তিন পুরুষ তিন বাবা
————————
আমার জন্ম থেকে এই বত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত আমার এই বেঁচে থাকার পেছনে দাদীর পরে যেই তিন পুরুষের অবদানে বেঁচে আছি তারা হলেন আমার দাদা, বাবা, মেজো কাকা। যাদেরকে আমি একদিনের জন্যও ভুলে যাযইনি। আমার অবশ্য আরো একজন কাকা আছেন, তবে একটা কথা আছে না!, “ভাই বড় ধন রক্তের বাধন, যদি হয় পৃথক, নাড়ীর কারন” সেই কথা আর নাইবা বললাম।
আমার দাদা:
জন্মের পর প্রথম হিরো দাদা : দাদাকে আমরা ভাইয়া বলে ডাকতাম।
খুব ছোট্ট বেলায় যখন সন্ধ্যে হতো, হারিকেন হাতে মাগরিব কিংবা এশার আযানের পর আমার দাদীর সাথে বটতলী (আমাদের স্টেশন) যেতাম আমার দাদাকে এগিয়ে আনতে। কারণ তখনো আমাদের এলাকায় ইলেকট্রিসিটি পৌঁছায়নি। প্রতিদিন বিকেল হলেই ভাবতাম,কখন রাত হবে আর আমরা দাদা ভাইকে এগিয়ে আনতে বটতলায় যাবো। মাঝে মধ্যে তো মাটিতে গড়াগড়ি করে কান্না করতাম দাদা ভাইয়াকে এগিয়ে আনতে দেরি হলে।
এই অপেক্ষার পেছনে অবশ্যই আমার একটা লোভ কাজ করতো, আর তা হচ্ছে দাদাভাই আসার সময় মুড়ির মোয়া নয়তো বাদাম নয়তো বা বাতাসা অথবা কদমা নিয়ে আসতো। আমার দাদা ভাই কৃষি কাজের পাশাপাশি সিজনাল ব্যাবসা করত। সেই সুবাদে পায়ে হেঁটে অনেক দূর দুরান্তের হাটবাজারে যেত, আসতে আসতে সেই রাত অথবা গভীর রাত। আমি যে দাদাভাইয়ের জন্য অপেক্ষায় অস্থির থাকতাম তা কিন্তু শুধু মায়ায় বা ভালোবাসায় না, আমার নিজের লাভেই অপেক্ষা করতাম, বাতাসা, কদমা, বাদামি আর মুড়ির মোয়ার জন্য। আমার জানামতে কোনদিন দাদাভাই খালি হাতে বাড়ি ফেরেনি।
আমি জন্মের পরদিন থেকে দাদা ভাই আর দাদীর সাথে ঘুমিয়েছি। আমার বুঝে উঠার পর কখনোই আমার দাদা দাদী একসাথে ঘুমাতে পারেনি । আমি সবসময় মাঝখানে ঘুমাতাম। যদি কোনদিন ঘুম ভেংগে দেখতাম যে আমি দুইজনের মাঝখানে নেই, তাইলেই সেরেছে, সেই রাতে কেউ আর ঘুমাতে পারত না। কেনো আমি দুজনের মাঝখানে নাই। আমাকে কেন সাইডে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। এই দুঃখে সারারাত আমার বেধুম চিৎকার। আমার জন্য কতো শত রাত যে আমার দাদা দাদী না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে তার কোন হিসাব নেই। আমার একটু জ্বর হলে, একটু পেটে ব্যাথা হলে, একটু ঠান্ডা লাগলে সারারাত আর উনারা আর ঘুমাতেন না।
আমার জন্মের দুই তিন বছর পর ই বাবুর জন্ম। যখন দেখলাম যে বাবু হওয়ার পর আমার দাদীর আদর একটু আমার প্রতি কমে গেছে তখন দাদাই ছিলো আমার সব। আমাকে গোসল করানো, খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, মসজিদে নিয়ে যাওয়া, খুব ছোটবেলায় কোরআন শিক্ষা, বড়দের দেখলে হাত উঠিয়ে সালাম দেওয়া, বড়দের সামনে বসে কথা না বলা, বড়দের পায়ে সালাম করে দোয়া নেওয়া, এই সবকিছু আমার দাদার কাছ থেকে শিখা। তখন আমি ভাবতাম শুধু দাদা থাকলেই চলবে, দাদা ই মনে হয় বাবা।
সকালে এবং রাতে দুইবার আমার দোয়েল পাখি ওয়ালা দুইটা নোট লাগবেই। দুই টাকার নোট। পাঁচ টাকা বা দশ টাকা না, আমার দোয়েল পাখির ছবিওয়ালা নোট লাগবে। ভাগের ওই দুইটা নোট পরে অবশ্য একটা হয়ে গিয়েছিল, যখন বাবু বড় হয়ে গেলো। সেই সাথে দাদা দাদীর যন্ত্রণা আরো বেড়ে গেল। এতো দিন দাদা দাদীর ছিলো এক জ্বালা , শুধু একজন মাঝখানে ঘুমাতো, বাবু একটু বড় হওয়ার পর দাদা দাদীর গেপ আরো বেড়ে গেলো এখন তাদের মাঝখানে দুইজন ঘুমায়। প্রব্লেম হলো আমি একসাথে দুইজনকে ধরে ঘুমাতে পারিনা। কি জ্বালা, সেই মারামারি আমার আর বাবুর। তখন আমার দাদা ভাগ করে দিলো, এক রাতে দাদা আমার, আর দাদী বাবুর, আরেক রাতে দাদী আমার, আর্ দাদা বাবুর। ওই রাত গুলো আমার দাদা দাদীর জন্য আরো কষ্টকর ছিল। আমি রাতে একটু পর পর চেক করতাম যে আমার ভাগের দাদার গায়ে বাবুর হাত পা লেগে আছে কিনা, যদি দেখতাম বাবুর হাত বা পা আমার দাদার গায়ে লেগে আছে তখন ধপাস ধপাস করে চড় বা ঘুষি, আমার দাদাকে তুই ধরছিস কেনো। দাদা দাদী তখন দুইজনকে সামলে একটু দূরে সরে গিয়ে শুইতো। কিছুক্ষণ পর বাবু উঠে চেক দিত যে দাদীর গায়ে আমার টাচ লেগেছে কিনা। তাইলে আমার চুল ধরে হেব্বি মাইর, আমার দাদীকে ধরলি কেনো . এইভাবেই সকাল হয়ে যেত।
আমার দাদাভাই কঠোর পরিশ্রম করত, শুধু আমাদের চাহিদা পূরণ করার জন্য। আমার বাবার শারীরিক মানসিক সমস্যায় অসুস্থতার কারণে সবসময় কাজ করতে পারত না। তাই আমাদের সার্ভাইভ করাতে আমার দাদা অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। আমার দাদাভাইয়ের ঋণ আমরা কখনো ভুলব না। ভুলতে পারিও না। আজ আমরা সুস্থ্য ভাবে বেচেঁ আছি আমার দাদাভাইয়ের জন্যই। তিনি আমাদের ছেড়ে গত একবছর আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। মৃত্যুর সময় আমার দাদাভাইয়ের বয়স ছিল ১১০বছর প্রায়।
আমার বাবা:
বাবা তো শুধুই বাবা, বাবার সাথে পৃথিবীর কারোর তুলনা হয়না। আমার মনে হয় আমার জীবনের অর্ধেক সময় বাবার কাধে উঠেই পাড় করেছি। জীবনে কোনদিন বাবা আমাকে মা ছাড়া ডাকেনি। নাম ধরে ডাকেনি। সবসময় বলতো আমার মা। এইটা আমার মেয়ে না আমার মা। আম্মাকে সবসময় বলতো, এইটা আমার মেয়ে না আমার ছেলে। দেইখো আমার মা আমাদের দিন বদলে দেবে। বাবা বছরে দুই তিন মাস মানসিক ভাবে অসুস্থ থাকতো। আমার দাদা দাদী অনেক ট্রিটমেন্ট করিয়েছে কিন্তু সমাধান হয়নি। যতদিন বেঁচে ছিলেন এইভাবেই গিয়েছে। এক বছর ভাল থাকার পর হটাৎ করে অসুস্থ হয়ে যেত, পড়ে তিন চার মাস পরে একদম সুস্থ হয়ে যেতো। সেই সুস্থ থাকাকালীন সময়ে বাবাও কঠোর পরিশ্রম করত, কি কি কাজ করত সেই ইতিহাস আর্ না বলি। মনে পড়লে চোখ দিয়ে রক্ত ঝরে। বাবা মায়ের দিন বদলের স্বপ্ন ই যেন আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠলো তবে সেই স্বপ্ন পুরুপুরিই পূরণ হওয়ার আগেই বাবা চলে গেলেন। গত তিন বছর আগে আমার বাবা পৃথিবী থেকে বিদায় নিল। আল্লাহ্ আমার বাবাকে জান্নাতে সর্বোচ্চ সম্মানিত জায়গায় স্থান দিন।
আমার মেঝো কাকা:
আমার কাকা সবসময় আমার কাছে নায়কের মত ছিলেন। খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান, আমাদের এই তিনটা মৌলিক চাহিদা আমার মেঝো কাকা এন্সিউর করেছে। কি ড্রেস পড়বো, কি খাবো, কি লাগবে, সব কিছু আমার কাকাই বহন করেছে। ছোটবেলা থেকে আমি আমার কাকার জন্য অনেক পাগল ছিলাম। আমার কাকার শরীরে নিজস্ব একটা স্মেল আছে। যেই স্মেলটা পেলে আমি অনেক অসুস্থ থাকলেও সুস্থ হয়ে যেতাম। আমার কাকুও আমাকে অনেক ভালোবাসত, কাকু যখন বিয়ে করে, তখন আমি খুব ছোট, একটু একটু হাঁটতে পাড়ি, সেই সময় কাকু আমাকে তার সাথে নিয়ে গেছে বিয়ে বাড়িতে। এমনকি আমার কাকুর বাসর ঘরে ও আমি কাকুর সাথে ঘুমিয়েছিলাম ।
প্রিন্সেস ডায়নার ড্রেস কিনে দিয়েছিল কাকু আমাকে। কিযে আদর করত, তখন মনে হত শুধু মাত্র কাকু থাকলেই আমার চলবে। একবার আমার অনেক অসুখ, মৃত্যু শয্যায়, আমার দাদা ভেবেছিল হয়ত মরেই গেছি, কবর ও খুঁড়ে ফেলেছিল, কিন্তু আমি নাকি মুখ নেড়ে শুধু কাকু বলে ডেকেছিলাম একবার। আমার কাকু তখন ঢাকায় আমা কেপটেন দাদার ব্যাবসায় জব করেন। আমি অসুস্থ চিঠিতে পরে বাড়ি ছুটে গেলো, যেই আমার কাকা আমাকে কোলে নিয়েছে আমি নাকি তখন চোখ খুলে চেয়েছি। পানি মুখে দিয়েছি তারপর আস্তে আস্তে সুস্থ্ হয়েছি। আমার কাকা ছিলো আমার প্রাণ। আমার সেই প্রাণের চেয়ে প্রিয় কাকু শারীরিক ভাবে অসুস্থ। আল্লাহ্ যেন আমার কাকুকে আমার মৃত্যু পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখে। আমার ভাইবোনের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার শেষ পর্যন্ত যেনো আমার কাকু দেখে যেতে পারে। আমরা সব ভাইবোন মিলে যেনো একসাথে সুখে প্রতিষ্ঠিত ভাবে বাঁচতে পারি আর তা যেনো আমার কাকা দেখে যায় ।
দাদী চলে যাওয়ার পর এই ভেবে শান্তনা দিয়েছি, দাদা বাবা কাকাতো আছে। বাবা মরে যাওয়ার পর বেচে আছি, দাদা আর কাকাতো আছে, দাদাও চলে গেলো, শান্তনা আমার মেঝ কাকাতো আছে। ছোট কাকাতো বেচে থেকেও নেই আমাদের জীবনে। তবুও আল্লাহর কাছে সবসময় দোয়া করি আল্লাহ যেন আমার কাকাকে এবং তার সন্তানদের সুস্থ্য ও সুখে রাখে)
আল্লাহ্ তুমি আমার মেজো কাকাকে সুস্থ ভাবে বাঁচিয়ে রাখো আমার মৃত্যু পর্যন্ত। প্রাণের মানুষ কাছের মানুষ হারানোর যন্ত্রণা হয়তো আর সহ্য করতে পারব না। আল্লাহ্ একেবারে এতিম করনা আমাদের ভাইবোনকে। রাব্বির হামহুমা কামা রব্বা ইয়ানি সাগীরা।
লেখিকাঃ সাবিনা ইয়াসমিন সুরভী, ম্যানেজার, এডমিন এইচ আর, লরেল বাংলাদেশ লিমিটেড। তাঁর ফেসবুক টাইমলাইন থেকে লেখাটি সংগৃহিত।
কিউএনবি/বিপুল/১৭.০৬.২০২২/ রাত ১০.১০