বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫, ১২:১৭ পূর্বাহ্ন

রুমকী’র কথা, রুমকী’র চিঠি ১০, শচীন দেববর্মন : মল বাজায়ে মন মাতায়ে সুরের এক ঝর্ণা

লুৎফর রহমান। রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট।
  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
  • ৩১৬ Time View

 শচীন দেববর্মন : মল বাজায়ে মন মাতায়ে সুরের এক ঝর্ণা
———————————————————————
১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাস। বাইরে তুষার ঝরছে অবিরত। দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী শহর সিউল তুষারের শ্বেত শুভ্র চাদরে যেন ঢেকে দেয়া হয়েছে। বাইরে সুঁচ ফুটানো তীব্র কনকনে ঠান্ডা। তাপমাত্রা -৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস। কিন্তু একটি বিল্ডিঙের বেজমেন্টে আরামদায়ক তাপমাত্রা। পুরো বেজমেন্টে টুথব্রাশের কারখানা। মিনিটে হাজার হাজার টুথ ব্রাশ তৈরী হচ্ছে। তাপমাত্রা ঠিক রাখতে ৩/৪ টি গ্যাসোলিনের হিটার থেকে তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে বেজমেন্টের নীচে মাঝারি সাইজের পুরো কারখানা রুমটিতে।

এই কারখানায় আমরা ৫ জন কাজ করি। রাতের শিফটে। রাত ১১ টা থেকে সকাল ৬ টা পর্যন্ত কাজ। তিনজন কোরিয়ান আর আমরা দুজন বাংলাদেশী। ৩ জন কোরিয়ানের মধ্যে একজন আগাছি বা তরুণী আছে। দিনে সে সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করে আর রাতে কাজ করে বাড়তি ইনকাম করার জন্যে। কোরিয়ান তরুণীর নাম, কিম হো সুক। কিম তার ফেমেলী টাইটেল আর কোরিয়ান ভাষায় হো সুক মানেপরিষ্কার লেক বা হ্রদ।

রাত জাগা কাজ। টুথব্রাশ ফ্যাক্টরী রুমের মধ্যে বড় সাইজের একটি টুইন ওয়ান ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ঘুম তাড়ানোর জন্যে আমরা কখনও কোরিয়ান গান শুনি। আরিরাং অর্থাৎ কোরিয়ান লোকগীতি। কখনো রিচার্ড মার্কস অথবা বব মার্লির গান শুনি। আবার কখনো গান শুনি দেশ থেকে ব্যাংকক হয়ে নিয়ে আসা মাত্র ৩ টি টিডিকে ক্যাসেটের গান। এর একটি ক্যাসেট ছিল শচীন দেববর্মনের।
প্রথম যেদিন শচীন দেববর্মনের ক্যাসেট চালু করে দিলাম। ক্যাসেটে গান বাজতে শুরু করল।

মনো দিল না বধু
মনো নিল যে শুধু
আমি কি নিয়ে থাকি
মহুয়া মাতাই ঢোলক
দোলে পলাশের নোলক
বাঁধে কেউ বাহুরও রাখি
আমি কি নিয়ে থাকি

সেদিন মিস কিম হো সুক সহ বাকি দুই কোরিয়ান যুবক এই গান শুনে চোখ কপালে তুলল। এরমধ্যে এক কোরিয়ান পার্ক হি সুং গিটার বাজায়, সংগীত প্রিয় একজন মানুষ। নিজেকে আরিরাং এর বিশেষ শিল্পী ভাবে। সে ওয়াক ওয়াক করে বমির ভাব করে শচীন দেব বর্মনের এই গানকে ব্যঙ্গ করা শুরু করল। হা হা বাংলাদেতি সং। মিস কিম এসে আমাকে বললো, তোমাদের সব গান কি শুধু নাকি সুরে গায় ? এই গানতো যেন নাক দিয়ে গাচ্ছে ? আমি মিস কিমকে বললাম, এই শিল্পীর গান মন দিয়ে, চোখ মুদে শুনবে। ধৈর্য্য নিয়ে শুনতে হবে। আমি ক্যাসেট ফরোয়ার্ড করে দিলাম। এবার বাজতে শুরু করল শচীন দেব বর্মনের এই গানটি।

ঝিলমিল ঝিলমিল ঝিলের জলে ঢেউ খেলিয়া যায়রে
ঝির ঝির ঝির হাওয়ায়রে ঢেউ খেলিয়া যায়
ঝিলমিল ঝিলমিল
ঝিলমিল ঝিলমিল
মল বাজায়ে মন মাতায়ে জল নিতে কেউ যায় না
বউ কথা কউ পাখি ডাকে বউ তো ফিরে চায় না
মন কাঁদে হায় হায় রে
আজ তুমি কোথায় কোথায় রে তুমি কোথায়
টলমল টলমল
টলমল টলমল ধানের ক্ষেতে ঢেউ খেলিয়া যায় রে
শনশন শন হাওয়ারে ঢেউ খেলিয়া যায়
ঝিলমিল ঝিলমিল।

কি যেন একটা ঘটে গেল টুথব্রাশ ফ্যাক্টরিতে। সব নিস্তব্ধ। ৩ কোরিয়ান ঝিম মেরে গান শুনছে গভীর মনোযোগে। গান শেষ হতেই মিস কিম অনুরোধ করল, এগেইন। আবার দাও, আবার শুরু কর। আমি ক্যাসেট রিউইন্ড করে আবার গানটা প্রথম থেকে শুরু করলাম। মল বাজায়ে মন মাতায়ে জল নিতে কেউ যায় না, বউ কথা কও পাখি ডাকে বউ তো ফিরে চায় না, এই অংশ টুকু আসতেই মিস কিম হটাৎ করে নাচতে শুরু করল। গানের তালে তালে মিস কিম হো সুকের সাথে সাথে বাকি দুই কোরিয়ান সহ আমরা সকলেই নাচতে শুরু করলাম। আহ কি নির্মল পবিত্র সে নাচ।

শচীন কর্তার গান শুনে ওয়াক ওয়াক করে বমির ভঙ্গি করা কোরিয়ান পার্ক হি সুং নাচ শেষে বুড়ো আঙ্গুল উঁচিয়ে আমাকে বলল, গুড সং। আমি মনে মনে বলি, শচীন কর্তার গানের গুড, ব্যাড তুই কি বুঝবি বেটা ? যেখানে আমার বাঙ্গালরাই এখন পর্যন্ত তাঁকে বুঝতে পারলোনা, চিনতে পারলোনা। আর তুই চিনবি? শচীন দেববর্মনকে চেনা কি এত সহজ ?

শচীন দেববর্মনের অনুনাসিক সুরে গান শুনে আমার মেয়ে আমার কাছে গতকাল প্রশ্ন করেছিল,আব্বু এই শিল্পীর গান তোমার এত ভাল লাগে ? এর জবাবে আমি তাঁকে শুনিয়েছি শচীন দেববর্মনের জীবন গাঁথা। আজ আমার মেয়েকে শুনালাম ৩২ বছর আগে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের প্রাণকেন্দ্রের একটি ভবনের বেজমেন্টে টুথব্রাশ ফ্যাক্টরির মধ্যে শচীন কর্তার গানের চিত্রকথা।

আমার মেয়েকে আরও বললাম, এই উপমহাদেশে সংগীতের রাজ্যে কেউ যদি মহারাজা থাকে তিনি শচীন দেব বর্মন। কুমিল্লার রাজপুত্র শচীন দেববর্মন সম্পর্কে জানতে আবারো আমি তোমাকে নিয়ে যাব এবার কোলকাতার ঢাকুরিয়াতে।

প্রিয় রুমকী / ভালোবাসা নিও। শচীনদেব বর্মন ও তোমার মেয়ে প্রসঙ্গে আমিও একটি নিবন্ধ লিখলাম। পড়ে দেখ। কাকতালীয়ভাবে তোমার মেয়ের মত আমার মেয়ের প্রসঙ্গটিও এসে গেছে। আমিও চাই তোমার মত, আমাদের সাহিত্য আর সংস্কৃতির সাথে পূর্ন পরিচয় ঘটুক আমাদের উত্তরাধিকারদের। শচীনদেব বর্মন সম্পর্কে তোমার লেখাগুলো ভালো হচ্ছে। আরও বেশি বেশি করে লিখবে। ভালো থেকো।

– তোমারই নাহিদ।

 

লেখকঃ লুৎফর রহমান একজন রাজনীতিবিদ ও লেখক। তিনি নিয়মিত লেখালেখির পাশাপাশি ইলেক্ট্রনিক নিউজ মিডিয়ার সম্পাদক ও প্রকাশক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র লুৎফর রহমান ৮০ এর দশকের স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরতে দুটি রাজনৈতিক উপন্যাস লিখেছেন, যা দেশ বিদেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় জীবনের খন্ডচিত্র এঁকে তিনি এখন ব্যাপক পরিচিত।

 

কিউএনবি/নাহিদা /০৭.০৯.২০২৩/ রাত ১০.২৬

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

July 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit