুলাই স্থানীয় নির্বাচন সংক্রান্ত একটি মামলায় পুরো সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে আওয়ামীলীগকে সুবিধা দেওয়ার জন্য স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় পরিচয়ে অংশগ্রহণ বৈধ বলে রায় দিয়েছিলেন যা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক।তার এ রায়ের ফলে ২০০৮ সালের ৪ আগষ্ট ৪টি সিটি কর্পোরেশন ও ৯টি পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে প্রচারণা চালিয়েছিলেন।৪টি সিটি কর্পোরেশন ও ৮টি পৌরসভাতে ই আওয়ামীলীগের প্রার্থীরা বিজয়ী হন।
খালেদা জিয়ার বাড়ি সংত্রান্ত মামলার বিচারে এবিএম খায়রুল হক নিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে জিয়াউর রহমানকে বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে বিতর্কিত রায় দেন।
নিম্ন আদালতের বিচারে হস্তক্ষেপসহ আনা কারণে তিনি ছিলেন বিতর্কিত ।
ঘ) সংবিধান পরিবর্তন করতে হলে আগে সংসদে সংশোধনী আনতে হবে।কিন্তু ত্রয়োদশ সংশোধনী ও রায় প্রকাশের আগেই সংবিধান পুনর্মুদ্রিত করে সরকার।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আদালতে অবৈধ ও বেআইনী বলে রায় প্রদান করার ৩ মাস আগেই সরকার সংবিধান থেকে এ ব্যবস্থা বাতিল করে দেন।
সংবিধান পুন:মুদ্রনের জন্য পাঠানো হয় ১০ ফেব্রুয়ারি,২০১১।আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ ও বেআইনী বলে রায় দেন ১০ মে,২০১১।রায় প্রদানের ৩ মাস আগেই সংবিধান থেকে সংশোধনী ছাড়াই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়টি বাতিল করায় আদালতের সাথে সরকারের গোপন আঁতাতের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।
আবার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার আগেই সরকার সংবিধানে সংশোধনী আনেন।
আবার এ আদেশের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় ১৬ সেপ্টেম্বর ,২০১২। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে আওয়ামী লীগ সরকার জোরপূর্বক ৩০ জুন ,২০১১ সালে সংসদে সংক্ষিপ্ত রায়ের ওপর ভিত্তি করে একদলীয় কায়দায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করে। রায় প্রদানের আগে সংবিধান পুনঃমুদ্রন ও পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে সংবিধান সংশোধনের ফলে সরকার সাথে আদালতের যোগসাজের ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে গেছে।
(ঙ)মূলত সরকারের অসৎ উদ্দেশ্য বৈধ করার জন্য আপিল বিভাগে টানা ৭ বছর পেন্ডিং থাকার পর ৩ বার মামলার বাদী পরিবর্তন করে ২০১১ সালের ১লা মার্চ লিভ টু আপিলের শুনানির জন্য আদালত সিনিয়র ৮ জন আইনজীবীকে অ্যামিকাসকিউরি নিয়োগ দেন ।
তাদের মধ্যে একজন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দেওয়ার কথা বললেও বাকি ৭ জন তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে মত দেন।এদের মধ্যে ২ জন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংস্কারের পক্ষে মত দেন।আদালত সব কিছুকে অগ্রাহ্য করে বিচারপতিদের মধ্যেও ৩ জন তত্তাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে মত দেওয়া সত্ত্বেও সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির অজুহাত দেখিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে রায় দেন।
(চ) ২০০৯ সালে আ’লীগ ক্ষমতায় বসার পর হতে প্রথমে সংসদের অধিবেশন থেকেই আ,লীগ তাদের দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি
বাতিল করা হবে বলে মাঠে ময়দানে সাজেদা চৌধুরী, নাসিম, হানিফ, ডা: দীপু মনি,আইনমন্ত্রী ব্যারিষ্টার শফিক আহমদ,প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ঘোষণা দিয়েছেন, আদালতের রায়ে তার প্রতিফলন ঘটেছে।
২০১১ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ২৫৪ টি পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগে দূর্গে বিএনপির প্রার্থী বিজয়ী হবার পর সরকার তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায় আওয়ামী লীগ।
এদিকে খালেদা জিয়ার মামলায় বির্তকিত রায়ের পর বিএনপি স্পষ্ট ভাষায় বলে দেন “প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হলে বিএনপি তাকে মেনে নেবে না।”
মূলত খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হলে বিএনপি তাকে মেনে নেবে না এটি জানার পর তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার জন্য আদা জল খেয়ে নামেন।সাংবাদিকরা এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি নিশ্চুপ থাকেন ।
(ঞ)তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে যে ৪ জন বিচারপতি রায় দিয়েছেন, তাদের প্রত্যকের ই পদোন্নতি হয়েছে। প্রত্যেকেই প্রধান বিচারপতি হয়েছেন।
জ) অবসরের পর আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ গ্রহণ :
অবসরের পর বিচার বিভাগের বিচারপতিরা কোন লাভজনক পদ গ্রহণ করার সুযোগ থাকলে বিচার বিভাগে দূর্নীতি হওয়ার বিষয়টি তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায়ে উল্লেখ করেছিলেন।অথচ অবসরের পর আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদে এবিএম খায়রুল হকের এ যোগদান তার রায়ের স্ববিরোধী।আওয়ামীলীগ সরকার তাকে এ পদে বসানোর জন্য দেড় বছর ধরে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদটি চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক অধ্যাপক ডক্টর শাহ আলমকে ভারপ্রাপ্ত দিয়ে রেখেছিলেন।
ত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে ছিলেন সবাইঃ যে আওয়ামীলীগ ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছে, তারাই ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ের জন্য রাজপথে আন্দোলন,হরতাল,অবরোধ,অগ্নিসংযোগ করে এদেশের জনগনের কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট করেছিলেন।
সংবিধান সংশোধন করার লক্ষে সরকার ২০১০ সালের ২১ জুলাই সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে চেয়ারপার্সন ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কে কো চেয়ারপার্সন করে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি সংসদীয় কমিটি গঠন করেছিল।এ কমিটি ১০ জন সংবিধান বিশেষজ্ঞ,৩ জন সাবেক প্রধান বিচারপতি,১৮ জন বিশিষ্ট নাগরিক , ১৮ জন পত্রিকার সম্পাদক এবং কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করেছিলেন।সংসদীয় কমিটি তাদের কথা শুনলেও আমলে নেয়নি।এমনকি আওয়ামীলীগের নেতা তোফায়েল,সুরঞ্জিত ,সৈয়দ আশরাফ,মতিয়া চৌধুরী,স্পীকার শিরিন শারমিন চৌধুরী,আমির হোসেন আমু,রাশেদ খান মেনন,হাসানুল হক ইনু সহ সেদিন
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে ছিলেন।কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৮মে হঠাৎ করে সুইজারল্যাণ্ড,ফ্রান্স এবং কানাডায় দীর্ঘ ১২ দিন ঘুরে এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যান। ৩০ মে সংসদীয় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে অবস্থান নিলে সংসদীয় কমিটি বেকায়দায় পড়েন।৩১ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেন আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নয়,ইভিএম পদ্ধতিতে নির্বাচন কমিশনের অধীনে হবে।প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা হবে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনকে আরও দুর্বল করা হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে অধিকাংশ দলের স্পষ্ট অবস্থান,তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল হওয়ার পরেও আগামী দুইটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সরকারের অধীনে করার জন্য প্রধান বিচারপতির অভিমত, রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও দেশবাসীর মতামতকে অগ্রাহ্য করে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে, সংক্ষিপ্ত আদেশের ওপর ভিত্তি করে ক্ষমতার জোরে বাজেট অধিবেশনে মাত্র ৪টি মিনিটের আলোচনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা আওয়ামী লীগের বির্তকিত ও একগুয়েমি মনোভাবের পরিচয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নিয়ে জটিলতা :
সংবিধান অনুযায়ী সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে জুনের শেষের দিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান কে এম হাসান। তখন অভিযোগ উঠেছিল, বিএনপি সরকারের পছন্দের কারণেই জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে কে এম হাসানকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর মূল উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন প্রধান বিচারপতি কে এম হাসান অবসরের পরপরই যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারেন।
আওয়ামী লীগের সহিংস আন্দোলনের মুখে বিচারপতি কে এম হাসান ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরের শেষের দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। সংবিধান অনুযায়ী সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব না নিলে তার আগের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে আমন্ত্রণ জানানোর কথা। এভাবে চারটি বিকল্প ছিল সংবিধানে। কেউ দায়িত্ব নিতে না চাইলে সর্বশেষ উপায় হিসেবে রাষ্ট্রপতির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার কথা। কিন্তু সংবিধানের সব বিকল্প না দেখে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন।
রাষ্ট্রপতি বিএনপির মনোনীত হলেও তিনি যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নেন, তখন আওয়ামী লীগ সরাসরি আপত্তি করেনি। তবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে থাকে। আওয়ামী লীগ অভিযোগ তোলে, তিনি বিএনপির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছেন। এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে উপদেষ্টা পরিষদ থেকে চারজন সদস্য পদত্যাগ করেন। শুরু হয় আরেক সংকট।
আওয়ামী লীগ এবং অন্য বিরোধী দলগুলোর তীব্র আপত্তির মুখেও ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। রাজনৈতিক সংকট চরম আকার ধারণ করলে ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভেঙে দেয়। সেনাবাহিনীর সমর্থনে গঠিত হয় নতুন আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তিন মাসের বদলে সেই সরকার প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় থাকার পর ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচন দেয়। এর পর আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে তিনটি ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই তিন নির্বাচনই ছিল বিতর্কিত।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনগণের অভিপ্রায়:
আমাদের সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- “জনগনের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্য পূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।
এই উপ-অনুচ্ছেদের ২ টি অংশ।
প্রথম অংশ :”জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন।”
এই প্রথম অংশের ব্যাখ্যার হচ্ছে এই জনগনের ইচ্ছার প্রতিফলন,দাবি,চাহিদা,আশাপূরণের জন্য জনগণের পক্ষে সংসদ সদস্যগণ এই সংবিধান রচনা করবে।এই সংবিধান হচ্ছে দেশ ও জনগনের নিরাপত্তা বিধানের সর্বোচ্চ আইন।
বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি জনগণের অভিপ্রায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের সংবিধানে এ পর্যন্ত যতসব সংশোধনী বিল আনা হয়েছে, অধিকাংশই জনগনের ইচ্ছা পূরণে নয়। বরং শাসকদলের ইচ্ছা পূরণে ।
প্রধান বিচারপতির বয়স বাড়িয়ে নিজেদের পছন্দনীয় ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা করার জন্য সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী এনেছিল বিএনপি। সর্বশেষ আওয়ামীলীগ আরো এক ধাপ এগিয়ে নিজেদের অধীনে নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতায় থাকার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে পঞ্চদশ সংশোধনী আনে আওয়ামী লীগ।
৭ (২) উপ-অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় অংশের বক্তব্যটি হচ্ছে- “অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্য পূর্ণ ততখানি বাতিল হইবে।”
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক সহ যে ৪ জন বিচারপতি রায় দিয়েছেন, তারা তত্ত্বাবধায়ক
সরকার ব্যবস্থার কোন অংশটি সংবিধানের সাথে কতটুকু সাংঘর্ষিক তা যথাযথভাবে বিভিন্ন আইনের ধারা এবং সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদের আলোকে বাতিলের পক্ষে যুক্তি দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
এবার সংবিধানের আলোকে পরীক্ষা করি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংবিধানের সাথে কতটুকু সাংঘর্ষিক!
সংবিধানের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে লেখা আছে-“— প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।”
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টারা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি নয়। তাই সংবিধানের সাথে অবশ্যই সাংঘর্ষিক।
তাই জাতীয় সংসদ যেভাবে স্পিকার, রাষ্ট্রপতি এবং মহিলা সংসদ সদস্য নির্বাচিত করে, সেই ভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের কে নির্বাচিত করলে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হবে না।
সে ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের নিয়োগ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য স্পিকারের নেতৃত্বে একটি সর্বদলীয় পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠন করা যেতে পারে। জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত হলেও স্পিকারের মত তাদের পদ বহাল থাকবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় বিচারপতিদের সম্পৃক্তের ফলে বিচার বিভাগে দলীয়করণ হয়েছে বিষয়টি আংশিক সত্য।
বাস্তব সত্য হচ্ছে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছিল না, তখনও বিচার বিভাগে দলীয়করণ হয়েছে।কারণ যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সে দল নিজেদের অনুগত লোকদেরকেই বিচার বিভাগে নিয়োগ করে থাকেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দিলে যে বিচার বিভাগে দলীয়করণ হবে না তার কোন গ্যারান্টি আছে?
আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় বিচারপতিদের থাকার বিষয়টি নির্দিষ্ট। তাই নতুন ব্যবস্থায় বিচারপতিরা থাকতেও পারেন, নাও থাকতে পারে। কাদের নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে, তা নির্ধারণ করবে সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটি।
রাষ্ট্রের মীমাংসিত বিষয়ে উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপ না করাই ভালো। তারা শুধুমাত্র ব্যাখ্যা দিতে পারবে। যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির রায় নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি! রাজপথে বহু মায়ের বুক খালি হয়েছে। বহু রাজনৈতিক নেতাকর্মী গুম, খুন এবং হত্যার স্বীকার হয়েছে।
সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৫ জুন কোটা সংস্কার মামলার রায় নিয়ে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে, সে আন্দোলনে বহুৎ তাজা প্রাণ ধরে গেছে।
তাই আদালতের উচিত অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়া। জনগণের মনের ভাষা আদালতের বোঝা উচিত।
আওয়ামী লীগ জনগণের মনের ভাষা বোঝে নি।তাই তাদের পরিণতিও শুভ হয়নি!
ইতিমধ্যেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির রিভিউ নিয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করেছেন সুজনের বদিউল আলম মজুমদার সহ পাঁচজন বিশিষ্ট নাগরিক, বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী। আগামীকাল এই মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
এমতাবস্থায় পুরনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সরাসরি বাতিল কিংবা হুবহু পুনর্বহাল নয়,যৌক্তিক সংস্কার চাই।
লেখক : গণমাধ্যম কর্মী এবং নির্বাচন বিশ্লেষক।
কিউএনবি/আয়শা/২৩ অক্টোবর ২০২৪,/রাত ১০:৪৪