শনিবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ০২:১৭ অপরাহ্ন

অনিন্দ্য সুন্দর অনুভূতি : নাহিদ শারমীন

নাহিদ শারমীন, জর্জিয়া,ইউএসএ।
  • Update Time : মঙ্গলবার, ১ আগস্ট, ২০২৩
  • ৯৭৭ Time View

অনিন্দ্য সুন্দর অনুভূতি

—————————-

ফেব্রুয়ারি মাস,আমেরিকার ম্যাসেচুসেটস এষ্টেটস, শহরের নাম উষ্টার। পুরা শহরটা সেই সময় তুষার পাতের জন্য বরফে ঢেকে গেছে। আর কি যে কনকনে ঠান্ডা – হিমেল হাওয়া আর চারিদিকে শুধু সাদা আর সাদা। মনে পড়ে সময়টি ছিল, ঠিক ভ্যালেন্টাইনস ডে-র আগের দিন, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি।

আমার প্রসব বেদনা শুরু হলো মাঝ রাতে; তখনই হসপিটালে যেতে হলো। পার্কিং লট থেকে হাসপাতালে ঢোকা অনেক কষ্ট সাধ্য ব্যাপার ছিল। রাস্তা পিচ্ছিল ; আর শরীরের অবস্থা ভাল না, ব্যথায় একদম কাবু। সবাই আমাকে ধরা ধরি করে হুইল চেয়ারে করে হাসপাতালের ভিতরে নিয়ে গেল।

হাসপাতালে যেয়ে মনে হলো আমি সবে মাত্র ভালবাসার রাজ্যে প্রবেশ করেছি। চারিদিকে গোলাপী আর লাল বেলুন। আর সব জায়গায় ভালবাসার হার্ট সাইন। তার কারন ভ্যালেনটাইনস ডে যে ভালাবাসা দিবস।

ঠিক সে রাতেই আমার কোল জুরে এলো একটা ফুটফুটে পরীর মতন মেয়ে। সেদিন উষ্টার মেমোরিয়াল হাসপাতালে লিখা ছিল “শারমীন বেবী ব্রন টুডে”। বেবীটা ছিল – ভ্যলেনটাইন বেবী। এটা ছিল আমার প্রথম প্রসব বেদনা, আর প্রথম মা হওয়া। সব কষ্টের অবসান ঘটিয়ে আমার কোলে জুড়ে এলো ফুটফুটে একটা ফুলের দেশের পরী। আর আমি হলাম মা !!

আমার জীবন সেদিন পরিপূর্ন হলো। মেয়ে থেকে মা হলাম। এই ক্ষমতা আল্লাহ শুধু মেয়েদেরই দিয়েছেন। আমি মা, তবে অপেক্ষায় ছিলাম কবে “মা” ডাক শুনবো।

ইতোমধ্যে, দু বছর পার হয়ে গেল। চলে এলো আরেক এপ্রিল মাস, আমি তখন আমেরিকার জনস টাউন, পেনসিলভেনিয়া রাজ্য। সবে মাত্র বরফ গলে পানি নদীতে চলে যাচ্ছে, আর চারিদিকে তখন সবুজ সতেজ ঘাস। এক কথায় অপূর্ব ! পাহাড়ী শহর সবে মাত্র টিউলিপ, ডেফোডিল, হাইসিন ফুল ফোটা শুরু করেছে ফুলের বাল্ব থেকে। বসন্ত কাল এলে ফুল গুলো সবাইকে স্বাগতম জানায়। অন্যদিকে, চেরী ফুলে সারা শহর ভরে গেছে। সাদা, গোলাপী হরেক রকম রং এর ফুল।

আর হাইসিন ? আহা ! কি মিষ্টি গন্ধ, একেবারে নেশা ধরে যায়।

মাঝে মাঝে বসন্তের বাতাস দোলা দিয়ে জানিয়ে যায়, বসন্ত এসে গেছে। চারিদিকে নানান ধরনের পাখির কিচির মিচির শব্দ। আমার বাসার বেলকনিতে একটা পাখি এসে আমাকে প্রতিদিন গান শুনিয়ে যায়। প্রকৃতির প্রেমে আমি যখন মুগ্ধ তখন আমার সেই পরীর মতন ছোট্ট মেয়েটি, আমাকে কিছুক্ষন পর পর দৌড়ে এসে জরিয়ে ধরে বলে “মা” – কি যে মধুর লাগে শুনতে, আর কি আনন্দ। আনন্দে আমার শরীরে শিহরন চলে আসে। যখন শুনি, মা মা !!

অন্যদিকে এই সুন্দর সময়ে আমার দ্বিতীয় বার প্রসব বেদনা শুরু হলো। সেই পাহাড়ী শহরে আমার কোলে এল ফুটফুটে এক রাজপুত্র। আমি আবার মা হলাম দ্বিতীয়বার এবং শেষ বারের মতন। এখন আমাকে এই পৃথিবীতে দুজন মা ডাকে। এই ডাক কোন দিন পরিবর্তন হবে না। আমার বংশধররাও একদিন জানবে আমি তাঁদেরই মা। পৃথিবীর সকল মার কাছেই তার ছেলে মেয়েরা থাকে রাজপুত্র আর ফুল বাগানের পরী হয়ে। আমার কাছেও তাই।

ছেলে মেয়েরা এখন নিজেরাই নিজের পায়ে দাঁড়ানো, এখন তাদের চলা ফেরা করতে আর আমাকে লাগে না। যুগ পরিবর্তনের জন্য আমরা এখন তাদের উপর নির্ভর করি না। তাদের জগৎ তাদের আমাদেরটা আমাদের। দীর্ঘ পনেরটি বছর তাদের সাথে কাটালাম। ওদের সাথে খেলতাম, গান করতাম, ওরা ছিল আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু। মাঝে মাঝে নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে রাতের পর রাত জেগেছি। বিদেশে থাকার জন্য কোন সাহায্যকারী ছিল না। কোন অভিযোগ নেই এরজন্য। তবে এর মধ্যে একটু করে নিজেকেও গুছিয়ে নিচ্ছিলাম।

অবশেষে ছেলে মেয়ে দুটা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে চাকরী করা শুরু করলো। এখন ছেলে মেয়েরাও স্বাধীন আমিও স্বাধীন। আমিও চাকরী করি, ওরা আমাকে অনেক স্বাধীনতা দিয়েছে, চাকরী করি, সময় চলে যায়। এভাবে জীবন চলে জীবনের মতন। তবুও বাবা মার ভালবাসাতো একই।এই তো- সেদিন ঠিক বিকেল পাঁচটায় টেক্সট পেলাম, আমার মেয়ের কাছ থেকে, – Landed.

ছেলে মেয়ে দুজনই এসেছিল ঈদ করতে। এক সপ্তাহ থেকে দুজন ওদের গন্তব্যে চলে গেল। ছেলে চলে গেল ৩রা জুলাই , আর মেয়ে গেল পরের দিন। ৪ ঠা জুলাই ছিল আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস, তাই ওয়াশিংটন ডিসিতে ফায়ার ওয়ার্কস দেখবে দেখে ছেলে চলে গেল একদিন আগেই। আর মেয়ে থাকে সিয়াটল ওয়াশিংটন। দুজন দু প্রান্তে বসবাস। চাকরীর সুবাধে নতুন জীবনের তাগিদে ওরা থাকে আমেরিকার ব্যস্ততম শহরে।যেখানে আছে অনেক ফান। যেখানে জীবন আরো আনন্দ দায়ক। ওরা এখন আমার বাসায় আসে রিলাক্স করতে, বাংলা খাবার খেতে আর আমাদের দেখতে। কিছুদিন থেকে চলে যায়। ওরা চলে যাবার পর কেমন যেন লাগে। বুকের ভিতর কত কষ্ট জমাট বাঁধে।

মনে হয় এই তো সেদিনের কথা অথচ সময় কি তাড়াতাড়ি যায়। যে বাচ্চা গুলি সারাদিন আমার আশে পাশে থাকতো আজ ওরা কত বড় হয়ে গেছে। আমার আরো মনে পড়ে গেল, যখন আমি বাবা মার কাছে বেড়াতে দেশে যেতাম; তারপর কিছুদিন থেকে আমার সংসারে চলে আসতাম তখন আমার বাবা মার কেমন লাগতো ? সেই কষ্ট এখন আমি ফিরত পেয়েছি। এভাবে জীবন ঘুরতে থাকে ; এক জীবন থেকে আরেক জীবনে।

জুলাইয়ের চার তারিখ ছিল, আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস। এই তো এখনও চোখে ভাসে কয়েক বছর আগেও বাচ্চাদের নিয়ে ফায়ার-ওয়ার্স দেখতে যেতাম। একটা চাদর, কিছু খাবার আর দুটা চেয়ার নিয়ে চলে যেতাম। ওরা খেলা ধুলা করতো কনসার্ট দেখতো , কটন ক্যন্ডি খাবে বলে আবদার করতো। অবশেষে, অন্ধকার হয়ে এলে যখন ফায়ার ওয়ার্কস শুরু হতো; তখন ওরা দৌঁড়ে এসে গা ঘেসে আমার কাছে বসতো। অনেক সময় ফায়ার ওয়ার্কের শব্দে আমাকে জড়িয়ে ধরতো। কি সুন্দর সময় গুলো কাটতো। ইস! কেন যে সেই সময় গুলো ধরে রাখতে পারলাম না। সে সব এখন স্মৃতি।

সময় চলে যায় বহমান নদীর মতন আর স্মৃতি গুলো পড়ে থাকে শুকনো পাতার মতন। এ ভাবেই জীবন চলবে জীবনের মতন। সব কিছু ঘুরতে থাকবে এক জীবন থেকে আরেক জীবনে। আর স্মৃতির মনিকোঠার থেকে যখন মনে পড়বে তখন দুচোখ ভেঙে অশ্রু গড়িয়ে পড়বে। এরই নাম জীবন। অনিন্দ সুন্দর জীবন।

 

লেখিকাঃ নাহিদ শারমীন (রুমা) আমেরিকা প্রবাসিনী। আমেরিকার জর্জিয়া স্টেট্সকে এক টুকরো বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালান তিনি সব সময়। ব্যাংক অব আমেরিকা’র আইটি ডিভিশনে ব্যস্তময় কাজের ফাঁকে তাঁর মন ছুটে যায় বাংলাদেশে। নিয়মিত লেখালেখি করেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। সাহিত্য নির্ভর ফেসবুক পেজ ও গ্ৰুপের এডমিন তিনি। বাংলা লেখালেখি আর সাহিত্যচর্চার মাঝে তিনি জর্জিয়াকে বানিয়ে রেখেছেন ছোট একটি বাংলাদেশ।

 

 

কিউএনবি/বিপুল/৩১.০৭.২০২৩/রাত ১১.৪৫

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

October 2025
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit