বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:১২ অপরাহ্ন

সাহিত্যে উইলিয়াম শেক্সপিয়র

শহিদ আহমেদ খান সাবের,সিলেট প্রতিনিধি
  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০২৪
  • ১১৬ Time View

শহিদ আহমেদ খান সাবের,সিলেট প্রতিনিধি : উইলিয়াম শেক্সপিয়র বিশ্ব সাহিত্যে অতি পরিচিত ও গ্রহণীয় একটি নাম। তাঁকে চর্চা করা হয় নানা মাত্রায়। প্রবাদ-প্রতিম এ নাট্যকার ১৫৬৪ সালে ২৩ এপ্রিল ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। আবার তাঁর মৃত্যুও একই তারিখে তবে ১৬১৬ সালে। তাঁকে নিয়ে নানা রূপগল্প প্রচলিত আছে যা আজও সমাধান হয়নি বা পাঠক সেগুলোর মধ্যে আনন্দ খুঁজে পায় বলে জীবনীকাররা হয়তো সত্যের অনুসন্ধানে নামেননি।তিনি দরিদ্র ঘরে জন্মগ্রহণ করেছেন। পড়াশোনা তাই ওভাবে হয়ে ওঠেনি। কিন্তু নিজের প্রতিভাকে বিকশিত করার সুযোগ পেয়ে তা কখনো নষ্ট করেননি। অনেকটা নাটকীয়ভাবেই মঞ্চে নাটক অভিনয়ের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। মঞ্চের প্রয়োজনেই নাটক রচনা করেন এবং প্রথমেই সবাইকে চমক দেখান। রচনাকাল ও বিষয়বস্তুর কারণে তাঁর নাটকগুলো প্রধানত চার ভাগে ভাগ করা হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক হলো ‘রিচার্ড থ্রি’, ‘কমেডি অভ এররস’, ‘টেমিং অভ দ্যা শ্রু’, ‘রোমিও জুলিয়েট’, ‘হ্যামলেট’, ‘ওথেলো’, ‘কিং লিয়ার’, ‘ম্যাকবেথ’, ‘লাভস লেবারস লস্ট’, ‘দি টু জেনটেলম্যান অব ভেরোনা’, ‘এ মিড সামার নাইটস ড্রিম’, ‘মার্সেন্ট অব ভেনিস’, ‘টুয়েলফথ নাইট’, ‘অ্যাজ ইউ লাইক ইট’, ‘ম্যাজার ফর ম্যাজার’, ‘হেনরি দি ফোর্থ’, ‘দি মার্সেন্ট অভ ভেনিস’ ও ‘দি টেমপেস্ট’। তিনি মোট সাইত্রিশটি নাটক ও ১৫৪টি সনেট লিখেন যা সনেট সিরিজ ও শেক্সপিরীয়ন সনেট নামেই পরিচিত। নাট্যপরিচালক হিসাবেও তিনি বেশ খ্যাতি অর্জন করেন। এর পাশাপশি দু’টি আখ্যানকবিতা এবং আরও কয়েকটি লিরিক কবিতাও লিখেন। তাঁকে ‘বার্ড অভ অ্যাভন’ নামে ডাকা হয়। লর্ড চেম্বরলেইন’স ম্যার নামে তাঁর একটি নাট্য কোম্পানি ছিল। এ কোম্পানি পরবর্তীতে কিং’স মেন নামে পরিচিত হয়।শেক্সপিয়রের নাটকগুলো মঞ্চস্থ হয় ১৫৮৯ সাল থেকে ১৬১৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। তাঁর প্রথম দিকের নাটকগুলো ছিল মিলনাত্মক ও ঐতিহাসিক। এরপরই তাঁর বিখ্যাত বিয়োগাত্মক নাটকগুলো রচিত হয়। বলা হয় এ পর্যায়েই তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনাগুলো সৃষ্টি করেন এবং এগুলোর মধ্য দিয়েই খ্যাতি অর্জন করেন। এরপর কমেডি এবং ট্র্যাজিকমেডি রচনা করেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি প্রাচীন ট্র্যাজেডির স্ট্রাকচার সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানের অভাব ছিল বলেই তিনি কোন নাটকেই কখনো থ্রি ইউনিটি ব্যবহার করেননি। সে জবাবটা তিনি দিয়েছিলেন ‘দি টেমপেস্ট’ লিখে। এবং বলা হয় জ্ঞানী মানুষেরা অন্যের সমালোচনা কর্ম দিয়েই দেন, মুখে নয়। সাহিত্য সমালোচক ডক্টর স্যামুয়েল জনসন মনে করেন, ‘শেক্সপিয়রই হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি প্রকৃতিবাদী, সবচেয়ে বড়ো প্রকৃতির কবি, জীবনের সবচেয়ে বড় রূপকার।’ এরপরই তিনি শেক্সপিয়রের নাটকের আদ্যোপান্ত বিশ্লেষণ করে দেখান শেক্সপিয়রের প্রত্যেক নাটকের চরিত্রগুলো একেবারে ভিন্ন এবং এদের একটির সাথে অন্যটি মিলানো যায় না। তবে প্রত্যেক চরিত্রই আবহমানকালের বাস্তব মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁর কোন চরিত্রই অতি মানব নয়। প্রত্যেকে মাটির খাঁটি মানুষ। এরা প্রত্যেকেই বস্তুবাদী ও সংসারজ্ঞানী।শেক্সপিয়রের রচনার মাধ্যমে মানুষ বাস্তবধর্মী জীবনাচারে অভ্যস্ত হতে উদ্বুদ্ধ হতেন। স্যামুয়েল জনসন বিষয়টিকে পরিষ্কার করার জন্য বললেন, ‘প্রাচীন গ্রিকে প্রচুর পড়াশোনা করে অনেকে বাস্তবধর্মী হয়ে উঠতে পারেনি, যা শেক্সপিয়রের নাটক দেখে হয়েছে। কেননা তাঁর নাটকের চরিত্রগুলো জীবনের ক্যানভাস।’তাঁর নাটকগুলোতে বিশেষ বা নির্বিশেষ কোন চরিত্র নির্মিত হয়নি। যেমন পৃথিবীতে বহু নাট্যকারের একটি চরিত্রের সংলাপ অন্যের মুখে স্থাপন করে দিলে তাঁদের আলাদা করা উপায় থাকে না। কিন্তু শেক্সপিয়র ছিলেন একেবারে ভিন্ন। তাঁর একটি চরিত্রের সংলাপ অন্যের ঠোঁটে মানায় না। এভাবে তাঁর অনেক মহত্ব রয়েছে। তবে বিপরীতভাবে তাঁর রচনার দুর্বলতার প্রকাশ পেয়েছে সাহিত্য সমালোচকদের মাধ্যমে। সবকিছু ছাপিয়ে বিভিন্ন নাটকের বিশেষ বিশেষ সংলাপের মধ্য দিয়ে জীবনের দর্শন ও করণীয় ফুটে উঠেছে, যা সব ধরনের মানুষ উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন যখন তখন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ‘সংসার করো অন্যের ওপর ভরসা করে নয়, নিজের হাত ও পায়ের ওপর ভরসা করতে শেখো।’, ‘মনের সৌন্দর্যকে যে অগ্রাধিকার দেয় সেই জয়লাভ করে।’, ‘জীবন মানে অনিশ্চিত ভ্রমণ’, ‘পৃথিবীর জীবন নামক নাট্যমঞ্চে সবাই একেকজন অভিনেতা, অভিনেত্রী। শুধুমাত্র চরিত্রগুলো ভিন্ন।’, ‘পুরো জীবনটাই একটা রঙ্গমঞ্চ’, ‘ওহে কেউ কি আমাকে শেখাবে কী করে আমি চিন্তা করা ভুলতে পারি।’, ‘যন্ত্রণা নাও, নিখুঁত হয়ে ওঠো।’, ‘ভালবাসা হল অসংখ্য উষ্ণ দীর্ঘশ্বাসের সমন্বয়ে সৃষ্ট ধোঁয়াশা।’, ‘সত্যিকারের ভালবাসার পথ কখনোই মসৃণ হয় না।’, ‘টু বি অর নট টু বি, দ্যাট ইজ এ কোয়েশ্চান।’, ‘ফেয়ার ইজ ফাউল, ফউল ফেয়ার।’ এমন অসংখ্য জীবনমুখী উক্তি তাঁর নাটকে উঠে এসেছে।কিন্তু এসবের কারণেই কি শেক্সপিয়র বাংলাদেশে প্রাসঙ্গিক! তাঁর নন্দনতত্ত্ব ও বাস্তবমুখীতা কি প্রাসঙ্গিক! বিষয়বস্তুর যে বৈচিত্র্যতা রয়েছে তা কি প্রাসঙ্গিক। না কেবল মাত্র রসবোধ, প্রেমবোধ ও সাময়িক চাঞ্চল্যতা আমাদের নাড়িয়ে দেয় বলেই প্রাসঙ্গিক! আরেকটু এগিয়ে বলা যায় শেক্সপিয়রের নারীরা আধুনিক ও প্রগতিশীল। তবে কি একারণে প্রাসঙ্গিক!সত্যিকারার্থে অনেক কারণেই চারশত বছর পরেও শেক্সপিয়র বাংলাদেশে প্রাসঙ্গিক, কিন্তু সে প্রাসঙ্গিকতা এদেশে সাহিত্য বোদ্ধা ও সাহিত্য পাঠক কেউ কাজে লাগাতে পারেনি। উল্লেখ্য ‘দি টেমপেস্ট’ নাটকে রাজ পরিবারের অভ্যন্তরে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও বর্হিবিশ্ব দখলের যে নীল নক্সশা এবং ঔপনিবেশবাদের যে রূপরেখা আঁকা হয়েছে তা বুঝতে পারলে এদেশের মানুষ অপসংস্কৃতিকে ধারণ করতো না এবং নিজেদের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর তৈরি করে রাখতো না। অন্যদিকে ‘কিং লেয়ার’ নাটকের যে প্লট তৈরি হয়েছে তার মধ্যে জাতীয়তাবাদের সুস্পষ্ট চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেশী দেশ সমূহের সাথে একটি দেশের সম্পর্ক কোন পর্যায় পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য হতে পারে তার রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে এখানে। এদেশের পাঠক মানেই তিনবোন কে কিভাবে বাবাকে ভালবাসতো এবং ছোট মেয়ে করডেলিয়া বাবার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধাবোধ দেখিয়েছেন, তা নিয়েই আলোচনা সমালোচনা করেন। আবার কেউ কেউ পয়েটিক জাস্টিসকে মূল বিষয়বস্তু তথা শিক্ষণীয় বিষয় হিসাবে চিহ্নিত করেন। কিন্তু করডেলিয়া কি সত্যিকার অর্থেই নিষ্পাপ, নাকি কোথাও একটু ভুল করেছেন বলেই প্রায়শ্চিত্ত করেছেন। তার বড় ভুল ছিল বাবাকে ও রাজ্যকে বাঁচাতে তিনি স্বামীর সহযোগীতায় ভিন্ন দেশ তথা ফ্রান্সের সৈন্য দিয়ে ইংল্যান্ডকে আক্রমণ করিয়েছেন। যে কোন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়কে মিটানোর জন্য অবৈধভাবে অন্য দেশের প্রবেশ জাতীয়তাবাদের পরিপন্থী। আর সেকারণেই শেক্সপিয়র তাকেও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে দেশকে ঔপনিবেশিক করার হাত থেকে রক্ষা করলেন।আবার ভিন্ন চিত্রও দেখি ‘হ্যামলেট’-এ। দর্শন নির্ভর এ নাটকটিতে রোমাঞ্চে ভরপুর। প্রিন্স হ্যামলেটকে দিয়ে সত্য উন্মোচন করিয়েছেন।কিন্তু সত্য উন্মোচনের পর প্রতিশোধপরায়ণতার মধ্যে যে প্রতিহিংসা ও জিঘাংসা ছিল, যার পরিণতি সবার মৃত্যু। এ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অন্যায়কে প্রতিহত করার জন্য অন্যায় রাস্তা গ্রহণ করতে কি পরিণতি হতে পারে, তার বর্ণনা উঠে এসেছে।অন্যদিকে ‘ম্যাকবেথ’ ও ‘ওথেলো’তে পরশ্রীকাতরতার কারণে মানুষ কিভাবে ভুল করে এবং তার শেষ পরিণতি কতো ভয়াবহ হয় তা চিত্রায়িত করেছেন। এভাবে তাঁর প্রত্যেকটি নাটককে আলাদা আলাদা করে প্রচলিত প্রথার বাইরে এসে আমাদের সমাজ বাস্তবতা ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা ও চর্চা করতে পারলে বাংলাদেশে শেক্সপিয়র চর্চা ও পাঠের প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাওয়া যেতো। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে গৎবাঁধা নিয়মে ও ব্যাখ্যায় নিজেদের আবদ্ধ রাখার কারণে শেক্সপিয়র আচার সর্বস্ব হয়েছে। এ পাঠ বা চর্চার কোন গুরুত্বই থাকে না। সুতরাং বাস্তবতা আঙ্গিকে শেক্সপিয়র রচনা পাঠ করলে মানুষের মধ্যে নৈতিকতাবোধ জাগ্রত হবে এবং সুন্দর সমাজ নির্মাণে মানুষ স্বপ্ন দেখতে পারবে।

কিউএনবি/অনিমা/১৮ জানুয়ারী ২০২৪/রাত ৮:৫৫

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

December 2025
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৬
IT & Technical Supported By:BiswaJit