শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:০৮ অপরাহ্ন

ভ্যালেন্টাইন’স ডে: প্রথা, মিথ না কুসংস্কার

Reporter Name
  • Update Time : বুধবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪
  • ১১৯ Time View

সাহিত্য ডেস্ক : সত্যিকার ভ্যালেন্টাইন’স ডে’র ইতিহাস সম্পর্কে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মত। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের ধারণা, রোমান সেইন্ট (সাধু) ভ্যালেন্টাইন খ্রিস্টধর্ম ত্যাগ না করায় তাকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা থেকেই এর উৎপত্তি। তাদের মতে, ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি তার আত্মত্যাগের ওই দিনটি ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে প্রথম উদযাপিত হয়।

কিছু বিশেষজ্ঞ অবশ্য বলে থাকেন, কারাগারে বন্দি থাকার সময় কারারক্ষীর মেয়েকে তার স্বাক্ষরিত একটি চিঠি পাঠান সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন, যাতে লেখা ছিল ‘লাভ ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন’। ভালোবাসার এমন স্মৃতিকে জড়িয়েই পরবর্তী সময়ে ভ্যালেন্টাইন’স ডে’র প্রচলন বলে ধারণা করেন এসব বিশেষজ্ঞরা।

ভালোবাসার দিন বা ভ্যালেন্টাইন’স ডে উদযাপনের আরো একটি ভিন্ন ধারণা আছে। রোমান সম্রাট ক্লডিয়াসের সময় সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন গির্জার ধর্মযাজক ছিলেন। ক্লডিয়াস তার সঙ্গে মতবিরোধের জন্য প্রথমে তাকে কারাবন্দি করেন। পরে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন। ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে পোপ জেলাসিয়াস সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের সম্মানে ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটি নির্ধারিত করেন এবং পরবর্তীকালে তার নামানুসারেই উদযাপিত হতে থাকে এই অনুষ্ঠান।

মূলত ভ্যালেন্টাইন’স ডে উদযাপন শুরু হয় রোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকে।

প্রাচীন রোমে ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল রোমান দেবদেবীদের রানী জুনোর সম্মানে উদযাপন করা পবিত্র দিন। রোমানরা তাকে নারী ও বিয়ের দেবী বলে বিশ্বাস করতেন। দিনটি অনুসরণ করে পরের দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হতো লুপারকেলিয়া উৎসবের বিশেষ ভোজ।

রোমান সম্রাট ক্লডিয়াস

লুপারকেলিয়া উৎসবের সন্ধ্যায় কাগজের টুকরোয় তরুণীদের নাম লিখে একটি পাত্রে জমা করা হতো। সেখান থেকে এক একজন তরুণ একটি করে কাগজের টুকরা তুলতেন এবং কাগজের টুকরোয় যে তরুণীর নাম লেখা থাকতো ওই উৎসবের সময় পর্যন্ত সে তাকে তার সঙ্গী হিসেবে পেতেন। পরে কখনও কখনও ওই দু’জনের জুটি পুরো বছর ধরে টিকে থাকত এবং প্রায়শ তারা একে অপরের প্রেমে পড়ত। সব শেষে তা বিয়ে পর্যন্তও গড়াত।

সম্রাট ক্লডিয়াসের শাসনামলে রোম কয়েকটি জনবিরোধী এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। হিংস্র প্রকৃতির ক্লডিয়াস সে সময় তার সেনাবাহিনীতে যথেষ্ট সংখ্যক সৈন্য ভর্তি না হওয়া নিয়ে খুব কঠিন সময় পার করছিলেন। রোমান পুরুষদের তাদের পরিবার ও ভালোবাসা ত্যাগ করে যুদ্ধে না যাওয়াকেই এর প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করছিলেন তিনি। ফলে ক্লডিয়াস সমগ্র রোমে সব ধরনের বিয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সে সময় সেন্ট ভ্যালেন্টাইন রোমের একজন ধর্মযাজক ছিলেন। তিনি এবং সেন্ট ম্যারিয়াস খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী তরুণ-তরুণীদের গোপনে বিয়ে দিতেন এবং বিবাহিত যুগলদের সহযোগিতা করতেন। এ কারণে রোমের ম্যাজিস্ট্রেট তাকে গ্রেপ্তার ও কারাবন্দি করেন।

ভ্যালেন্টাইন বন্দি থাকা অবস্থায় অনেক তরুণ তাকে দেখতে যেতেন এবং কারাগারের জানালা দিয়ে তার উদ্দেশে লেখা চিরকুট ও ফুল দিয়ে তাদের ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন। হাত নেড়ে তাকে জানাতেন যে, তারা ‘যুদ্ধ নয়, ভালোবাসায় বিশ্বাসী’। এদের মধ্যে একজন ছিলেন কারারক্ষীর মেয়ে। তার বাবা তাকে ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এবং তার সাথে কথা বলতে সুযোগ করে দিতেন। মেয়েটি তাকে তার প্রতি ভালোবাসা, ক্লডিয়াসের নির্দেশ অমান্য করে তরুণ-তরুণীদের গোপনে বিয়ে দেওয়া এবং ভালোবাসায় তার সমর্থনের কথা জানায়। এক সময় তারা একে অপরের বন্ধু হয়ে যায়।

এ কথা জানতে পেরে সম্রাট ক্লডিয়াস ভ্যালেন্টাইনকে শিরোচ্ছেদ করে হত্যার নির্দেশ দেন। ভ্যালেন্টাইনকে হত্যার দিনে তিনি মেয়েটিকে তার বন্ধুত্ব এবং ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস নিয়ে একটি চিরকুট লিখে রেখে যান। এতে তিনি লিখেছিলেন, ‘লাভ ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন’। বিচারকের নির্দেশ অনুসারে সে দিনই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের এই আত্মত্যাগের দিনটি ছিল ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি।

সত্যিকার অর্থেই প্রাচীন রোম ছিল নানা প্রথা ও কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত একটি দেশ। এসব প্রথার মধ্যে লুপারকেলিয়া ছিল একটি। এটি অনুষ্ঠিত হতো ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখ। ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে পোপ জেলাসিয়াস সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের সম্মানে লুপারকেলিয়া অনুষ্ঠানের দিন ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখের পরিবর্তে ১৪ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত করেন। পরে এটি সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের নামানুসারে ‘ভ্যালেন্টাইন’স ডে’ নামে দ্রুত পরিচিতি লাভ করে।

কালের ধারাবাহিকতায় ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাছে ভ্যালেন্টাইনস ডে এবং সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। নানা সামাজিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বাহারি ফুল, কবিতা ও ছোটখাট উপহার বিনিময়ের মধ্য দিয়ে সারাবিশ্বে দিনটি ব্যাপকভাবে উদযাপিত হয়।

বিচিত্র ভ্যালেন্টাইনস ডে
প্রথম ভালেন্টাইন’স কার্ড পাঠানোর প্রচলন করেন আমেরিকার মিস এস্থার হাওল্যান্ড। ১৮০০ সাল থেকে দিনটিকে কেন্দ্র করে বাণিজ্যিক সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন হয়। বর্তমানে এটি বিশ্বের অনেক দেশেই উদযাপিত হয়, যাকে কেন্দ্র করে জম্পেশ ব্যবসা করেন সওদাগর-দোকানদাররা। বিশেষ করে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে লাভল্যান্ড ও কলারাডো সবচেয়ে বেশি ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হয়।

আজ থেকে শতবর্ষ আগে ব্রিটেনে ছোট শিশুরা দল বেঁধে বাড়ি বাড়ি গান গেয়ে দিনটি উদযাপন করতো। ওয়েলসে কাঠের তৈরি চামচের ওপর হৃৎপিণ্ড, তালা, শেকল প্রভৃতির নকশা খোদাই করে এ দিনে উপহার দেওয়া হতো। এর মানে ছিল ‘ইউ আনলক মাই হার্ট’।

কোথাও আবার এ দিনে তরুণীরা রোদে একটি বাটিতে পরিষ্কার পানি রেখে তার ওপর চেয়ে থাকতেন। ধারণা করা হতো, যার ছবি ওই পানিতে ভেসে উঠবে, সে-ই হবে তার কাঙ্খিত ভ্যালেন্টাইন। কোথাও ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখে তরুণ-তরুণীরা তাদের জামার হাতায় কাঙক্ষিত ভালোবাসার মানুষটির নাম লিখে সপ্তাহজুড়ে ঘুরে বেড়াতেন। তারা ধরেই নিতেন, এর ফলে সহজেই কাছে পাবেন তার ভালোবাসার মানুষটিকে।

কোনো কোনো দেশে ১৪ ফেব্রুয়ারিতে অবিবাহিত ছেলেরা মেয়েদের নতুন পোশাক উপহার হিসেবে পাঠাত। মেয়েটি ওই পোশাক গ্রহণ করলে ধরে নেওয়া হতো মেয়েটি তাকে বিয়ে করতে রাজি আছে। ওইসব দেশে কিছু কিছু লোকের ভ্যালেন্টাইনের ওপর বিশ্বাস ছিল আরও একধাপ এগিয়ে। তারা বিশ্বাস করত, ১৪ ফেব্রুয়ারিতে যদি কোনো মেয়ে তার মাথার ওপর একটি ফিতা উড়ে যেতে দেখে তাহলে তার বিয়ে হবে কোনো নাবিকের সাথে। যদি সে একটি চড়ুই পাখি দেখে, তবে তার বিয়ে হবে একজন দরিদ্র লোকের সাথে, কিন্তু সে হবে খুবই সুখী। আর যদি সে সোনালি রঙের মাছ দেখে, তবে তার বিয়ে হবে একজন প্রভাবশালী ধনাঢ্য লোকের সাথে।

পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন সব হাজারও প্রথা, কুসংস্কার ও মিথ জড়িয়ে আছে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগের কাহিনিকে ঘিরে। তবে ভালোবাসা সব সময়ই সর্বজনীন আর ভালোবাসার জন্য শুধু ভ্যালেন্টাইন কেন, যুগে যুগে পৃথিবীর বহু দেশে অসংখ্য মানুষ অকাতরে জীবন দিয়েছেন। কিন্তু ঘটা করে বছরে একবার নারী-পুরুষের ভালোবাসা প্রকাশের জন্য শুধু ভ্যালেন্টাইন নামক অনুষ্ঠানকে বেছে নেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত, এ প্রশ্ন থেকেই যায়।

তারপরও পরিবর্তিত সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ভালোবাসার শরীরেও লেগেছে আধুনিক প্রযুক্তির স্পর্শ। ডাকঘর, চিঠি আর ডাকপিয়নের জন্য কারো প্রতীক্ষায় প্রহর গুনতে হয় না আর এখন। মুঠোফোন, এসএমএস আর ইন্টারনেটের সুবাদে ফেসবুক, টুইটার ইমোতেই মুহূর্তে পৌঁছে দেওয়া যায় মনের কথাসহ বিচিত্র সব ছবি! প্রযুক্তির কল্যাণে ভ্যালেনটাইন’স ডে’ও পেয়েছে এখন নতুন মাত্রা।

জয় হোক ভালোবাসার!

লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

 

 

কিউএনবি/আয়শা/১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৪,/রাত ৯:২১

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

October 2025
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit