ডেস্ক নিউজ : দাওয়াত ও তাবলিগের নামে সারা বিশ্বে যে ঈমানি আন্দোলন চলছে তার তাত্ত্বিক ভিত্তি ‘ছয় উসুল/ছয় ছিফত/ছয় গুণ’। আর তা অর্জন করতে পাঁচ কাজ করা সংশ্লিষ্ট সাথিদের জন্য জরুরি। আর ইজতেমায়িভাবে (একত্রে/সামষ্টিকভাবে) পালনীয় তাবলিগের আরো আটটি কাজ আছে। সুতরাং ছয় উসুল, মসজিদভিত্তিক পাঁচ কাজ ও ইজতেমায়ি আট আমল—এগুলোর আলোকে তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। আর তাবলিগ জামাতে এসব আমল ব্যাখ্যাসহ শেখানো ও মুখস্থ করানো হয়। এখানে সংক্ষেপে তাবলিগ জামাতের মূল কাজগুলো উল্লেখ করা হলো—
ছয় ছিফত (গুণ/মূলনীতি) হলো : ১. ঈমান/কালেমা, ২. নামাজ, ৩. এলেম/ইলম ও জিকির, ৪. একরামুল মুসলিমিন, ৫. এখলাসে নিয়ত/তাসহিহে নিয়ত, ৬. দাওয়াত ও তাবলিগ। এই ছয় নীতির ভূমিকাস্বরূপ বলা হয়ে থাকে—‘আমাদের নবী মোহাম্মদ (সা.)-এর সাহাবিরা নানা গুণে গুণান্বিত ছিলেন। তাঁরা নবী (সা.)-এর সুহবতে (সাহচর্য) থেকে এ গুণগুলো অর্জন করেছিলেন। এ গুণগুলোর কারণেই তাঁদের দ্বিনের ওপর চলা সহজ হয়ে গিয়েছিল। আজকের দিনেও কেউ যদি এ ছিফত বা গুণগুলো অর্জন করার চেষ্টা করে তাহলে দ্বিনের ওপর চলা তাঁর জন্যও সহজ হয়ে যাবে। গুণগুলো অর্জন করার জন্য তাঁকে মেহনত করে তা আমল করতে হবে। বস্তুত মেহনত ছাড়া এ দুনিয়ায় কোনো কিছু অর্জন করা সম্ভব হয় না।’
ছয়টি ছিফতের ওপর মেহনত করে আমল করার জন্য তাবলিগ জামাত বিশেষভাবে তাগিদ দেয়। বলা হয়, ‘কেউ এ বিষয়ের জন্য আল্লাহর রাস্তায় বের হয়ে মেহনত করলে দ্বিনের ওপর চলা তার জন্য সহজ হয়। এ জন্য জীবনে প্রথম তিন চিল্লা (চার মাস) একটানা সময় লাগিয়ে কাজটি শিখবে। এরপর প্রতিবছর ৪০ দিন (এক চিল্লা) লাগিয়ে সে নিজেকে সক্রিয় রাখবে। দ্বিনের ওপর চলা সহজ নয়। এ ছিফতগুলো মেহনত করে আমল করে চলতে পারলে দ্বিনের ওপর চলা সহজ হয়।’
অন্যদিকে এ ছিফতগুলো নিজের মধ্যে ঠিকঠাক রাখার জন্য নিয়মিত পাঁচটি কাজের মধ্যে থাকতে হয়। কাজগুলো হলো : ১. প্রতিদিন মাশওয়ারা (পরামর্শ করে চলা) ২. প্রতিদিন তালিম, একটি নিজের মহল্লা বা পাড়ার মসজিদে, অন্যটি নিজের ঘরে ৩. প্রতিদিন আড়াই ঘণ্টা দাওয়াতের কাজে মেহনত ৪. সপ্তাহে গাশত করা, এক দিন নিজের মসজিদে, আরেক দিন পাশের পাড়ার বা মহল্লার মসজিদে ৫. প্রতি মাসে তিন দিন আল্লাহর রাস্তায় (তাবলিগে) বের হয়ে মেহনত করা।
আর তাবলিগ জামাতের ইজতেমায়ি আট আমল হলো—১. সফর ও মঞ্জিল। ২. মাশওয়ারা (পরামর্শ)। ৩. তালিম (দ্বিন শেখা)। ৪. গাশত (দ্বিনের কাজে ঘোরাফেরা বা মসজিদের বাইরে গিয়ে অন্যকে দাওয়াত দেওয়া)। ৫. ফরজ নামাজ। ৬. খানা (সম্মিলিতভাবে খাবার খাওয়া)। ৭. ঘুম। ৮. উমুমি বয়ান (ব্যাপকভাবে আলোচনা/মাগরিব ও ফজরের পর সাধারণ বয়ান)।
দাওয়াত ও তাবলিগের উদ্দেশ্য
১. হজরতজি ইলিয়াস (রহ.) বলেন, ‘আমি এই তাহরিকের (ঈমানি আন্দোলন) মাধ্যমে প্রত্যেক জায়গায় উলামায়ে কেরাম ও বুজুর্গানে দ্বিন এবং দুনিয়াদারদের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধন, মিল-মহব্বত ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি সৃষ্টি করতে চাই। (মালফুজাত : মালফুজ নম্বর ১০২)
২. হজরতজি ইলিয়াস (রহ.) বলেন, ‘আমাদের এই তাবলিগি মেহনত ব্যাপকভাবে দ্বিনি তালিম ও তরবিয়ত বিস্তার করা এবং ব্যাপকভাবে দ্বিনি জীবন গঠন করার মেহনত। আর এর উসুল (মূলনীতি) যথাযথভাবে পালন করার মধ্যেই কামিয়াবি ও সফলতা নিহিত। আর এই মেহনতের গুরুত্বপূর্ণ একটি উসুল (মূলনীতি) হলো, মুসলমানদের যে শ্রেণি-পেশার জন্য আল্লাহ তাআলা যে হক (মর্যাদা ও অধিকার) রেখেছেন সেগুলোকে আদায় করে তার সামনে এই দাওয়াত পেশ করা। মুসলমানদের তিনটি স্তর আছে : (এক) হতদরিদ্র শ্রেণি। (দুই) উন্নত শ্রেণি (ইজ্জতওয়ালা কিংবা ধনী)। (তিন) উলামায়ে দ্বিন।
তাদের সঙ্গে যে আচরণ করতে হবে তা একত্রে এই হাদিসের মধ্যে উল্লেখ আছে : ‘যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের স্নেহ করল না, বড়দের সম্মান করল না এবং উলামায়ে কেরামের ইজ্জত করল না সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (মালফুজাত : মালফুজ নম্বর : ১৩৫)
৩. হজরতজি ইলিয়াস (রহ.) বলেন, ‘তাবলিগি কাজের একটি উসুল (মূলনীতি) হলো, স্বাধীনভাবে নিজের মনমতো না চলা; বরং নিজেকে ওই সব বুজুর্গের পরামর্শ অনুযায়ী পরিচালনা করা—যাদের ওপর দ্বিনি বিষয়ে আমাদের পূর্ববর্তী আকাবির (শীর্ষস্থানীয় মুরব্বি) হজরতরা আস্থা রেখে গেছেন এবং আল্লাহ তাআলার সঙ্গে যাদের খাস সম্পর্কের ব্যাপারটি পরিজ্ঞাত ও সর্বস্বীকৃত। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পর সাহাবায়ে কেরামের সাধারণ নিয়ম এই ছিল যে নবীজি (সা.) যাদের ওপর বেশি আস্থা রেখেছিলেন তারাও তাদের ওপর বেশি আস্থা রাখতেন। পরবর্তী যুগে বেশি আস্থার পাত্র ছিলেন ওই সব বুজুর্গানে দ্বিন, যাদের ওপর আবু বকর (রা.) ও ওমর (রা.) আস্থা রেখেছিলেন।’
এরপর হজরতজি (রহ.) বলেন, ‘দ্বিনের কাজে আস্থাশীল ব্যক্তি নির্বাচন করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা জরুরি। অন্যথায় অনেক বড় ধরনের গোমরাহির আশঙ্কা আছে।’ (মালফুজাত : মালফুজ নম্বর ১৪৩)
৪. আমাদের তাবলিগি কাজের সাথিদের তিন শ্রেণির লোকদের কাছে তিন উদ্দেশ্যে বিশেষভাবে যাওয়া উচিত :
(এক) উলামায়ে কেরাম ও বুজুর্গানে দ্বিনের খেদমতে গিয়ে দ্বিন শেখা ও দ্বিনের ভালো প্রভাব গ্রহণ করা।
(দুই) নিজের চেয়ে নিম্ন শ্রেণির লোকদের মধ্যে দ্বিনি কথাবার্তা প্রচার করে নিজের দ্বিনের মধ্যে মজবুতি (দৃঢ়তা) অর্জন করা এবং নিজের দ্বিনকে পরিপূর্ণ করা।
(তিন) বিভিন্ন শ্রেণির লোকদের কাছ থেকে তাদের ভালো গুণাবলি গ্রহণ করা। (মালফুজাত : মালফুজ নম্বর : ৮৬)
[তথ্যঋণ : ড. মুহাম্মদ আবদুল হাননান, দাওয়াত ও তাবলিগ ইতিহাস ও ঐতিহ্য, বিশ্বসাহিত্য ভবন, ৩৮/৪ বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ : নভেম্বর ২০১৮]
কিউএনবি/আয়শা/১৫ জানুয়ারী ২০২৩/বিকাল ৪:০৫