প্রশ্নফাঁসঃ রাজনৈতিক মেরুকরণ ও শিক্ষাব্যবস্থার সংকট
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সাম্প্রতিক এক জ্বলন্ত ইস্যু হলো প্রশ্নফাঁস। এটি কেবল শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছে না, বরং পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। বিগত সরকারের আমলে একের পর এক প্রশ্নফাঁসের ঘটনা জাতির সামনে এসেছিল। ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় রাজনৈতিক মেরুকরণের হাতিয়ার হিসেবে এই ঘৃন্য পথটা বেছে নিয়েছিলো তারা।
যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন ও অপদস্থ হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থার আস্থার জায়গাটি ক্রমেই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পথ তৈরী করেছিল। বিভিন্ন রিপোর্টে দেখা গেছে, অসাধু চক্রগুলো প্রতিনিয়ত প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থাকে দুর্বল করতে এবং শিক্ষকদদের ক্রমশ মানহানী করতে একটা ইঞ্জেক্ট হিসেবে কাজ করেছে।
প্রতিটি ঘটনার পেছনেই রয়েছে কিছু শক্তিশালী অসাধু চক্র। তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করে নিজ নিজ রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করতে এরা সদা সচেষ্ট। সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে আমি কিছু উপাত্ত তুলে ধরছি।
উদাহরণ ১: মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস (২০১৭)
৬৫ কোটি টাকার বিনিময়ে মেডিকেল প্রশ্নফাঁসের চেষ্টা করা হয়েছিল। ২০১৭ সালে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক তৈরি হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশ্বাস সত্ত্বেও, পরীক্ষার কয়েক ঘণ্টা আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে পড়ে। এটি শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার করে এবং বড় আকারের বিক্ষোভের সূত্রপাত করে। তদন্তে উঠে আসে যে, রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এই প্রশ্নফাঁসের পেছনে কাজ করেছে।
উদাহরণ ২: এসএসসি ও এইচএসসি প্রশ্নফাঁস (২০১৮)
২০১৮ সালে মাধ্যমিক (এসএসসি) এবং উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিশেষত ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাচ্ছিল। শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি আস্থা ক্ষুণ্ণ হয়ে পড়ে, কারণ পরীক্ষার পূর্বেই প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে যায়। তদন্তে দেখা যায়, রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত অসাধু চক্রগুলো এই ধরনের প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করছিল, যা কয়েকটি কোচিং সেন্টার ও প্রেসের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল।
উদাহরণ ৩: বিপিএসসি প্রশ্নফাঁস (২০২১)
২০২১ সালে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (বিপিএসসি) পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর একটি। এই পরীক্ষাটি খুবই প্রতিযোগিতামূলক এবং সরকারী চাকরির ক্ষেত্রে প্রবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। পরীক্ষার আগের রাতে বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়, যা ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দেয়। রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত গ্রুপগুলো এই ধরনের অপকর্মের পেছনে সক্রিয় ছিল এবং এই ঘটনা শিক্ষাব্যবস্থার গভীরে থাকা সমস্যাগুলোকে প্রকাশ্যে এনেছিল। এরকম আরো অনেক বিচ্ছিন্ন ঘটনা সাক্ষী হয়েছি আমরা।
প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে মেধার মানদণ্ডকে দুর্বল করা হচ্ছে এবং শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা কমিয়ে ফেলা হচ্ছে দিন কে দিন। শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে শিক্ষকদের যে মর্যাদা থাকা উচিত, তা ক্রমশই কমে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক চক্রের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে শিক্ষকরা নিজেদের ভূমিকা রাখতে পারছেন না এবং কিছুক্ষেত্রে তাদের একপ্রকার নীরব দর্শক হয়ে থাকতে হচ্ছে।
এছাড়া শিক্ষকদের ওপর দায় চাপিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের আড়ালে রাখার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তাঁদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে অপদস্থ করা হয়, যেন আসল দোষীদের নজর থেকে আড়াল করা যায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় কোনো সরাসরি ভূমিকা থাকে না। তাঁদের দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে জ্ঞান দেওয়া, কিন্তু রাজনৈতিক স্বার্থে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া হয়। এর ফলে শিক্ষকদের মানসিকভাবে দুর্বল করা হয় যেনো শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
এটি একটি ভয়াবহ পয়জন যা দ্বারা আমরা জম্বির মতো নিয়ন্ত্রিত হই কিন্তু নিজেরাও উপলব্ধি করতে পারি না। একাধিক রিপোর্টে দেখা গেছে, শিক্ষকদের সরাসরি এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত না থাকা সত্ত্বেও তাঁদের ওপর চাপানো হয়েছে এসব অপকর্মের দায়। কথায় কথায় নিজের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের পদত্যাগের দাবী আর নানাবিধ প্রোপাগান্ডা ছড়ানো যেনো বাংলা সিনেমার ডায়লগের মতো, “বের হয়ে যা আমার সামনে থেকে ” উক্তির আরেক রুপ।এমন কি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রশ্নফাঁসের ঘটনা কে কেন্দ্র করে শিক্ষকদের মতামত উপেক্ষা করা হচ্ছে এবং তাঁদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এর ফলে শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে এবং তাঁরা শিক্ষাদানে আগ্রহও হারাচ্ছেন।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এমনিতেই নানাবিধ সংকটে নিমজ্জিত। এর মধ্যে প্রশ্নফাঁস একটি প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। তবে আশার বিষয় হলো, সম্প্রতি টাইমস হায়ার এডুকেশন রাঙ্কিং এ উঠে এসেছে দেশের সেরা পাঁচ ইউনিভার্সিটির নাম। র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের ৮০১ থেকে ১০০০–এর মধ্যে আছে দেশের ৫ বিশ্ববিদ্যালয়। এবারের তালিকায় দেশসেরা হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর ৮০১ থেকে ১০০০–এর মধ্যে আছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি।
মানসম্মত পারফরম্যান্স, শিক্ষার মান, শিক্ষায় গবেষণার পরিবেশ, গবেষণায় শ্রেষ্ঠত্বের অবস্থান, ইন্ডাস্ট্রিতে সংযুক্তি এবং আন্তর্জাতিক সম্ভাবনার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র বিবেচনা করেই টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাঙ্কিং করে থাকে। বিশ্বের অন্যতম র্যাঙ্কিংয়ে ২০২৫ সালের সংস্করণে ১১৫টি দেশ ও অঞ্চলের ২০০০টিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয়কে মূল্যায়ন করেই তালিকা করা হয়েছে।
এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকেরা মেধাবী শিক্ষার্থী তৈরি এবং সুষ্ঠু পরীক্ষা পদ্ধতি বজায় রাখতে যে নিষ্ঠা এবং সততা প্রদর্শন করেছেন, তা শিক্ষাব্যবস্থার জন্য একটি আদর্শ দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা প্রায়ই পেরিফেরিতে অবস্থিত থাকায় নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে প্রশাসনিক কাজ এবং গবেষণা পরিচালনা করে থাকেন। তবুও তারা শিক্ষার মান বজায় রাখতে, সঠিক মূল্যায়ন করতে এবং শিক্ষার্থীদের প্রকৃত জ্ঞান প্রদান করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রশ্নফাঁসের মতো গুরুতর অপরাধ থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দূরে থাকতে সক্ষম হয়েছে মূলত সেখানকার শিক্ষকদের দৃঢ় নৈতিকতা, কঠোর নিয়মাবলী ও স্বচ্ছতার জন্য।
তবে এই সফলতা অর্জন করা সহজ ছিল না। পেরিফেরি অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ার কারণে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাব এবং নানা ধরনের প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলেও, এসব শিক্ষকেরা তাদের নিষ্ঠা ও একাগ্রতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রশ্নফাঁসের মতো কলঙ্ক থেকে দূরে রেখেছেন। তাদের এই নিরলস প্রচেষ্টা ও সততা দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য একটি আদর্শ হতে পারে, যেখানে রাজনৈতিক চক্রের প্রভাবমুক্ত থেকে শিক্ষাব্যবস্থার মান উন্নয়ন করা সম্ভব। তবে প্রশ্নফাঁসের এই ধরনের কিছু ধারাবাহিক ঘটনা শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি আস্থা হ্রাস করছে এবং শিক্ষকদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
শিক্ষাব্যবস্থাকে রক্ষা করার জন্য শিক্ষকদের মর্যাদা ও মান বজায় রাখতে হবে এবং প্রশ্নফাঁসের মতো অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে জাতি কে কলঙ্কমুক্ত করা সময়ের দাবী। প্রজন্মের অধিকার।
লেখিকাঃ ফায়াজুন্নেসা চৌধুরী, শিক্ষক, পিএইচডি রিসার্চার, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি নিয়মিত লেখালেখি করেন। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় তার লেখা বিশেষ আবেদন সৃষ্টি করে আসছে।
কিউএনবি/বিপুল/১১.১০.২০২৪/রাত ১১.৩০