রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫, ০৮:০৬ অপরাহ্ন

বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার আগেই বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ নীতি ঠিক করেছিলেন

Reporter Name
  • Update Time : মঙ্গলবার, ১০ জানুয়ারী, ২০২৩
  • ১১৩ Time View

ডেস্ক নিউজ : বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তবে, সংরক্ষিত নথিপত্র থেকে জানা যায়, স্বাধীন মাতৃভূমিতে পা রাখার আগেই তিনি সদ্য স্বাধীন দেশের জন্যে কয়েকটি দেশের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনায় নিয়ে পররাষ্ট্র নীতি ঠিক করে ফেলেন।

বন্দীদশা থেকে মুক্তির পর পাকিস্তান কতৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুকে  লন্ডনে পাঠায় এবং পরে ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ার ফোর্সের একটি  জেট বিমানে করে ঢাকার পথে সাইপ্রাস ও ওমান হয়ে তিনি নয়াদিল্লী যান।

নথিপত্র ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, রাওয়াল পিন্ডি থেকে ঢাকায় ফেরার সময়ে তিনি ভারত, ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানকে সম্পৃক্ত করে তাঁর নীতিমালার চাহিদারগুলো স্পষ্ট করেছিলেন।

ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার
লন্ডনে ১৯৭১-৭২ সালে দায়িত্বরত ভারতের সাবেক কূটনীতিক শশাঙ্ক ব্যানার্জী ১৯৬০ এর দশকের প্রথম দিক থেকে বঙ্গবন্ধুকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন, নয়া দিল্লীগামী ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ার ফোর্সের বিমানে তিনিও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন।  

বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী ব্যানার্জীর সঙ্গে টেলিফোনে বাসসের সাংবাদিকের সংক্ষেপে এ বিষয়ে কথা বলার পর তিনি তার স্মৃতিকথায় এই ব্যাপারে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে বলে জানান।

তিনি বলেন, আরএএফ কমেট জেটে মুুজিবের সঙ্গে ১৩ ঘন্টার ওড়ার সুযোগ …আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয় হয়ে উঠেছে।’

ব্যানার্জী বলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর পাশের আসনে বসার সুযোগ পেয়েছিলেন, ভিআইপি ফ্লাইটের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তাদের জোড়া আসনের সামনে একটি টেবিল ছিল যেখানে বাংলাদেশের স্থপতি তাঁর ধূমপানের পাইপ ও প্রিয় এরিনমোর তামাক বক্স রেখেছিলেন।

এই কূটনীতিক স্মরণ করে বলেন, প্রাথমিক কিছু কথাবার্তা ও কমলার জুস পান করার পর বঙ্গবন্ধু কছুটা নিশ্চুপ ও চিন্তামগ্ন হয়ে পড়েন এবং বলেন ব্যানার্জী যদি তার জন্যে একটি ‘বড়ো উপকার’ করতেন যাকে তিনি ‘আগাম ভিত্তিমূলক কাজ’ বলে বর্ণনা করেন।

ব্যানার্জী স্মরণ করে বলেন, তাঁর আচরণে কোন দ্বিধা ছিল না এবং তিনি বঙ্গবন্ধুকে ইতিবাচক জবাব দেয়ায় তিনি তাকে দিল্লীতে পৌঁছানোর সাথে সাথে তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত বার্তা মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে দেয়ার কথা বলেন যাকে তিনি ‘আগাম ভিত্তিমূলক কাজ’ বলে উল্লেখ করেন।

ব্যানার্জী লিখেছেন, তিনি চাচ্ছিলেন দিল্লী বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর আমি  প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে যোগাযোগ করি এবং আগামী তিনমাস অর্থাৎ, ৩১ মার্চ ১৯৭২-এর মধ্যে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়টি বিবেচনার জন্য তাঁর বার্তাটি মিসেস গান্ধীকে জানাই।  

এই কূটনীতিক স্বীকার করেন দিল্লীতে পৌঁছানোর পর উদযাপনের এমন পরিবেশে তিনি শীগগিরই এই বার্তা ইন্দিরার কানে তুলতে পারবেন কিনা এই ভেবে প্রথমে ভীত হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু প্রথমেই এ কথা জানানোর জন্যে তিনি টারমাকে ইন্দিরা গান্ধীর অন্যতম একজন শীর্ষ উপদেষ্টা ডিপি ধরকে দেখতে পান।

ব্যানার্জী তাকে জানান, বঙ্গবন্ধু গান্ধীর সঙ্গে তাদের শীর্ষ বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপন করবেন এবং আমি দৃঢ়তার সাথে ধরকে জানাই মুজিব বিষয়টিকে প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করবে এবং এমনকি তিনি বিষয়টি লিটমাস টেস্ট হিসেবেও বিবেচনা করতে পারেন।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু ঠিক কি বলেছিলেন তা জানানোর জন্যে ধর তাকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন।

ব্যানার্জী বলেন, মুজিব বস্তুত বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন। মিসেস গান্ধী তাকে তার চুক্তির কথা জানিয়েছিলেন যে শেখ সাহেবের অনুরোধ অনুযায়ী ৩১ মার্চ ১৯৭২ সালের মধ্যে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশের মাটি থেকে প্রত্যাহার করা হবে।

স্বীকৃতি ইস্যু
এশিয়ান অ্যাফেয়ার্স সম্পাদক এবং বিবিসির সাবেক সাংবাদিক ডানকান বার্টলেটের প্রকাশিত নিবন্ধ অনুযায়ী ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু লন্ডনে পৌঁছালে ব্রিটিশ কতৃপক্ষ অবাক হয়ে যায়।

বার্টলেট লেখেন, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ তখন ছুটিতে ছিলেন। তবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে অপ্রত্যাশিত এই ভিজিটর এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে তিনি তার ছুটি বাতিল করেন এবং ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে দ্রুতই আলোচনার আয়োজন করেন। সে সন্ধ্যাতেই আলোচনাটি অনুষ্ঠিত হয়।

বার্টলেট বলেছেন, হিথের সাথে বঙ্গবন্ধুর বৈঠকটি বিশেষভাবে দীর্ঘ ছিল না তবে আমরা জানি কিছু বিশদ আলোচনা হয়েছিল।

ব্রিটিশ সাংবাদিক উল্লেখ করেন, ওই সকল সূত্র থেকে আমরা জানতে পেরেছি মুজিব কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুরোধ করেছিলেন, যার অধিকাংশ দ্রুতই গ্রহণ করা হয়েছিল।

বার্টলেট বলেন, তাঁর প্রথম অনুরোধ ছিল, স্বাধীনতা যুদ্ধে সাফল্যের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে ব্রিটেনের স্বীকৃতি।

বার্টলেট উল্লেখ করেন, বৈঠকের এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বিট্রেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। আর বিট্রেনের এ উদ্যোগ অন্যান্য কমনওয়েলথ ও পশ্চিমা দেশগুলোকে এ কাজে উৎসাহিত করেছিল।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের রেকর্ড অনুসারে, হিথ নিজেই পরে হাউস অব কমেন্সে ভাষণ দেয়ার সময়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে তার বৈঠকের বিস্তারিত জানিয়েছিলেন।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে শেখ মুজিব আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে আমি তাকে বুঝিয়েছিলাম আমাদের নীতি হল ভারতীয় উপমহাদেশের তিনটি দেশের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করা।

হিথ আরো বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা বাংলাদেশকে সর্বাত্মক সহযোগিতার চেষ্টা করবো।

যুক্তরাষ্ট্রকে যুক্ত করার দাবি 
বার্টলেট বলেন, ব্রিটেনের কাছে বাংলাদেশী নেতার অপর উল্লেখযোগ্য দাবি ছিল যে আমেরিকানদের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য যুক্তরাজ্যকে চাপ দিতে হবে।

ব্রিটিশ ওই সাংবাদিক আরো উল্লেখ করেন, যদিও এখনকার মতো তখনও যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল, তবু, এটি খুব কঠিন দাবি ছিল। কারণ, মার্কিন প্রশাসন মুক্তিযুদ্ধকালে পশ্চিম পাকিস্তানের পাশে আন্তরিকভাবেই ছিল।

কিন্তু তিনি বলেন, বাংলাদেশের নেতার অনুরোধের প্রেক্ষিতে হিথ মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে চিঠি লিখেছিলেন, যা কেবলমাত্র বাংলাদেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকার স্বীকৃতিই নয় ‘একই কাজ করতে পাকিস্তানের নতুন নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকেও রাজি করাতে সাহায্য করেছিল।’

বার্টলেট বলেন, আমেরিকা ১৯৭২ সালের বসন্তে বাংলাদেশকে যথাযথভাবে স্বীকৃতির প্রস্তাব দিয়েছিল এবং পাকিস্তান তা করেছিল ১৯৭৪ সালে।

বার্টলেট অবশ্য উল্লেখ করেন, বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি প্রাথমিকভাবে ব্রিটিশ কিংবা আমেরিকান প্রভাবের কারণে হয়নি, মূলত এটি হয়েছে মুসলিম দেশগুলোর ব্যাপক চাপের প্রভাবে।

পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যে যে কোন আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক বাতিল
বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে রেসকোর্স ময়দানে তার প্রথম ভাষণে বলেছিলেন, ভুট্টো তাকে পাকিস্তানের সাথে একটি শিথিল ফেডারেশনের মধ্যেও বাংলাদেশকে রাখার সুযোগ বিবেচনা করতে বলেছিলেন।

বাংলাদেশের নেতা সেই ঐতিহাসিক দিনের ভাষণে এমন সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু, নিজের দেশে পা রাখার আগেই তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন।

নিক্সনকে লেখা হিথের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, আমার সাথে তার (বঙ্গবন্ধু) আলোচনায় তিনি পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে যে কোন আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নাকচ করে দিয়েছিলেন।

হিথ উল্লেখ করেন, ভুট্টোকে বাংলাদেশের স্বীকৃতির অনিবার্যতা মেনে নিতে আপনি (নিক্সন) যা কিছু করতে পারেন তা সবচেয়ে সহায়ক হবে।
বার্টলেট স্মরণ করেন, দেশে ফেরার আগে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা লন্ডনের ক্লারিজেস হোটেলে একটি সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন এবং সুপরিচিত টিভি উপস্থাপক ডেবিড ফ্রস্টসহ বেশকিছু টিভিতে সাক্ষাতকারও দিয়েছিলেন।

তিনি লিখেছেন, স্বভাবতই তাকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন করা হয়েছিল। তবে, এ সম্পর্কে তাঁর ধারণা খুব সীমিত ছিল কারণ তাঁকে লন্ডন আসার আগ পর্যন্ত পাকিস্তানের নির্জন কারাগারে রাখা হয়েছিল।

বার্টলেট আরো বলেন, তা সত্ত্বেও তিনি সংবামাধ্যমকে বিমোহিত করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয়েছিল এবং এটি আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে এডওয়ার্ড হিথকে রাজি করানোর একটি কারণ হতে পারে।- বাসস

কিউএনবি/অনিমা/ ১০.০১.২০২৩/বিকাল ৩.২৫

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

July 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit