ডেস্ক নিউজ : ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের (ডিএজি) দায়িত্ব থেকে সদ্য অব্যাহতি পাওয়া এমরান আহম্মদ ভূঁইয়াকে গত চার সেপ্টেম্বরের আগে তার কর্মস্থলের সহকর্মী কিংবা পরিচিতজনরা ছাড়া কেউ চিনতেন না। কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি দেশের অন্যতম আলোচিত-সমালোচিত চরিত্র। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিষয়ে বিবৃতি সংক্রান্ত বক্তব্য, এর জেরে ডিএজি পদে তার নিয়োগ বাতিল, নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়ে ঢাকার বারিধারায় মার্কিন দূতাবাসে পরিবার নিয়ে কয়েক ঘণ্টা অবস্থান, শেষে নিরাপত্তার আশ্বাসে বাসায় ফেরা এমরানকে নিয়ে এখন দেশজুড়ে বিস্তর আলোচনা ও জিজ্ঞাসা। প্রশ্ন উঠেছে কেন তিনি এসব করলেন, স্পর্শকাতর ইস্যুতে তার এই অবস্থানের উদ্দেশ্যই বা কী, মার্কিন দূতাবাসেই বা কেন গেলেন, সবকিছু পরিকল্পিত কি না? কিছু না পাওয়ার ক্ষোভ কিংবা হতাশা থেকে এমনটি করেছেন কি না এমন বহু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বিচারাঙ্গন ও দেশজুড়ে।
এমরানের বিষয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল পদমর্যাদার অন্তত পাঁচজন আইন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে দেশ রূপান্তর। তবে, গণমাধ্যমে কথা বলতে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের বিধিনিষেধের কারণে তারা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেন। আলাপকালে এই আইন কর্মকর্তারা বলেন, ড. ইউনূসকে নিয়ে এমরানের এমন ভূমিকায় কিছুটা হতভম্ব হয়ে যান তার দীর্ঘদিনের সহকর্মী আইন কর্মকর্তারা। পড়েন বিব্রতকর পরিস্থিতি ও অস্বস্তিতে। ড. ইউনূসের মামলার বিচারে সমর্থন ও বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় দেড়শতাধিক ব্যক্তির বিবৃতির প্রতিবাদে পাল্টা বিবৃতিতে স্বাক্ষর নিতে উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীদের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি (সুপ্রিম কোর্ট বার)। এতে অনেকে স্বাক্ষরও করেন। এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের কোনো নির্দেশনা বা বাধ্যবাধকতা ছিল না। কিন্তু এমরানের এমন ভূমিকায় এবং বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে খোলাখুলি কথা বলায় সৃষ্ট পরিস্থিতির জন্য আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীরা মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। অন্যদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ৪ সেপ্টেম্বরের পর এমরান সুপ্রিম কোর্ট বা তার কর্মস্থলমুখী হননি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী কমিশনার মো. আজিজুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তিনি (এমরান) নিরাপত্তা চেয়ে পুলিশের কাছে আবেদন করেছেন এমন তথ্য জানা নেই। তার জন্য আলাদা করে কোনো নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে না।’
একাধিক আইন কর্মকর্তা বলেন, এমরান আওয়ামী ঘরানার। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে ছাত্রলীগ করতেন- এমন কথা তারা শুনেছেন। আইন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে থেকে হাইকোর্টের বিচারক হতে চেয়েছিলেন তিনি। গত পাঁচ বছরের বেশি সময়ে দুইবার হাইকোর্টে ২৯ জন বিচারপতি নিয়োগ হলেও তাকে আইন কর্মকর্তা হিসেবেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা না পাওয়া, আলোচনায় এসে মার্কিন মুলুকে যাওয়ার পথ সুগম করা কিংবা ক্ষোভ থেকে তিনি এ ধরনের নাটকীয়তার পথ বেছে নিতে পারেন বলে মনে করছেন অনেক আইনজীবী। গত দুদিন ধরে এমরানের সঙ্গে মোবাইল ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগের চেষ্টা করেও এ বিষয়ে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। ১৪ বছর ধরে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে আইন কর্মকর্তা (সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল থেকে এখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল) হিসেবে কর্মরত একজন আইনজীবী নাম না প্রকাশের শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন কাজ করলেও এমরানের সঙ্গে কখনো ঘনিষ্ঠতা হয়নি। আবার সম্পর্কের অবনতিও ছিল না। অন্যদের বেশিরভাগের সঙ্গে তার হাই হ্যালো সম্পর্ক। কিছুটা নিজের মতো করে থাকতেন তিনি। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কর্মদিবসেও তিনি নিয়মিত ছিলেন না। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও অ্যাটর্নি জেনারেল স্যার (এ এম আমিন উদ্দিন) কখনো তার সঙ্গে উচ্চবাচ্য করেননি।’
এই আইন কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘শুনেছি, এই কয়েক বছরে বিচারক নিয়োগে তার নাম না আসায় হতাশ ছিলেন তিনি। আমেরিকায় তার কিছু স্বজন আছেন। তিনিও যেতে চান কিন্তু ভিসা হচ্ছে না।’
এমরানের সহকর্মী ও বিভিন্ন মাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, কুমিল্লার বুড়িচংয়ের রাজাপুর ইউনিয়নের শঙ্কুচাইল গ্রামে তার পৈতৃক নিবাস। তবে, সেখানে খুব বেশি যাওয়া-আসা বা যোগাযোগ নেই এমরান বা তাদের ভাইবোনদের। ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) অধীনে ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৯৩ সালে একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন এমরান। এরপর ১৯৯৩-৯৪ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। তার বাবা অধ্যাপক সুলতান আহম্মদ ভূঁইয়া (প্রয়াত) একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাবার শিক্ষকতার সুবাদে সেখানকার নির্ধারিত কোয়ার্টারে থাকতেন তারা।
এমরানের একই বিভাগে পূর্ববর্তী শিক্ষাবর্ষে (১৯৯২-১৯৯৩) ভর্তি হয়েছিলেন বর্তমানে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে চাঁদপুর পৌরসভার নির্বাচিত মেয়র জিল্লুর রহমান জুয়েল। তিনি ছিলেন চবি ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি। দেশ রূপান্তরকে জিল্লুর রহমান জুয়েল বলেন, ‘এমরান ছাত্রলীগের মিটিং-মিছিলে সক্রিয় ছিল, এটা আমি দেখেছি। কিন্তু ছাত্রলীগের কোনো পদেই ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা কলেজ কিংবা শিক্ষক-কর্মচারীদের সন্তানদের নিয়ে গঠিত কোনো ইউনিটের শীর্ষ পদে ছিল হয়তো।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি শুনেছি অধ্যাপক বাবার পোষ্য কোটায় এমরানসহ অন্তত তিন ভাই-বোন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগে পড়ার সুযোগ পায় বিভিন্ন সময়ে। মিঠু নামে তার এক ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের রাজনীতি করত।’
২০০৩ সালের এপ্রিলে হাইকোর্টে আইন পেশা শুরু করেন এমরান। তার সঙ্গে কমবেশি পরিচয় আছে এমন বেশ কয়েকজন আইনজীবী দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারের একজন মন্ত্রীর (সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী) সুপারিশে ২০১৮ সালের ৪ জানুয়ারি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান এমরান। সে সময় অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন মাহবুবে আলম (২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরে প্রয়াত)। প্রথমে তাকে হাইকোর্টের একটি একক বেঞ্চে (দেওয়ানি) মামলা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর একটি দ্বৈত বেঞ্চের দায়িত্বে ছিলেন বছরখানেক। নিয়োগ বাতিল হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি হাইকোর্টের একটি ফৌজদারি বেঞ্চের দায়িত্বে ছিলেন। তবে, আইন পেশা কিংবা পাঁচ বছর আইন কর্মকর্তা হিসেবে এমরানকে তেমন কোনো আলোচিত ও স্পর্শকাতর মামলায় শুনানি কিংবা পরিচালনা করতে দেখেননি তার সহকর্মী আইন কর্মকর্তারা।
গত সোমবার সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অ্যানেক্স (বর্ধিত) ভবনের সামনে গণমাধ্যমে কথা বলতে আসেন এমরান। সুপ্রিম কোর্টের অবকাশ চলাকালীন ওই দিন তিনি কোনো মামলা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন না। উচ্চ আদালতের আইনজীবীরা আদালতে টাই পরেন না। সাদা রঙের কলার ব্যান্ড পরেন। কিন্তু ওইদিন এমরান স্যুট-টাই পরে গণমাধ্যমে বক্তব্য দিতে হাজির হন। অবকাশের সময় হঠাৎ গণমাধ্যমের সামনে আসা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ এম আমিন উদ্দিন। এ প্রসঙ্গে তিনি গতকাল শনিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অসত্য তথ্য নিয়ে তিনি (এমরান) যেভাবে গণমাধ্যমে কথা বলতে এলেন, এখন তো আরও অনেক কিছু জনগণের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। কী উদ্দেশ্যে তিনি এমন করলেন সেটি আমাদের জানা নেই। তবে, উদ্দেশ্য একটি নিশ্চয়ই আছে। সেটি পূরণের জন্য এগুলো করেছেন তিনি এবং এটি অবশ্যই পূর্বপরিকল্পিত।’
এক প্রশ্নের উত্তরে এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘কোনো একজন ব্যক্তি অন্যায় কাজ করলে তার জন্য সেই দপ্তরের অন্যরা বিব্রত হবেন কেন? উনি যদি সত্য কথা বলতেন তাহলেও কথা ছিল। কিন্তু উনি তো সম্পূর্ণ অসত্য তথ্য দিয়েছেন।’
কিউএনবি/অনিমা/১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩,/রাত ৯:৩০