মিডিয়ার কারসাজি
———————–
সপ্তাহের শেষ কার্য দিবস। অফিস থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে নাহিদ। হোয়াটস্যাপ এ কলটি এলো তখনই। নিউয়র্কের কুইন্সের কিউ গার্ডেন থেকে কল করেছে রুমকী। নিজের রিভলবিং চেয়ারে গা টা এলিয়ে দিয়ে রুমকীর কল রিসিভ করল নাহিদ। শুরুতেই কুশল বিনিময় করল দুজনে।
নাহিদ কথার ফাঁকে ফাঁকে ভাবছে, রুমকী নিশ্চয়ই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট নিয়ে কথা শুরু করবে। কিন্তু এখনও শুরু করেনি। নাহিদ মনে মনে হাসছে। দেখি, রুমকী আজ নিজের থেকে কি কি নিয়ে কথা বলে ? নিজের থেকে সে কিছুই শুরু করতে চায়না। দেশকে নিয়ে কতটুকু ভাবে রুমকী, নাহিদ জানতে চায়।
রুমকী সাম্প্রতিক দেশ বিদেশের কোন বিষয় নিয়েই কোন কথা বলছেনা। রুমকী যে বিষয় নিয়ে কথা বলতে চায়, সে বিষয় নাহিদের জন্যে বড় কষ্টের। বেদনা মিশ্রিত অতীত। সে এক ধূসর নস্টালজিয়া।
মনে আছে নাহিদ? একবার এরশাদ ভ্যাকেশন হলো। তুমি আমি দুজনেই বাড়ীতে চলে গেলাম। প্রায় দুই মাস ক্যাম্পাস বন্ধ। বিকেল হলেই তুমি আমার বাসা আসতে। আমরা দুজনে কত বিষয় নিয়েই যে কথা বলতাম। তোমার কি সেই কথাগুলো মনে আছে ? নাহিদ বললো, সব মনে আছে আমার।
তুমি খুব সাহিত্য আর সংগীত প্রিয় ছিলে। আমাদের আলোচনার বিষয়গুলো বরাবরই সাহিত্য আর সংগীত ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। নাহিদ, তুমি ছিলে খুব আবেগপ্রবন একজন মানুষ। তুমি যেদিন আমাকে নিয়ে ঢাকায় ফিরলে, সেদিন নাইটকোচে সারারাত তুমি তোমার পছন্দের গান গুলো বাজিয়েছিলে। সিনেমার ঝাকানাকা গান শোনা যাত্রীরা সেদিন তোমার কারণে বড়ই বিরক্ত হয়েছিল।
রুমকী একটানা স্মৃতি চারণ করে যাচ্ছে। নামে নাইট কোচ। কিন্তু আমাদের ওখান থেকে নৈশকোচ ছাড়ত বিকালে। তুমি আমাকে নিয়ে নাইটকোচে ঢাকার উদ্যেশ্যে রওয়ানা দিলে যেদিন, সেদিন ভরা জোসনায় ছিল পূর্ণিমার রাত। বগুড়া পার হওয়ার পর রাতের অন্ধকার শুরু হত। নগরবাড়ীতে ফার্স্ট ফেরী ধরার জন্যে শা শা করে ছুটছে হিনো নাইট কোচ। পূর্ণিমার ভরা জোসনায় চারিদিকে ঝলমল করছে। বাসের জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস তোমার আমার চুল উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাসের ক্যাসেটে তখন বাজছে কিশোর কুমারের গান-
চিরদিনই তুমি যে আমার
যুগে যুগে আমি তোমারই
আমি আছি সেই যে তোমার
তুমি আছো সেই আমারই।
রুমকী, কি হয়েছে তোমার ? এই সব পুরোনো দিনরাত্রীর কথা বলে কি লাভ ? নাহিদ জিজ্ঞাসা করল রুমকীকে। রুমকী বলল, অতীতটাই এখন আমাদের সম্বল। এছাড়া আর কিইবা আছে আমাদের। নাইট কোচে সেদিনের রাতটি ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত। এক মুহূর্তের জন্যে তোমার হাতের মুঠোর বাইরে ছিলনা আমার হাত। রুমকীর গলায় ভাবাবেগ ছড়িয়ে পড়ছে। ফোনের এই প্রান্ত থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে নাহিদ।
এবার নাহিদই প্রসঙ্গ পাল্টাল। তুমি কি দেশের কোন খবর রাখছ ? কি হচ্ছে দেশে ? রুমকী বলল সব খবরই টিভি, নিউজ মিডিয়া আর ফেসবুক থেকে পাচ্ছি। লোড শেডিং, ভ্যাপসা গরম, বৃষ্টি, কাঁদায় হাঁসফাঁস করছে দেশের মানুষ। উর্ধমূল্যের নাভিশ্বাসে প্রচন্ড তাপদাহের চেয়েও নাস্তানাবুদ হচ্ছে দেশের মানুষ। সব খবরই রাখি। তবে অবাক হলাম, এত কিছুর পরেও সরকার অসতর্ক। নিউজ মিডিয়ায় যাচ্ছেতাই কান্ড হচ্ছে। সরকারের মন রক্ষায় এমন কিছু সংবাদ পরিবেশন করা হচ্ছে, আদতেই তার কোন বাস্তবতা নেই। এতে হিতে বিপরীত হচ্ছে। মানুষ সত্যতা গ্রহণ করে, মিথ্যা নয়। মানুষ বিভ্রান্ত পছন্দ করেনা। সত্য কেমনে জানি পাখা গজিয়ে উড়েবেড়ায়। মানুষ আসল সত্যটা দেঝতে পায়। মিথ্যাকে নয়।
রুমকী এর জবাবে শুধু একটি কথাই বলল, প্রতিকূলতার মুখে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। নিউজ মিডিয়ায় মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে কিন্তু এই সকল যুক্তি প্রতিষ্ঠার পিছনে সরকারের নৈতিক অবস্থান খুব দুর্বল করে ফেলছে। এভাবে নিউজ মিডিয়া মিথ্যাচার করতে থাকলে এর পরিণতি ভোগ করতে হবে সরকারকে। একটি মানুষ যখন নৈতিক অবস্থা হারিয়ে ফেলে তখন তার সত্য কথাটাও কেউ বিশ্বাস করতে চায়না। সরকার একদিন সত্য প্রকাশ করলেও তা আর কেউ বিশ্বাস করবে না। নৈতিক মূল্যবোধ বিবেচনায় মূল সমস্যা এখানেই।
রুমকী এ নিয়ে আরও কিছু বলতে শুরু করল। সে উদ্ধৃতি দিল দৈনিক মানব জমিন পত্রিকার। বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন উল্লেখ করে কোনো রায় দেয়নি কানাডার ফেডারেল কোর্ট। কানাডার আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট এমন কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ পায়নি যাতে প্রতীয়মান হয় যে, বিএনপি সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত কোনো সংগঠন। গত ১৫ই জুন কানাডার ফেডারেল কোর্ট এ রায় ঘোষণা করে।
মোহাম্মদ জিপসেদ ইবনে হক নামের একজন বিএনপি কর্মীর দায়ের করা মামলায় আদালত এ পর্যবেক্ষণ দেয়। আদালতের ওয়েবসাইটে ২৬ পৃষ্টার রায়টি এখনও পাওয়া যাচ্ছে।
এতে আরও বলা হয়, ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আবেদনকারী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপির সদস্য ছিলেন। প্রসঙ্গত এ রায়টি নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে নানা আলোচনা চলছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের অসংখ্য নিউজ মিডিয়া একটি সংবাদ পরিবেশন করেছে যে কানাডার ফেডারেল কোর্ট নাকি বলেছে বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল। কিন্তু বাস্তবে এধরণের কোন কথা কানাডার ফেডারেল কোর্ট বলেনি।
রুমকী এবার বিদায় নিতে চায়। রুমকী নাহিদকে বলল, কাল একটা ভিন্নধাঁচের চিঠি লিখব তোমাকে। নাহিদ বলল, ওকে। কিপ ইন টাচ। কল দিও,চিঠি দিও নিয়মিত।
লেখকঃ লুৎফর রহমান একজন রাজনীতিবিদ ও লেখক। তিনি নিয়মিত লেখালেখির পাশাপাশি ইলেক্ট্রনিক নিউজ মিডিয়ার সম্পাদক ও প্রকাশক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র লুৎফর রহমান ৮০ এর দশকের স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরতে দুটি রাজনৈতিক উপন্যাস লিখেছেন, যা দেশ বিদেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় জীবনের খন্ডচিত্র এঁকে তিনি এখন ব্যাপক পরিচিত।
কিউএনবি/নাহিদা/০৬.০৫.২০২৩/ দুপুর ১.৩৫