শান্তা ইসলাম,নেত্রকোনা প্রতিনিধি : নেত্রকোনার পূর্বধলায় উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রতারণার ছক কষে অবৈধ প্রভাবে সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ গ্রহণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে গত মঙ্গলবার বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ওই প্রধান শিক্ষকের অপসারণ ও বিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য পূর্বধলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি বরাবরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।অভিযোগে জানা গেছে, ২০১৮ সনের জুলাই মাসে রাজনৈতিক প্রভাবে অবৈধভাবে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ গ্রহণ করেন সুদীপ চন্দ্র সরকার। তাঁর অপসারণের দাবিতে বিদ্যালয়ের শিক্ষক- কর্মচারীর ও শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে চলেছে। গতকাল শনিবার বিষয়টি নেত্রকোনায় সাংবাদিকদের জানান শিক্ষকরা।
প্রধান শিক্ষক সুদীপ চন্দ্র সরকারের অপসারণের দাবিতে গত ২৭ আগষ্ট থেকে শুরু করে গত ২ সেপ্টেম্বর টানা ৫ দিন শিক্ষক-শিক্ষিকা ও কর্মচারীগণ কর্মবিরতি এবং ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস বর্জন করেছে। প্রধান শিক্ষকের স্ত্রী জুনিয়র হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষিকাকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে নিয়োগ বোর্ড গঠন, নিয়োগ বোর্ডে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করে তার স্বামীকে ছক কষে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করার অভিযোগ তুলে এই কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। এতে তৎকালীন ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি উপজেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক মাসুদ আলম টিপু ও তৎকালীন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার শফিকুল বারী এবং স্থানীয় এমপি ওয়াসোত হোসেন বেলালের ছত্রছায়ায় বিপুল পরিমাণ উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে ছক কষে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ছকের বাইরে অন্য কোন প্রার্থীকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না দেওয়া, পরীক্ষার তারিখ গোপন করে ডিজির প্রতিনিধি ছাড়াই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগকারীরা বলেছেন, যা বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালার নিয়মবহির্ভূত।অবৈধ প্রভাবে নিয়োগ গ্রহণ করা প্রধান শিক্ষক সুদীপ চন্দ্র সরকারের স্ত্রী জাল (বি.এ পাস) সনদপত্র প্রদর্শন করে ১৯৯৭ সনের ১৮ মার্চ সহকারি শিক্ষক (হিন্দু ধর্ম) পদে নিয়োগ গ্রহণ করেন। শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের ১৯৯৫ সনের ২৪ অক্টোবর মাসে জনবল অবকাঠামোর পরিপত্র অনুযায়ী এইচএসসি পাশ কোন সহকারি শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যাবে না। সি এ ফার্ম কর্তৃক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অডিট তথ্যাবলী অডিটে ১৯৯৭/১৯৯৮ সনে সহকারি শিক্ষকের (হিন্দু ধর্ম) নাম তালিকাভুক্তি নেই। পরবর্তীতে ২০০১ সনের অক্টোবর মাসে সহকারী শিক্ষক (হিন্দু ধর্ম) হিসেবে এমপিওভুক্ত হয়। যার স্কেল ও পে- কোড-১১। বি.এ পাসের বিল- বেতন উত্তোলন করছেন। অথচ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সহকারী শিক্ষক (হিন্দু ধর্ম) ২০০৪ সনে বিএসএস পাস করেন। মাসিক বিল বিবরণীতে যোগদানের তারিখ ১৯৯৭ সনের ১৮ মার্চ।
পূর্বধলা উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রায় এক একর জমির উপর ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমে পূর্বধলা নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরবর্তীতে উচ্চ বিদ্যালয়টি (সাধারণ ও কারিগরি) ২০১৯ সালে এমপিওভুক্ত করা হয়। এ বিদ্যালয়টি স্থাপনের জন্য জমি দান করার পর ম্যানেজিং কমিটি গঠন করে প্রভাব খাটিয়ে পর্যায়ক্রমে একই পরিবারের চারটি পদে নিয়োগ নিয়েছেন প্রধান শিক্ষক সুদীপ চন্দ্র সরকার। তিনি একা নন বিদ্যালয়ের সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রভাব ও ভয় দেখিয়ে একই বিদ্যালয়ে চাকরি দিয়েছেন নিজের স্ত্রী জোৎস্না রানী বীরকে সহকারী শিক্ষক (হিন্দু ধর্ম) পদে ও ভাগ্নি স্মৃতি রানী দত্তকে সহকারী শিক্ষক (সমাজবিজ্ঞান) এবং ভাই নৈশ্য প্রহরী পদে বর্তমানে স্বর্গীয় দিলিপ চন্দ্র সরকারকে। এমন অভিযোগ তুলে ধরে তদন্ত দাবি করেন অত্র বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা কর্মচারী, বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী বৃন্দ এবং স্থানীয় গ্রামবাসী ও বিদ্যালয়ের সাবেক একাধিক বঞ্চিত শিক্ষক ও শিক্ষকের চাকরি প্রত্যাশি একাধিক যুবক। জাল সনদে নিয়োগ গ্রহণের অভিযোগে তৎকালীন জেলা শিক্ষা অফিসার (ডিও) অডিটের সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে ট্রেজারি চালানে প্রায় ৬৫ হাজার টাকা ফেরত দেন সহকারী শিক্ষক হিন্দু ধর্মীয় জোৎস্না রানী বীর।
এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্তের দাবি করে প্রধান শিক্ষকের অপসারণের দাবি জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও অত্র বিদ্যালয়ের সভাপতি ও জেলা শিক্ষা অফিস বিভাগীয় শিক্ষা বোর্ড এবং শিক্ষা উপদেষ্টা বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন পূর্বধলা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দ। এ বিষয়টি বিভাগীয় তদন্ত চান সচেতন এলাকাবাসী। এদিকে জনশ্রুতি রয়েছে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ গ্রহণের পর এলাকায় বিভিন্নজনের কাছ থেকে পিওন, আয়া, গেইটম্যান ও শিক্ষকতার চাকরির প্রোলোভন দেখিয়ে প্রায় ৩৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন সুদীপ চন্দ্র সরকার।
এলাকার চাকরি প্রত্যাশী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি বলেন, ২০১৮ সালে সুদীপ চন্দ্র সরকার প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর ২০১৫ সালে পূর্বে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদানের জন্য নিয়োগ প্রদান করার প্রস্তাব দেন এবং ২০১৯ সালে আমার কাছ থেকে আড়াই লাখ টাকা নেন। তারপরেও চাকরি দেননি। এখন টাকা ফেরত দিতে গড়িমসি করে টাকা ফেরত দেননি তিনি। জাল সনদে প্রতারণার মাধ্যমে অবৈধ প্রভাবে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার অভিযোগে অভিবাবক হেলাল উদ্দিন খান ও আলকাছ উদ্দিন এবং ফজলুল হক বাদী হয়ে নেত্রকোনা সহকারী জজ আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার নং-১০/২০২২।
পূর্বধলা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শফিকুল ইসলাম বলেন, গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সরকারি বিধি বহির্ভতভাবে সুদীপ চন্দ্র সরকার প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ নিয়েছেন। আমরা শিক্ষকরা বিষয়টি শিক্ষা উপদেষ্টা, উপজেলা নির্বাহী অফিসার সহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদনের মাধ্যমে জানিয়েছি।পূর্বধলা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুদীপ চন্দ্র সরকারের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। তিনি মোবাইল রিসিভ করেন নি।পূর্বধলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও পূর্বধলা উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মো. খবিরুল আহসান বলেন, পূর্বধলা উচ্চ বিদ্যালয়ের বিষয়ে পক্ষে বিপক্ষে লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
কিউএনবি/অনিমা/০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪,/বিকাল ৩:৩৫