কোকা-কোলা এবং আমার শৈশব
—————————————–
আমি বসবাস করি আমেরিকার জর্জিয়া স্টেটের এক সুন্দর শহরে। শহরটির নাম কলম্বাস। এই শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা বিশাল বড় একটা খরস্রোতা নদী। যার নাম চাটাহোচী নদী (Chattahoochee river) , নদীর উপরের একটা বড় ব্রীজ আছে সেটা খুব মনোমুগ্ধকর। শুধু হাঁটার জন্য এই ব্রীজটি কোন যানবাহন নেই। নদীটি অনেক খোরস্রোতা আর উথাল পাথাল বাতাস। কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলে ঢেউ এর খেলা দেখা যায়।
এখানে রাফটিং হয় তাই অনেক ঢেউ আর পাথর। মাঝে মাঝেই আমি ব্রীজটিতে হাঁটাহাঁটি করি আর আনমনে ফিরে যাই আমার শৈশবে । তখন আমি বেশ নষ্টালজিক হয়ে যাই। এটা আমার এক ধরনের দোষ, গুন বা দেশ প্রেম যাই বলি না কেন; আমার সব কিছু শেষ হয় বাংলাদেশ দিয়ে, যেখানে কেটেছে আমার শৈশব আর ফেলে আসা দিন গুলি।
এরকম একদিন হাঁটছিলাম নদীর পাশ দিয়ে। সেখানে দেখলাম, কিছু সাইন আছে ওখানে।মিষ্টার জন পেমবারটন নামে কিছু কথা লিখা। উনি হচ্ছেন বিশ্ববিখ্যাত পানীয় কোকা কোলার (Coca- Cola) প্রতিষ্ঠাতা। উনার কোকা কোলা বানানোর ইতিহাস, রোমাঞ্চিত হয়ে দেখলাম আর পড়লাম। এটা দেখে আমি আরো অবাক হলাম, ওনার কোকা কোলা যাএা শুরু আমার এই শহর কলম্বাস থেকেই।
মি: জন পেমবারটন একসময় আমেরিকার মিলেটারিতে ছিলেন। আর মিলেটারি বেইস, ফোর্ট বেনিং – আমার শহরে সেটা এখনও আছে। ১৮৬৩ সালে ওনার কনফেডারেট যুদ্ধে যাবার কথা ছিল। পরবর্তীতে ওনার পাকস্থলীতে একটা রোগ ধরা পরে। উনি তীব্র ব্যথার কারনে যুদ্ধে যেতে পারেননি । তখন মিষ্টার পেমবারটন ব্যথা কমানোর জন্য বহু পরীক্ষা নিরিক্ষার পর এক ধরনের পানীয় আবিষ্কার করলেন। আর সেটাই হচ্ছে এখানকার কোকা -কোলা বা কোক।
তবে সে সময়ের কোক আর এখনকার কোক এক না। তখন কোকে এলকোহল থাকতো ব্যথা কমানোর জন্য। অনেকে বলে কোকেন বা কোন ড্রাগ ও থাকতো। ওটা একটা ওষুধ হিসাবে গন্য করা হতো। সেই সময়ে কোক খুব জনপ্রিয় একটা পানীয় এবং ওষুধ হিসাবে পরিচিত হয়ে গেল। আরও জেনে অবাক হলাম উনি একজন ফার্মাসিস্ট ছিলেন।
এই কোক আবিষ্কারের পর মিষ্টার পেমবারটনের নাম সারা আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়লো। সে সময় কোকা কোলা পাকস্থলির ক্যানসার বা অন্য কোন ব্যথার জন্য সারা পৃথিবীতে ব্যবহার করা হতো। ওনার নাম এত ছড়িয়ে পড়লো তখন উনি ১৮৬৩ সালে ছোট শহর কলম্বাস ছেড়ে চলে যান বড় শহর আটলান্টা, জর্জিয়ার -ক্যাপিটাল এ। তারপর উনি সিদ্ধান্ত নেন ফারমাসিস্ট হয়ে চির জীবন কোক বানাবেন এবং মানুষের কল্যানে নিয়োজিত থাকবেন। যেহেতু উনি শারীরিক অসুস্হতার জন্য আর মিলেটারীতে থাকতে পারছেন না তাই কোকের মাধ্যমে সমাজ সেবাও হবে।
এ ভাবে চলছিল অনেক বছর তবে ১৮৮৫ সালে বিজ্ঞান অনেক এগিয়ে যাবার জন্য আইনের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হয়, কোকা কোলাতে আর এলকোহল মিশানো যাবে না। তখন এলকোহল মিশানো বাতিল করা হয় তারপর থেকে কোক বিবেচিত হয় তরল পানীয় হিসাবে।
আমেরিকার জর্জিয়া এষ্টেটের আটলান্টা শহরে এখনো নিদর্শন হিসাবে “ওয়ার্ল্ড অফ কোকা – কোলা মিউজিয়াম”, হিসাবে পরিচিত আছে। সেখানে প্রতি দিন অনেক দর্শনার্থীর সমাগম হয়।এসব পড়ছি আর ভাবছি, আমাদের শৈশবে কথা।
তখনই মনে পড়ে গেল আমাদের সেই ছেলে বেলার সেভেন- আপ আর কোকা কোলার কথা। আমরা যখন ছোট ছিলাম আজ থেকে চল্লিশ পয়তাল্লিশ বছর আগে তখন বাংলাদেশে এসব পানীয় খুব বিরল ছিল। এসব পানীয়, বিদেশী পানীয় হিসাবে গন্য করা হতো, দেশে বানানো হতো না। ঘরে ঘরে আনাও হতো না। তখন চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বড় বড় রেস্তোরা বা হোটেল আর নিউ মার্কেট, সিনেমা হল বা কিছু সীমিত দোকানে এসব পানীয় পাওয়া যেত।
মনে আছে, আমার মা শপিং করতে যখনই ঢাকা নিউ মার্কেট যেতেন তখন আমি যাবার জন্য রেডী থাকতাম। আমার যাবার একটাই কারন কোক খাব তখন আমি ক্লাস ফাইভ বা সিক্স পড়ি। তখন একটা কোকের বোতল ষ্ট্র দিয়ে ধরিয়ে দেয়া হতো। ওখানে বসেই শেষ করতে হবে। অর্ধেক খাবার পর আর শেষ করতে পারতাম না
তারপর যখন আরেকটু বড় হলাম তখন সিনেমা দেখতে গেলে বিরতির সময় কোক খেতাম। ১৯৮০ সালের আগে এসব পানীয় খুব উপরের লেভেলের পানীয় ছিল। পাওয়া যেত না তেমন, তবে খুঁজলে কেউ কেউ বের করে দিত।আরেকটা মজার স্মৃতি মনে পড়ে গেল। তখন জ্বর বা পেটের অসুখ হলে স্কুলে যেতাম না। আমি খুশী হতাম তখন কারন অসুস্হ হলে কিছু আলাদা আদর যত্ন পাওয়া যেতো। পেটের অসুখ হলে আরেকটা জিনিষ যোগ করা হতো তা হলো সেভেন-আপ এর একটা বোতল। সেটাই ছিল আমার প্রধান আকর্ষন।
বাসায় কাজ করা ছেলেকে বলা হতো দোকান থেকে সেভেন আপ আনতে ,ছোট চিকন সবুজ রং এর কাঁচের বোতল ছিল। খাওয়ার পরে বোতল টা ফিরত দিতে হবে। ছেলেটা সেভেন আপ আনতো সাথে একটা ষ্ট্র থাকতো। সেভেন আপ আনার পর আমার একটু সন্দেহ হতো। আমি জিজ্ঞেস করতাম ,”এটা অর্ধেক কেন” ? আর ষ্ট্র -টা একটু ভিজা মনে হতো।
আর ছেলেটা বলতো “আপা এখানে বাতাস থাকে খুললে উইড়া যায়”। বুঝতে পারতাম সেভেন-আপ এর কিছু অংশ খালি কেনো,বাকী অর্ধেক ওর পেটে। এখন মনে হলেও হাসি পায়। এসব ছোট্ট ছোট্ট কতকথায় জড়িয়ে আছে আমাদের শৈশব স্মৃতি , অনেক সুন্দর স্মৃতি ,আমাদের আনন্দ বেদনার কাব্য।
এখন কোক বা সেভেন আপ কেউ সেধে দিলেও খাই না। যখন কোন কিছু সীমানার বাহিরে থাকে তখন পাবার আকাংখা অনেক বেশী থাকে কিন্তু যখন সীমানার মধ্য চলে আসে তখন আর শখ থাকে না। তবে মধুর স্মৃতি গুলো সারা জীবন তাড়া করে বেড়ায় নিজেদের মনের মধ্যে !!!
থাকুক না বেঁচে এসব স্মৃতি যতদিন আমরা বেঁচে থাকি।
লেখিকাঃ নাহিদ শারমীন (রুমা) আমেরিকা প্রবাসিনী। আমেরিকার জর্জিয়া স্টেট্সকে এক টুকরো বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালান তিনি সব সময়। ব্যাংক অব আমেরিকা’র আইটি ডিভিশনে ব্যস্তময় কাজের ফাঁকে তাঁর মন ছুটে যায় বাংলাদেশে। নিয়মিত লেখালেখি করেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। সাহিত্য নির্ভর ফেসবুক পেজ ও গ্ৰুপের এডমিন তিনি। বাংলা লেখালেখি আর সাহিত্যচর্চার মাঝে তিনি জর্জিয়াকে বানিয়ে রেখেছেন ছোট একটি বাংলাদেশ।
কিউএনবি/বিপুল/১১.০৭.২০২৩/রাত ৯.৫৪