মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫, ১১:৩৭ অপরাহ্ন

লুৎফর রহমান এর নিয়মিত কলামঃ অচিন গাছ

লুৎফর রহমান। রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট।
  • Update Time : শুক্রবার, ৩ নভেম্বর, ২০২৩
  • ৪৪৯ Time View

লুৎফর রহমান এর নিয়মিত কলামঃ অচিন গাছ
——————————————————–
২০০১ সালের ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও চারদল থেকে কুড়িগ্রাম -২ আসনে মনোনয়ন লাভ করার পর নির্বাচনী প্রচারণায় আমি সময় পেয়েছিলাম মাত্র ১৮ দিন। কিন্তু কুড়িগ্রাম-২ আসনে ২১টি ইউনিয়ন সহ একটি পৌরসভায় প্রচারণার জন্যে একদিন করেও সময় পাইনি। এজন্যে সকাল থেকে রাত অবধি প্রচারণা চালিয়ে গিয়েছি। বিরামহীন প্রচারণার মাঝে একদিন নজরে এলো একটি গাছের। যার নাম ”অচিন গাছ”।

কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার চাকিরপশার ইউনিয়নে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। এরমধ্যে সন্ধ্যা নেমেছে। নিকষ কালো অন্ধকার চারিদিকে গ্রাস করে ফেলেছে। এক গৃহস্থ বাড়ীর আঙ্গিনায় হ্যাজাক জ্বালিয়ে মিটিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। চাকিরপশার ইউনিয়নের জয়দেব হায়াৎ মৌজার এই গ্রামটির নাম অচিন গাছ। স্থানীয় এক নেতা বললেন, পাশেই অচিন গাছটি আছে। দেখতে যাবেন ? আমি সংগে সংগে রাজি হয়ে গেলাম। দেখতে গেলাম অচিন গাছ।

সাথে অনেক দলীয় নেতাকর্মী এসেছে। মোটর সাইকেলের হেডলাইট গাছের গোড়ায় তাক করে রেখেছে একজন। আমি বিস্মিত হয়ে পড়লাম। বিশাল গাছের গোড়া থেকে শিখর পর্যন্ত মূল গাছের অবয়ব ও ডালপালা কালো কুচকুচে। গাছের গোড়ায় লাল শালু কাপড় দিয়ে হিন্দুরা বেঁধে দিয়েছে। গাছের গোড়ায় সিঁধুর আর নানান ফুলের ছড়াছড়ি। বুঝলাম গাছটিকে হিন্দুরা পূজা করে।

স্থানীয় একজন হিন্দু বৃদ্ধলোক অচিন গাছ সম্পর্কে আমাকে কিছু ধারণা দেয়ার চেষ্টা করছে। আমি মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছি আর গাছটিকে দেখছি। বছরের পর বছর একটি গাছ ছায়া দিয়ে আসছে। তবে এর নাম কী এবং জন্ম কখন– তা কেউ বলতে পারে না। এলাকার এই প্রবীণ ব্যক্তির মতে, গাছটির বয়স কমপক্ষে ৫০০ বছর। তবে তাঁরাও গাছটি সম্পর্কে তাঁদের বাপদাদার কাছ থেকে শুনেছেন। কিন্তু কেউই নাম বলতে পারেননি। তাই যুগ যুগ ধরে এটিকে ‘অচিন গাছ’ বলেই জেনে আসছেন এলাকাবাসী। গাছটি ঘিরে রয়েছে নানা রহস্য।

কুড়িগ্রাম জেলা শহর থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তরে গেলেই দেখা যাবে ‘অচিন গাছ’। চাকির পশার ইউনিয়নের জয়দেব হায়াত গ্রামে মৃত দর্পণ নারায়ণের বাড়িতে বিশাল আকৃতির গাছটি শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হয়, কোনো বৃদ্ধ দুই হাত দিয়ে এলাকাটি আগলে রেখেছেন।

গাছটি কেন্দ্র করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দির গড়ে উঠেছে। স্থানীয়রা বললেন, প্রতিদিন সন্ধ্যায় সনাতন ধর্মের লোকজন এসে পূজা-অর্চনা করেন; দানবাক্সে দক্ষিণা দেন। অনেকে গাছটির গোড়ায় এসে মানত করেন। তবে অযত্ন, অবহেলা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে গাছটির চারদিক জঙ্গলে ভরে গেছে। এর আগে গাছটির শাখা-প্রশাখা প্রায় ২০ শতক জমিজুড়ে বিস্তীর্ণ ছিল। ডালপালা এতই ছড়িয়েছিল যে আশপাশের বাড়িগুলোতে রোদ পড়ত না। তাই সেসব বাড়ির লোকজন একটু দূরে ধান-পাট শুকাতে দিতেন। তবে গাছটির শাখা-প্রশাখা কমে গেছে, বর্তমানে প্রায় ১০ শতাংশ জায়গাজুড়ে আছে।

অনেকে বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে কখনও গাছটির ডাল ভেঙে পড়তে দেখেননি। গাছটিতে পাইকোর ফলের মতো গোটা গোটা ফল ধরে। পাতা ডুমুর পাতার মতো হলেও তত খসখসে নয়; মসৃণ। সারাবছর গাছে পাতা থাকে। পাতার রস সাদা। ফল পশুপাখি খায়। মাটিতে পড়া ফল থেকে নতুন গাছ জন্মায় না। অনেক আগে গাছটিতে বিশাল আকৃতির বিষধর সাপ বসবাস করত। কিন্তু এসব সাপ মানুষের ক্ষতি করেনি।

গাছটি ঘিরে স্থানীয়দের লোকমুখে নানা গল্পকথা শোনা যায়। অনেকের ধারণা, বর্তমান ভারতের আসাম রাজ্যের কামরূপ-কামাখ্যা থেকে আগত একদল জাদুকর গাছটি চোখের পলকে উড়িয়ে এনে বর্তমান স্থানে লাগিয়ে দেন। অপর এক পৌরাণিক কাহিনি থেকে জানা যায়, কোনো এক অজানা পীর সুদূর পশ্চিম দিক থেকে গাছটির চারা এনে এখানে রোপণ করেছিলেন। সে কারণেই গাছটি কেউ চেনেন না।

গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম ‘ফিকার ল্যাকর বাচ-হাম’ দাবি করেন কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ। এগুলো লাতিন শব্দ। এটি মরীচি পরিবারের ফিকাস গণভুক্ত গাছ।

ছোটবেলা থেকেই অচিন গাছের নাম শুনে এসেছি। কিন্তু নির্বাচন করতে এসে জীবনের প্রথম গাছটি দেখতেপেয়েছি। টগরাইহাট রেল স্টেশন থেকে অচিন গাছে আসার রাস্তাটি কাঁচা ছিল। দল ক্ষমতায় আসার পর এলজিইডির ২১ প্রকল্পের মাধ্যমে রাস্তাটি পাকা করে দেই। এখন আর অচিন গাছ দেখতে কারও কস্ট হয়না।

লেখকঃ লুৎফর রহমান একজন রাজনীতিবিদ ও লেখক। তিনি নিয়মিত লেখালেখির পাশাপাশি ইলেক্ট্রনিক নিউজ মিডিয়ার সম্পাদক ও প্রকাশক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র লুৎফর রহমান ৮০ এর দশকের স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরতে দুটি রাজনৈতিক উপন্যাস লিখেছেন, যা দেশ বিদেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় জীবনের খন্ডচিত্র এঁকে তিনি এখন ব্যাপক পরিচিত।

কিউএনবি/বিপুল/০৩.১১.২০২৩/ রাত ১০.০৯

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

July 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit