বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৪১ অপরাহ্ন

রিয়ার ফাঁদে মানুষ কাঁদে

Reporter Name
  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২২
  • ৯৩ Time View

ডেস্ক নিউজ : আরবি ‘রিয়া’ মানে হলো প্রদর্শন করা বা অন্যকে দেখিয়ে বেড়ানো। ইংরেজি শোডাউন বা শো অফ শব্দে রিয়ার ভাব চমৎকারভাবে ফুটে ওঠে। মানুষ দেখুক, মানুষের নজরে আসুক, লোকে ভালো বলুক, এমনকি আমার ভালো কাজ দেখে মানুষ উৎসাহিত হোক- এ ধরনের মনোভাব নিয়ে কাজ করাই রিয়া। রিয়া সম্পর্কে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের জন্য যেসব বিষয় আমি সবচেয়ে বেশি ভয় করি সেগুলোর মধ্যে রিয়া ও গোপন খাহেশ অন্যতম।’ (এহইয়াউ উলুমুদ্দিন।) অন্য বর্ণনায় এসেছে, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মত বড় শিরকে লিপ্ত হয়ে পড়বে সে ভয় আমি করি না। আমার ভয় হলো আমার উম্মত সূক্ষ্ম শিরকে জড়িয়ে পড়বে। সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রসুল! সূক্ষ্ম শিরক কী? রসুল (সা.) বললেন, সেটা হলো রিয়া। মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে বা মানুষের নজরে আসার জন্য ইবাদত করা।’ (বুখারি শরিফ।)

রিয়ার আলোচনায় ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেন, রিয়া এতই সূক্ষ্ম শিরক যে, সিদ্দিক স্তরের ব্যক্তি ছাড়া আর কেউই এর ক্ষতি থেকে বাঁচতে পারে না। তিনি এ কথাও লিখেছেন- রিয়ার শিকার সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আলেম-উলামারা বেশি হয়ে থাকে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ইমাম গাজ্জালি বলেন, একজন আলেমের নফস সাধারণ মানুষের মতো নয়। আলেম মানুষ নামাজ-রোজা, মোরাকাবা-মোশাহাদা করার মাধ্যমে নিজেকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছেন, চাইলেও তিনি আর বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে কোনো বদ আমল করতে পারবেন না। যেহেতু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গুনাহ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পেরেছে এবার নফস তাকে আরও সূক্ষ্ম ধোঁকা দেওয়ার জন্য রিয়া তথা খ্যাতির মোহ জাগিয়ে দেয়। বহু শায়েখ ও বুজুর্গ নফসের এ ধোঁকায় পড়ে দুনিয়া ও আখেরাত নিঃস্ব করে ফেলেছেন। দার্শনিক গুরু গাজ্জালি রিয়া সম্পর্কে আরও বিস্তারিত আলোচনা করে বলেন, এ ধরনের মানুষের যেহেতু বাহ্যিকভাবে গুনাহর পথ বন্ধ হয়ে গেছে বা নিজ থেকেই গুনাহ করা ছেড়ে দিয়েছেন, ফলে লোকসমাজে তার ইবাদত ও সুন্দর চরিত্রের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ তাকে দেখলে বলে, একজন আল্লাহর অলি এসেছেন। তাকে দাওয়াত করে খাওয়ায়। হাদিয়া দেয়। মাহফিলে প্রধান বক্তা রাখে। তার সঙ্গে মোনাজাতে শরিক হলে দোয়া কবুল হয়েছে বলে বিশ্বাস করে। তার জন্য মসজিদের সামনের কাতারে জায়গা রাখা হয় ইত্যাদি। নফস যখন দেখে ইবাদত বন্দেগির ফলে মানুষ তাকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করছে, মর্যাদার চোখে দেখছে এতে নফস আনন্দ অনুভব করে। এ আনন্দ অনুভূতি বা ভালোলাগার কারণে নফস ইবাদতের প্রতি আরও আগ্রহী হয় এবং ওই ব্যক্তি তখন আরও বেশি বেশি তাহাজ্জুদ ও নফল রোজা করতে থাকে। ইমাম গাজ্জালি বলেছেন, গভীরভাবে ভাবলেই বোঝা যায়, এ ধরনের মানুষের ইবাদত আসলে আল্লাহতায়ালাকে সন্তুষ্টি করার জন্য নয়। যদিও শুরুর দিকে তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই ইবাদত করছিল কিন্তু মাঝপথে এসে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ তাদের ইবাদতের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে পড়ে। ফলে ইবাদতের মোড়কে তারা প্রতিনিয়ত শিরকে লিপ্ত হতে থাকে। যেহেতু বিষয়টি খুবই সূক্ষ্ম এবং মানুষের ভালো বলা থেকে নিজেকে বিরত রাখা ব্যক্তির জন্য খুবই কঠিন কাজ তাই নবীজি এ ধরনের রিয়াকে উম্মতের জন্য বেশি ভয় করতেন। হে আমার দরদী পাঠক আমি বলছি না যে সবাই এ রিয়ার ফাঁদে আটকা পড়ে যায় বরং আল্লাহ যাকে চান তাকে হেফাজত করেন।

হজরত আলী (রা.) এর একটি বর্ণনা থেকে জানা যায়, কেয়ামতের দিন একদল মানুষকে আল্লাহতায়ালা ডাক দিয়ে বলবেন, তোমাদের জন্য জাহান্নাম। তারা হতবাক হয়ে জানতে চাইবে, হে আল্লাহ! আমাদের জীবনই কাটিয়ে দিয়েছি ইলম সাধনায়, বিনিময়ে আমরা কেন জাহান্নামি হলাম। জবাবে আল্লাহ বলবেন, তোমরা আলেম হওয়ার কারণে মানুষ থেকে নানান সুবিধা কি নাওনি? অমুক দোকানদার কি তোমার থেকে পয়সা কম রাখেনি? অমুক শিল্পপতি কি তোমাকে হাদিয়া তোহফা দেয়নি? মানুষ কি তোমাকে ধন্য ধন্য করেনি? তোমার ইলমের যে প্রাপ্য ছিল সেগুলো তো দুনিয়াতেই পেয়ে গেছ, আখেরাতের জন্য কিছুই রাখনি। সুতরাং তোমাদের জন্য আজ জাহান্নাম ছাড়া কিছুই নেই। (কিমিয়ায়েসাআদাত।) সহি মুসলিমের একটি হাদিসে এসেছে, হাদিসটি বর্ণনা করতে গিয়ে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) তিনবার অজ্ঞান হয়ে পড়েন। চতুর্থবারে তিনি বলেন, হাদিসটির কথাগুলো এত ভয়াবহ যে নিজেকে স্থির রাখা মুশকিল। রসুল (সা.) বলেছেন, কেয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা একজন কারিকে ডেকে বলবেন, তুমি জাহান্নামে যাও। কারি বলবেন, আমি সারা জীবন কোরআন তেলাওয়াত করে মানুষকে আল্লাহর পথে ডেকেছি। আল্লাহ বলবেন, তোমার তেলাওয়াতের উদ্দেশ্য ছিল মানুষ তোমাকে সেরা কারি বলবে। মানুষ তোমাকে তা বলেছেও। তোমার প্রত্যাশা ছিল মানুষের কাছে, তুমি তা পেয়ে গেছ। আমার কাছে কোনো প্রত্যাশাই তোমার ছিল না। তাই আজ জাহান্নাম ছাড়া তোমার জন্য অন্য কিছু রাখিনি। এরপর আল্লাহ শহীদ, দানবীর এবং আলেমকে ডেকে আলাদা আলাদা করে বলবেন, তুমি শহীদ হয়েছ মানুষের মুখে মুখে তোমার নাম স্মরণীয় রাখার জন্য, তুমি দান করেছ মানুষের কাছে দানবীর খেতাব পাওয়ার জন্য। আলেমকে বলবে তুমি ইলম শিখেছ মানুষের বাহবা পাওয়ার জন্য। তোমরা আমার কাছে কোনো প্রত্যাশা করনি।  সুতরাং আজ তোমরা জাহান্নামে যাও। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের রিয়া ও খ্যাতির মোহ থেকে হেফাজত করুন। আমিন।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর

কিউএনবি/অনিমা/২৪ নভেম্বর ২০২২,খ্রিস্টাব্দ/সন্ধ্যা ৬:৪৩

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

October 2025
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit