বাংলাদেশ থেকে স্থলপথে নতুন করে ৯ ধরনের পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করেছে ভারত। এতে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা উদ্বিগ্ন। ভারতে এতদিন রপ্তানির ৯৯ শতাংশেরও বেশি পাঠানো হতো স্থলপথে। কিন্তু সম্প্রতি ভারত সরকার হঠাৎ করেই স্থলপথে বাংলাদেশের পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যা দেশের রপ্তানি খাতের জন্য অশনিসংকেত বলে মনে করছেন রপ্তানিকারকরা। তারা বলছেন, ভারতের এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না করা হলে সমুদ্রপথে পণ্য পাঠাতে হবে। এতে সময় ও খরচ দুটোই বাড়বে; আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাবে; কমবে রপ্তানি আয় এবং বাড়বে বাণিজ্য ঘাটতি। সব মিলিয়ে দেশের রপ্তানি খাতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ ক্ষেত্রে শিগগির দেশটির সঙ্গে সমঝোতা করা প্রয়োজন।
জানা গেছে, ভারতের বিধিনিষেধের তালিকায় থাকা ৯ পণ্যের মধ্যে রয়েছে- ফ্ল্যাক্স সুতার বর্জ্য, কাঁচা পাট, পাটের রোল, ফ্ল্যাক্স সুতা, পাটের সুতা, ফুড গ্রেড সুতা, লিনেন কাপড়, লিনেন ও তুলার সুতার মিশ্রিত কাপড় এবং কম প্রক্রিয়াজাত বোনা কাপড়। নিষেধাজ্ঞার তালিকায় মূলত কাঁচা পাট ও প্রক্রিয়াজাত পাটপণ্যই বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ এমনিতেই অনেক বেশি। নতুন নিষেধাজ্ঞায় এটি আরও বাড়বে। পণ্য আমদানিতে শুধু সমুদ্রের একটি পথ খোলা রেখেছে ভারত। তবে জাহাজে মুম্বাইয়ের নভোসেবা বন্দর ঘুরে যদি পণ্য নিয়ে যেতে হয় পশ্চিমবঙ্গে, তাহলে খরচ ও সময় বেশি লাগবে।
বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, এ ক্ষেত্রে সরকারকে অবশ্যই উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে। ভারতের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলা ও আপত্তি জানানো উচিত। পাশাপাশি বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির বিকল্প বাজার খোঁজাও জরুরি। তারা আরও বলেন, আলোচনা ও কূটনৈতিক উদ্যোগই সংকট উত্তরণের সবচেয়ে সেরা পথ।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকিন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, বাংলাদেশ থেকে স্থলপথে ৯ ধরনের পণ্য আমদানিতে ভারতের আকস্মিক নিষেধাজ্ঞা রপ্তানিকারকদের জন্য বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত তিন মাসে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে ভারত। যেহেতু বাংলাদেশের রপ্তানির প্রায় পুরোটাই স্থলপথে হয়ে থাকে, এ নিষেধাজ্ঞা দেশের রপ্তানি খাতের জন্য একটি বড় ধাক্কা, বিশেষ করে ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য। এর ফলে শুধু পণ্যের স্বাভাবিক প্রবাহই নয়, দুই দেশের দীর্ঘদিনের বাণিজ্যিক সম্পর্কের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর হয়ে ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটানে ওই ৯ ধরনের পণ্য রপ্তানিতে কোনো বিধিনিষেধ নেই। এ ছাড়া এসব পণ্য মুম্বাইয়ের নভোসেভা বন্দর হয়ে ভারতে প্রবেশ করতে পারবে। তিনি বলেন, এ জটিলতার আশু উত্তরণে কূটনৈতিক আলোচনা অতীব জরুরি।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, নতুন নিষেধাজ্ঞা প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে রপ্তানি বাড়ানোর প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করবে। কারণ, আমাদের রপ্তানি আয়ের বেশিরভাগই আসে তৈরি পোশাক থেকে, যার সিংহভাগই স্থলবন্দর দিয়ে পাঠানো হয়। এ জন্য আলোচনা করে সমাধান করতে হবে। তবে বিষয়টি দুই দেশেরই ক্ষতি। কারণ, তারা আমাদের দেশ থেকে পোশাক আমদানি না করলে অন্য দেশ থেকে তাদের বেশি দামে আমদানি করতে হবে। অন্যদিকে প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশিরভাগই সেভেন সিস্টারস (উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো) অঞ্চলের জন্য। যেহেতু তাদের কলকাতা দিয়ে রপ্তানি করতে হবে, তাই সময় ও খরচ বাড়বে। ফলে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারানোর কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ-র সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম পারভেজ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, এটি দুই দেশের পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপের অংশ। এর আগে ভারত বাংলাদেশের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধ করেছে। পরে বাংলাদেশ স্থলপথে সুতা আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করে। এর পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে স্থলপথে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে ভারত। এতে আমাদের রপ্তানিতে অবশ্যই বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। এ ধরনের পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন দুই দেশের নাগরিকরা। তাই দুই দেশের সরকার আলোচনার মাধ্যমে এসব সমস্যার সমাধান করতে পারে। আমাদের দেশের স্বার্থে, অর্থনীতির স্বার্থে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। সমস্যা সমাধানে সরকারের জোরালো রাজনৈতিক সমঝোতা দরকার। এটি সম্মানের সাথে হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে এই ৯ ধরনের পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১৪ কোটি ৯৪ লাখ ডলার বা ১ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকার। এর মধ্যে স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়েছে ১৪ কোটি ৭৭ লাখ ডলারের পণ্য। অর্থাৎ, এসব পণ্যের ৯৯ শতাংশই স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়।
জানা গেছে, বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বরাবরই ভারত এগিয়ে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারত থেকে ৯০০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এর বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পণ্য রপ্তানি হয়েছে মাত্র ১৫৭ কোটি ডলারের পণ্য।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে ভারতে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় তৈরি পোশাক। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারতে ৫৪ কোটি ৮৮ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা। এ ছাড়া ভারতের নতুন বিধিনিষেধের কারণে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। গত অর্থবছরে ভারতে ১৫ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
কিউএনবি/সুমন/ ০৩ জুলাই, ২০২৫ / সকাল ১০:৩০