তিতাস নদী পাড়ের এক যৈবতী কন্যার কান্না
——————————————————
‘আমার মা : দেখা হবেনা আর চক্ষু মেলিয়া’ শিরোনামে মা’কে নিয়ে আমি একটি পোস্ট দিয়েছিলাম ফেসবুকে। এই পোস্টটি কয়েকটি অনলাইন নিউজ মিডিয়া প্রকাশ করেছিল। ফেসবুক অথবা অনলাইন নিউজ মিডিয়ায় লেখাটি পড়ে গতকাল এক তরুণী আমাকে মেসেঞ্জারে কল দিলেন। বললেন, আজ মা দিবস এবং আপনার মা’কে নিয়ে আবেগঘন পোস্টটি সম্পর্কে আমি এক কাহিনী বলব। সত্য কাহিনী। আমি বললাম বলুন, আমি শুনব।
তরুণী অনার্স মাস্টার্স শেষ করে ‘ল’ কোর্স কমপ্লিট করেছে। এনরোলমেন্ট পরীক্ষার জন্যে এখন প্রস্তুতি নিচ্ছে। ২০২২ সালের এই জুন মাসের ১৭ তারিখে এনরোলমেন্ট পরীক্ষা। তরুণী ঢাকার ফার্মগেটে এক ছাত্রীনিবাসে থাকে। সে অনেক আগে থেকেই আমার ফেসবুক বন্ধু লিস্টে ছিল। কিন্তু তার উপস্থিতি কোনোদিনই লক্ষ্য করিনি। নিভৃতচারিনী আমার এই তরুণী ফেসবুক বন্ধুর নাম নীরা চৌধুরী। নীরা শুরু করল তার কাহিনী।
১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মাঝমাঝি কোন একদিনের কথা। আমি তখন ৬ মাস বয়সী এক শিশু কন্যা। আমার দাদীর এক ভাইয়ের ক্যান্সার হয়েছে। শেষ অবস্থা। দাদী তার ভাইকে শেষ বারের মত দেখার জন্যে আমাদের বাড়ী থেকে রওয়ানা দিলেন। সঙ্গে ছিলেন আমার ফুফু, ১০ বছর বয়সী ফুফুর মেয়ে, কিশোর ২ জন চাচাতো ভাই আর মা সহ মায়ের কোলে আমি।
আমাদের বাড়ী কুমিল্লা জেলার হোমনা উপজেলায়। দাদীর বাড়ীর যাত্রাপথের মাঝামাঝি তিতাস নদী পার হতে হয়। সেদিন মেঘ মুক্ত আকাশ আর স্বাভাবিক আবহাওয়া ছিল। সেপ্টেম্বর অর্থাৎ বাংলা ভাদ্র মাসের পড়ন্ত বিকেলে দাদী আমাদেরকে নিয়ে নৌকায় নদী পাড়ি দিচ্ছেন। নৌকা যখন মাঝ নদীতে তখন হটাৎ করেই ঝড় বৃষ্টি শুরু হল। ভাদ্র মাসে তিতাস তখন এক প্রমত্তা নদী।
তীব্র ঝড় বৃষ্টিতে নৌকা ডুবে গেল। মা আমাকে নিয়ে নদীতে হাবুডুবু খাচ্ছে। মা এক হাত দিয়ে ৬ মাস বয়সী আমাকে উঁচু করে ধরে সাঁতার কাটার চেষ্টা করছে। মা’র পড়নে ছিল শাড়ীর উপরে বোরকা। এই জন্যে মা সাঁতার কাটতে পারছিলনা। তিতাসের তীব্র স্রোতের বিরুদ্ধে আমার মায়ের বেঁচে থাকার সংগ্রাম যখন নিঃশেষ প্রায় তখন কোথা থেকে যেন একদলা কচুরিপানার স্তুপ ভেসে আসছিল। মা আমাকে কচুরিপানার স্তুপে নিক্ষেপ করে নিমিষেই তলিয়ে গেল তিতাস একটি নদীর তলে।
ঝড় বৃষ্টি সহসাই থেমে যায়। তিতাস পাড়ের গ্রামবাসীরা উদ্ধারে নামে। তারা আমাকে উদ্ধার করে কচুরিপানার স্তুপ থেকে। আমার ফুফু তার ১০ বছরের মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেও মরে যায়, ফুফাতো বোনও মারা যায়। শুধু বেঁচে যায় আমার দাদী, চাচাতো ২ ভাই আর আমি। মায়ের লাশ পাওয়া যায় দেড় মাইল দূরে।
ফোনের অপরপ্রান্তে তরুণী নীরা চৌধুরী ফুঁফিয়ে কাঁদছে। আমার চোখের চশমা খুলে আমি রুমালে মুচছি। পৃথিবীতে এত কান্না কোথায় লুকিয়ে ছিল এতদিন ? একটু সময় নিয়ে নীরা আবার শুরু করল। এবার সে শুরু করল আমাকে নিয়ে।
আপনি যখন নিতান্তই শিশু তখন আপনার মা মারা যায়। হয়তোবা আপনার মায়ের কিছু অস্পষ্ট স্মৃতি আপনার স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে। আপনি আপনার মা’কে কবরে শুইয়ে দিতে দেখেছেন। তাঁকে কবর দিতে দেখেছেন। সদ্য নতুন কবরে মা’কে খোঁজার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মা আমার কাছে অন্ধকার একটি অধ্যায়। মা সম্পর্কে আমার কিছুই ধারণা নেই। কচুরিপানা থেকে আমাকে উদ্ধার করে গ্রামবাসীরা হাসপাতালে নিয়ে যায়। ডরোথি পাল্মা নামে এক নেটিভ ক্রিশ্চিয়ান ডাক্তার আমাকে প্রানান্তকর চেষ্টা চালিয়ে বাঁচিয়ে তুলে। শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে আজ অবধি এই ডরোথি পাল্মার সাথে আমার যোগাযোগ আছে। তিনি নিজের মেয়ের মত আমাকে ভালোবাসেন। কল্পনায় যখন মা এর মুখ স্মরণ করার চেষ্টা করি, তখন শুধু ডরোথি পাল্মার মুখটাই ভেসে উঠে।
আমি বললাম, এখন তোমার কি অবস্থা ? তুমি কেমন আছ ?
নীরা জবাব দেয়, আমি এখনও কচুরিপানার উপর ভেসে বেড়াচ্ছি। আমার বাবা সরকারী চাকুরীজীবি ছিলেন। মধ্যবয়সী বাবা আমার কারণে আর দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। যদি সৎমা আমাকে কষ্ট দেয় ? বাবা এখন রিটায়ার্ড লাইফে, বার্ধক্য তাকে তিল তিল করে গ্রাস করছে। এখন তিনি অসুস্থ। আমার ৩ জন বড়ভাই। বড়জন হোমনাতেই থাকেন আমাদেরগ্রামের বাড়ীতে। মেজো ভাই ঢাকায় পরিবার নিয়ে থাকেন। ছোটখাট এক চাকুরী করেন। আর সব ছোটভাই মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিকের জীবন নিয়ে আছেন। বড় দুই ভাই বিবাহিত। ছেলেমেয়ে আছে।
তুমি কচুরিপানার মত এখনও ভাসছে কেন ? কি সমস্যা তোমার ? আবারও ভিন্ন এক কাহিনী শুরু করল নীরা।
আমার জন্মটাই অপয়া,অলুক্ষণে। আমার ভাই, আত্মীয় স্বজনরা মনে করে আমার জন্যেই আমার মা মারা গেছেন। আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা না করলে হয়ত তিনি বেঁচে যেতেন। আমি যেন অপাংক্তেয় একজন। ভাই-ভাবীরা আমাকে বিষ দৃষ্টিতে দেখে। সৎ মায়ের দেয়া কষ্টের কারণে বাবা বিয়ে করলেন না। তিনি এখন ভাই ভাবীদের কাছে এক বোঝা। আমাকে লেখাপড়ার খরচ দিতে চায়না। আমাদের কয়েকটি দোকান ভাড়া দেয়া আছে। বাবা এই টাকা আমার লেখাপড়ার জন্যে নির্দিষ্ট করেছেন, কিন্তু ভাইরা এখন সে টাকা দেয়না। আমি টিউশনি করে আমার লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছি । ভাবীরা কথিত সৎ মায়ের চেয়েও অনেক বেশি কষ্ট দেয় আমাকে।
হটাৎ করে নীরা আবার ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠল। জানেন ভাইয়া, এবারের এই ঈদের ৩ দিন আগে গ্রামের বাড়ীতে গিয়েছি। ভাইরা আমাকে কিছুই দেয়নি। দুই ভাবীই আমাকে নিয়ে অনেক নোংরা কুৎসিত মন্তব্য করেছে। রোজায় শুয়ে বসে কাটিয়েছি ঢাকায়। এজন্যে ওজন বেড়ে গেছে। বড়ভাবী আমার নিতম্ব দেখে বলে, কোন নাগর জুটিয়েছিস? এত মোটা হচ্ছিস কেন ?
আমি ধীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মেসেঞ্জার অফ করে দেই। ইউটিউবে খুঁজতে থাকি ঋত্বিক কুমার ঘটকের ছবি ”তিতাস একটি নদীর নাম”।
আমাদের কথাঃ কুইকনিউজবিডি.কমে ফেসবুক কর্নার নামে একটি নতুন বিভাগ চালু করা হয়েছে। প্রতিদিন ফেসবুক টাইমলাইনে অনেকেই জীবনের খন্ডচিত্র এঁকে থাকেন। আমরা সে খন্ডচিত্র গুলোকে জোড়া দেয়ার চেষ্টা করছি। এখন থেকে ফেসবুক কর্নার নামের এই বিভাগে নিয়মিতভাবে অনেকের জীবনের খন্ডচিত্র তুলে ধরা হবে।
আজকে লুৎফর রহমান, রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট এর ফেসবুক টাইমলাইন থেকে পোস্টটি সংগ্রহ করা হয়েছে। লুৎফর রহমান নিয়মিতভাবে চমৎকার লেখনীর মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক চমৎকার পোস্ট উপহার দিয়ে থাকেন।
কিউএনবি/বিপুল/ ০৯ মে ২০২২ খ্রিস্টাব্দ/ সন্ধ্যা ৭.৫৫